প্রতিবেশী সাহিত্য
সুমতি লাল সাক্সেনা’র গল্প
(অনুবাদ : মিতা দাশ)
লেখক পরিচিতিঃ সুমতি
লাল সাক্সেনার জন্ম ১৯৪৪ সালে। তিনি লাখনৌ’র বাসিন্দা। হিন্দী গল্প ও উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে তিনি
সুপরিচিত লেখিকা।
কত বছর পরে
আম্মার গায়েঁর দই, ছানা, মাখন আর এক ঝুড়ি ভর্তি
তরকারিপাতি পাঠিয়েছেন। বজরঙ্গী গ্রামে আমাদের বাড়ির গরু মহিষের দেখাশুনার কাজ
করে। যখন সে শহরে দুধ বিতরণ করতে আসে, আম্মা এই সব জিনিস তার হাতে দিয়ে পাঠাতে
থাকেন। কখনো -কখনো, ময়দা দিয়ে বানানো গুজিয়া, বেসন লাড্ডু এবং মাঠরি (নিমকি) ইত্যাদিও
তৈরি করে পাঠান। তাই এই সমস্ত জিনিস আমার বাড়িতে পৌঁছে দেয় বজরঙ্গি আর সাথে একটি
এক পাতা চিঠিও থাকে। প্রতিবার একই ধরনের প্রশ্ন এবং আদেশ সেখানে লেখা থাকে,
"জিজ্জি কেমন আছেন? তুমি ভাগ্যবান যে তাদের বাড়ির পুত্রবধূ হয়ে গেছ, তাদের
যত্ন নিও, ভাগ্যমতি আমার কন্যা।"
আমার শাশুড়ি আমার মামিরমার বড় বোন তাই আম্মা উনাকে
জিজ্জি বলে ডাকেন তিন চার লাইন উনার বিষয়ে লেখার পর উনি জিজ্ঞাসা করেন যে
"তুই মামীর বাড়ি গিয়েছিলি? সব সময় যাবি মা! এখন তোর মামাও আর বেঁচে নেই, তুই
গেলে তোর মামীর ভালো লাগে।" তারপর শেষে সেই দুই লাইন "নিজের জন্য কিছু
বের করে কিছুটা মামীকে পাঠিয়ে দিস।"
আম্মা জানে যে আমি নিজেই মামিকে এইগুলি পাঠাবো, কিন্তু
সে আমাকে বলতে ভুলে না আর আম্মা এত ছোট চিঠি লিখে সেই চিঠিটা পড়তে শুরু করব
তৎক্ষণাৎ চিঠিটা শেষ।
কিন্তু এবার আম্মা খুব দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন। কপিটির
মাঝখান থেকে দুটি সংযুক্ত পাতা বের করে তার দুই পাশেই লিখেছে। বাকি জায়গাটিও
আগে-পেছনে আড়া-আড়ি করে পূরণ করা হযেছে। এত লম্বা চিঠি দেখে আমি খুশি এবং অবাক
হলাম। লিখেছেন "মোহন এলাহাবাদ থেকে এসেছিলেন বিট্টুর সঙ্গে রজ্জনের বিয়ে ঠিক
করতে। শ্রাদ্ধপক্ষ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই এই মাসের সাতাশ তারিখে ওদের বিবাহ।
আমি পড়ে হতবাক হয়ে গেলাম যে বিট্টু একটি শিশুর মতো,
সে কি একটি শিশুর মতই তো, সত্যি বিট্টু একটি শিশু? মাঝে মাঝে ছোট মামা বড় মামার
বাড়িতে আসতেন, তখন আমি সারাদিন বিট্টুকে কোলে তুলে খেলতাম। এখন সে সবে সোল বছর
বয়সী হবে, আমার থেকে দুই বছরের বড় এবং তিরিশ বছর বয়স রঞ্জন ভাইয়ার। এখন এক বছর
ও হয়নি বৌদি মারা গেছে জমজ বাচ্চা জন্ম দিতে, গাঁয়ের ধাত্রী বুঝে উঠতে পারেনি। যখন
ব্যথা আরও বেড়ে যায়, তখন বেচারী বৌদি শহরের হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা যায়।
এই মৃত্যু খুবই বেদনাদায়ক মৃত্যু।
আমি আম্মার চিঠি নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলাম, পুরো
চিঠিটি ছিল একটা দীর্ঘ বিলাপ। এটা লেখা আছে যে আমি মনে করি আমাদের বাবা এবং ছোট
ভাইয়ের মেয়েদের জন্য কোন স্নেহ ছিল না। যেমন-তেমন করে কোথাও বাড়ি থেকে বার করে
ফেলে দিয়ে পরিত্রাণ পাওয়ার সুযোগ খুঁজতেন। এর চেয়ে বেশি ভালো হত এরা আমাদের মেরে
ফেলতেন ও তাহলে মেয়েদের ভাগ্যে এমন অন্ধকার জুটত না আর নাইবা গোটা জীবন এই
অন্ধকারে ডুকরে মরতে হত।
বিট্টুর অজুহাতে, আম্মার নিজের ব্যথাও উপড়ে নিয়ে আমার
সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আমি আজকের আগে এটা কখনো বুঝিনি। আম্মা যেখানে ছিলেন এবং
যেভাবে জীবন যাপন করছিলেন, সবকিছুই সঠিক এবং স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। এ ছাড়া,
আম্মা অন্য কিছু হতে পারতো বা অন্য কোথাও হতে পারতেন, এটা কখনো মাথায় আসেনি। আমি
তাকে সবসময় সেখানে দেখেছি এবং একই ভাবে, তার বাইরে, আমি কখনই তার সম্পর্কে কিছু
ভাবিনি, হঠাৎ আমি আম্মার সারা জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করি।
আম্মা এলাহাবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেছিল। তার দিদিমার
অকাল মৃত্যুর পর, তার দাদু নিজেকে মুক্ত করার জন্য, তাকে সেই অন্ধকার গ্রামে
আমাদের বাবার সাথে বিয়ে দিয়ে ছিলেন। তাই আম্মা নিজের ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি নিয়ে
সারাদিন কাজ করতেন, সে খুশি বা দুখী, আমি তার মুখে এমন কোন অভিব্যক্তি কখনো
দেখিনি। আজ হঠাৎ লক্ষ্য করলাম যে গ্রামে তাকে কারও সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব
নিয়ে কথা বলতে কখনো দেখিনি। কখনো হাসতে দেখেনি এমনকি কারো উপর রাগ করতেও দেখেনি।
সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত, বাঁধা রুটিন ছিল তার সে যেন একটি যন্ত্র, মানুষ নয়। তার যন্ত্র
হয়ে ওঠার কারণে, বাড়ির কোনো লোকের কিছু যায় আসে না। আমি ছিলাম তার নিজের কন্যা,
তার রক্ত এবং মজ্জার অংশ, যখন আমিই কখনো তার সম্পর্কে কিছু অনুভব করিনি, তখন বাকি লোকদের
নিয়ে কি ভাবব?
সারা জীবন আমি আম্মাকে গ্রামে থাকতে দেখেছি। বাইরের
নামে, বাসা থেকে মাঝে মাঝে সপ্তাহ দশ দিন বড় মামার বাড়িতে যেত। আমার বড় মামা
লক্ষ্ণৌতে থাকতেন। উনি আমাদের গাঁয়ের কাছেই থাকতেন। বড় মামা ও মামী আমার মা কে খূব
ভালোবাসতেন। আম্মা নিজের জন্য সেই ভালবাসা ও আকাঙ্ক্ষাকে বেশ ভালো করে চিনতো তাই
সময় পেলেই আপনত্বের সঙ্গে সেখানে যাবার প্লান
তৈরি করে নিতেন। এখন তো মামা বেঁচে নেই। মামী নিজেই ছেলেদের কাছে থাকেনদ।
এখন রীতিমত আম্মার বাইরে বেরোনো এক্কেবারে কয়েক বছর বন্ধ। কখনো মামী এলে দেখা করতে
যেতেন। সকালে যেতেন আর বিকেলে ফিরে আসতেন বেশি হলে এক রাত্রি থেকে সকালে ফিরে
আসতেন। প্রত্যেক বার আমার বাড়িও আসতেন,
কিন্তু শুধু মাত্র এক আধ ঘন্টার জন্য, দেখা করে চলে যেতেন। কিছুক্ষণ বসে তারপর
গোটা বাড়ির এক চক্কর লাগাতেন। আমার বাড়ি ও আমাকে দেখে উনি বেশ খুশি হতেন তারপর
ফিরে যেতেন। গ্রামের তো এই রেওয়াজ কি লোকেরা মেয়ের বাড়ি যায় না, থাকার জন্য তো
একেবারেই না। যদি কখনো থাকতে হয় তাহলে নিজের খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা বাইরে করত না
হয় খাবারের জন্য মূল্য ধরে দিত।
যখন সে মামার বাসায় আসত, তখন কিছুদিন আরামে থাকতেন।
জীবনযাপন করে ফিরে আসার সময় তাকে খুব বিষণ্ণ ও অস্থির লাগত। তার চলে যাওয়ার সময়,
সমানভাবে মামা ও অস্থির হয়ে যেতেন যেন আম্মা তার বাড়িতে না গিয়ে কোন যন্ত্রণা
গৃহে যাচ্ছে। আম্মা তার নিজের বাড়িতে ফিরে যেতেন, তবুও তিনজনই কেন এত দুখী হতেন ,
এই জিনিসটা আজ হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম। যেখানে কারও সঙ্গে আপনার মনের কোনো মিল নেই।
সেই জায়গায় নিজের বাড়ি থাকা এক ধরনের নির্যাতন না তো কি! সেই বয়সে সম্পর্কের
এত সূক্ষ্মতার দিকে মনোযোগ কোথায় থাকতো, বোঝাও ভার। যখন শ্বাস থেকে ভিন্ন হয়
অনুভূতি , তখন এ বোঝার বুদ্ধি কোথায় ছিল? তখন এতটা বুদ্ধি ছিল না যে শুধু একজনের
পেট ভরা এবং মাথার উপর ছাদ থাকা একজন ব্যক্তির জীবন কাটানোর জন্য যথেষ্ট নয় এই
কথা বোঝার। তাহলে কি বলব, আজকের আগে আমি কখনোই এ নিয়ে ভাবিনি। আমি আমার জীবনে এত
আত্ম-সচেতন ছিলাম যে নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখার এবং চিন্তা করার সময় ছিল না।
তখন আম্মাকে নিয়ে কিছু ভাবার কোন প্রয়োজনই ছিল না। সে তো আজ হঠাৎ আম্মাকে দেখতে
লাগল যন্ত্র নয় একটি আলাদা মানুষ। যে মানুষ সুখ এবং দুখের কথা চিন্তা করে এবং
অনুভব করে। আজ হঠাৎ করেই আমি আগের কথা
গুলি মনে করতে শুরু করলাম, তাই আমার এমনই মনে হল।
আম্মার পেছনেও, যখন-তখন মামা তাকে স্মরণ করতেন এবং
বিয়ের আগ পর্যন্ত তার শৈশব নিয়ে ও কথা বলতেন।" তোমার মা খুব সুন্দর ছিল।
পড়ার ও বেশ শখ ছিলো তা্র। প্রত্যেক বার সে ক্লাসে প্রথম হ্ত। কিন্তু কিচ্ছুই হল না
সব শখ রয়েই গেল।
"যখন প্রথম বার আমি ওকে শশুর বাড়ী থেকে আনতে
গেলাম তো... মামা প্রত্যেক বার কথা গুলো এখানেই অর্ধেক বলে ছেড়ে দিতেন।"
আম্মার বিয়ের পর কত বছর পেরিয়ে গেছে তা না জানলেও আজও আম্মার শৈশব এবং তার
বিয়ের কথা বললে মামার কণ্ঠ রুদ্ধ এবং তার চোখ ভিজে যেত। মামার কথা পরবর্তীতে মামি
পূর্ণ করতো , "সেখান থেকে আসার সময় অনেক কেঁদেছিলেন তো মামা"। একদম অন্ধকারে
ডোবা অজপাড়া গাঁ "জানিনা কি করে বেচারি জীবন যাপন করতো ওখানে?"
মামী আবার কথার ভেতর আরো অনেক কথা যোগ করে বলতেন
"এক হাত লম্বা ঘোমটা দিতে হত, বল দেখিনি সেখানে ওর সৌদর্য্য দেখে কে! সেই
অবস্থায় আর ওর সেই থাকা, ওঠা-বসার ভেতর আর নিজেকে কত আর সুন্দর রাখা যায়?"
মামা আম্মার শৈশব নিয়ে এত কথা বলতেন, কখনই এক
মুহূর্তের জন্যও মনে আসতো না যে গ্রামের আগে আম্মার কোন জীবন ছিল! এমনকি গ্রাম
থেকেও এখানে কোন আলাদা জীবন ছিল, যার মধ্যে তিনি নিশ্চয়ই তার জীবন সম্পর্কে কিছু
স্বপ্ন দেখেছেন ... অন্তত তিনি এমন জীবন কামনা কখনো করেনি বোধহয়! মামা বেশ ভাবুক
হয়ে এই সব কথা বলতেন, তাও আমি কখনো আম্মার সুখ-দুঃখের কথা ভাবার প্রয়োজন বোধ
করিনি। শুনে বেশ ভালো লাগতো কি আম্মা খূব সুন্দরী ছিলেন, সে পড়াশুনায়ও বেশ ভালো
ছিলেন। সব কথা যেন রূপকথার মত মনে হত। কানে সব আসতো কিন্তু মনে ও মাথায় কোনো দাগ
না কেটেই চট করে অন্য কোন দিয়ে বেরিয়ে যেত। কখনো এই কথা ও মনে হয়নি যে শৈশবে
এলাহাবাদ শহরে থাকার পর সেই অন্ধকারে ডোবা
গাঁয়ে সেই গেঁয়ো পরিবেশে থাকতে আম্মার কত কষ্ট হয়েছে ... কত কাজ, কত একান্তে, কত
উদাস ও বিবর্ণ জীবন। আমি তো একই বাড়িতে এবং পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছি। তাও, একবার
সে সেই বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম, আর কখনোই এই বাড়িটিকে নিজের হৃদয় দিয়ে মেনে নিতে
পারলাম না।
বুঝতে পারিনা দাদু আম্মার প্রতি এতো কঠোর কি করে হলেন
বা মোহন মামা ও বিট্টুর সঙ্গে এমন করতে পারে কী!
বিট্টুর ছলে আমার চোখ দিয়ে আম্মার জন্য জল গড়িয়ে এল।
আম্মাকে আমি অনেক মিস করছিলাম। অনেক ভালবাসার সাথে
স্মরণ কর ছিলাম, কিছু সময়ের জন্য তার সাথে একা থাকার মতো অনুভূতি বোধ করছিলাম।
ওনাকে স্পর্শ করতে এবং ওনার ব্যথা অনুভব করতে চেয়েছিলাম। পরের দিন শনিবার,
ভাবছিলাম আমি কলেজ থেকে এসে গ্রামে যাব এবং দু দিন ছুটি নেব এবং চার-পাঁচ দিন আমি
আম্মার সাথে আরামে থাকব।
যাই হোক, পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে সঞ্জয়
আমাকে প্রতি দু মাসে গ্রামে নিয়ে যান। আমরা সেখানে কয়েক ঘন্টা থাকি, অতিথি
হিসাবে খাওয়া-দাওয়া করি। ও রাত হবার আগেই ফিরে আসি। কিন্তু বৌদির মৃত্যুর পর সে
দু- তিনবার একা গ্রামে গেছে। সঞ্জয়ের পক্ষে আমার সাথে বারবার গ্রামে যাওয়া সম্ভব
ছিল না। আমায় চিনহাট পর্যন্ত বাসে যেতে হত, তার আগে আমায় গ্রাম পর্যন্ত রিকশা নিতে
হয়। গ্রামের অনেক রিকশাওয়ালা আমাকে চেনে। ওরা ক্লান্ত হয়ে বসে থাকলেও আমায় বাড়ি
অব্দি পৌঁছে দিতে দ্বিধা করত না। এটা একটা ভিন্ন বিষয় যে গ্রামে পৌঁছতে বেশি সময়
লাগে এবং তার উপরে রিক্সা কাঁচা রাস্তায় চলার কারণে শরীরের হাড়ে ব্যথা শুরু হয়।
কখনো-কখনো এটা ভাবতে অদ্ভুত লাগে যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কত বছর কেটে গেছে, লখনউ
উত্তরপ্রদেশের রাজধানী এবং তার পাশের গ্রাম নতুন নির্মাণ, এই গ্রামগুলির রাস্তা
এবং বিদ্যুতের মতো প্রয়োজনীয় জিনিস এখনও পৌঁছায়নি।
আমি কাল সন্ধ্যা থেকে মামিকে ফোন করছি। মনে হচ্ছে ওনার
ফোন খারাপ। সকালে যখন আমার ঝি বাসনপত্র পরিষ্কার করতে এসেছিল, তখন আমি আমার মামির
কাছে ঝিয়ের হাতে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। কি উনি এখানে এসে কিছুদিন আম্মার সঙ্গে
থাকলে আমি একটু গ্রামে ঘুরে আসতাম। কিছুক্ষনেই মামী এসে পৌঁছে গেলেন।
যখন তারা গ্রামে পৌঁছায়, তখন সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা,
আম্মা এবং জেঠিমা সাগ কূটছিলেন ওরা বস্তা
পেতে মাটিতে মুখোমুখি বসে ছিলেন। আর আমার দিকে আম্মার পিঠ ছিল। আমার পায়ের শব্দ
শুনে খুশি তে জেঠিমা বলে উঠলেন আরে! আম্মা পেছন ফিরে তাকালেন এবং লাফিয়ে উঠলেন
এবং যথারীতি দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আম্মা জানিনা কোন সাবান ব্যবহার
করে যে কাপড়-চোপড় থেকে এক অদ্ভুত গন্ধ থেকে যায়? প্রথম দিকে, আমি যখনই আসতাম, আমি
তাকে কাপড়ের সাবান বদলানোর কথা বলতাম। এক
আধ বার সে শহর থেকে ওয়াশিং পাউডারও এনে দিয়েছিল কিন্তু তারপরও নিয়ম কার্যকর
হয়নি। কারণ গাঁয়ে তো আবার আম্মাকে গায়েঁর মত থাকতে হবে। আমি নিজের বাড়ির
নিয়ম-কায়দা ওনার উপর চাপাবোই বা কি করে। আজ ভাবতে খারাপ লাগছিল যে আমি যদি চাইতাম,
আমি বজরঙ্গীর হাতে সাবান পাঠানোর নিয়ম বেঁধে রাখতে পারতাম।
আমি জানতাম যে এখন আম্মা প্রত্যেকের অবস্থা জিজ্ঞাসা
করবেন, কে কেমন আছে। বাচ্চাদের, জামাই এর সবকিছুর অবস্থা ও খবরাখবর জানার পর, তিনি
তার বৌদির কথা জিজ্ঞাসা করবেন "কি রে বৌদি কেমন আছেন?" শেষ কবে দেখা
হয়েছিল? তারপর আমার উত্তর যাই হোক না কেন, সে তা শুনেও না সোনার মত আমায় বুঝিয়ে
বলবেন "দেখা করে আসিস মাঝে মধ্যে, মামা তো এখন নেই। অনেক কিছু করেছেন মামী
তোর জন্য। ওরা দুজনে মিলে তোর জীবন সুন্দর করে তুলেছেন।
এতো বছর হয়ে গেল কিন্তু আম্মার চেহারা আজ ও উনাদের
উপকারে বোঝায় ছলছল করে ওঠে। তখন চন্দের জন্ম হয়নি, প্রায় আঠারো বছর কেটে গেছে।
আম্মার সাতটা সন্তানের মধ্যে আমিই একমাত্র বেঁচে ছিলাম। আমরা মামার বাড়িতে
গিয়েছিলাম। আম্মা, মামা এবং মামী, যারা পরের দিন ফিরে আসবেন, দুঃখ পেয়েছিলেন,
ওদের মধ্যে কেউ-কেউ কাঁদছিলেন।
আম্মা তখন তার ছোট্ট বক্সটি গুছাচ্ছিল, কিন্তু তার
মুখে এক অদ্ভুত বিভ্রান্তি ছিল। যেন সে কিছু ভুলে যাচ্ছে বা কিছু বুঝতে পারছে না।
একই বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তিনি এক বার মামার দিকে তাকালেন ..."দাদা!"
আম্মা হঠাৎ বলেছিলেন এবং আরও কিছু বলার আগে তিনি নিজের মুখ বাক্সের দিকে মুখ
ফিরিয়ে নিলেন। আমি আম্মার মুখে আতঙ্ক দেখতে পেলাম যেন তার মামার দিকে তাকানোর আর
সাহস নেই। আমি জানি না যে আম্মা ইতিমধ্যে মনে-মনে এই জিনিসটা মনে ধরে রেখেছে বা এই
চিন্তা তার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এসেছিল কিনা!
"দাদা, একে তোমার কাছে রাখো এবং তোমার বাচ্চাদের
মত একেও লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলো, যদি সে এখানে গ্রামে থাকে তাহলে
জানি না... আম্মা মাথা তুলে একবার আমার মুখের দিকে দেখলো। তার চোখ দিয়ে অশ্রু
গড়িয়ে পড়ল এবং সে তার কথা শেষ করতে পারল না। আম্মার কণ্ঠে এমন নিরীহ ভাব ছিল
যেন সে মামার কাছে ভিক্ষা চাইছে!
মামা এবং মামা দুজনেই একসাথে হতভম্ব হয়ে গেল এবং
দুজনেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চোখে একে অপরের দিকে তাকাল। আম্মা নিজের কথা বলার পর,
আম্মার মুখে একটি অযৌক্তিক ভাব ছিল যেন সে কোনো অপরাধ করেছে। আম্মা আগের মতই তার
বাক্স ঠিক করতে থাকলো, যেন সে সবার চোখকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
মামা কতক্ষণ মৌন ছিলেন তা আমার মনে নেই, কিন্তু সেই
কয়েকটা মুহূর্ত খুব দীর্ঘ মনে হয়েছিল,
সেই বয়সে আমি অনেক কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু তারপরে আমার অনুভূতি হয়েছিল যে
মামা যদি স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেন, তাহলে ওখান থেকে ফেরার সময় মনটা কতটা
অযৌক্তিক মনে হবে? মনে হলো আম্মা অযথা আম্মা বললেন যে দু-চার দিনের জন্য কারও
বাড়িতে আসা এবং চিরকাল থাকাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।
"আমাদের উপর বিশাল দায়িত্ব তুলে দিচ্ছ
প্রভা" মামা আমাদের দুজনের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন আর বললেন "অন্যের বাচ্চা
রাখতে ভীষণ ভয় করে! কখনো এমন যেন না হোক কি বাচ্চাদের কারণে আমাদের সম্পর্কটাই
খারাপ হয়ে যায় না যেন! তাও তুমি নিজের শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে ও স্বামীর সঙ্গে কথা বলে
নাও!"
"ওর জীবন যদি ভালো হয়ে যায় ভালো নয় কি? নষ্ট
হয়ে গেলে আমি কি করব? আমি নিজের বেলায় সহ্য করেছি , কিন্তু মেয়ের বেলায় সহ্য করতে
পারবোনা ! "আম্মা এতক্ষন নিজের চোখের জল চোখে ধরে রেখেছিল সেই জল গড়িয়ে পড়ল ।
এক একটা চোখ থেকে অজস্র জল গড়িয়ে পড়ল।" গ্রামে লালিত মেয়ের জীবন গ্রাম্য হয়েই
থেকে যায়! "আম্মার গলা বন্ধ হতে লাগলো।
মামী এগিয়ে গিয়ে আমার মাথার উপর হাত রেখে আমাকে তার
কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো যেন সে আমাকে আগামী ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা থেকে রক্ষা করছে।
মামা স্থির চোখে মামির দিকে তাকিয়ে হাসলেন, সেই হাসিতে তৃপ্তি ছিল এবং সেই চোখে
মামির প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা ছিল।
পরের দিন আম্মা গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন, তার চলে
যাওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে, আম্মা ছোট থেকে বড় কত কথা যে বোঝালেন, মন দিয়ে পড়াশুনা
করবে, মামীর কথা শুনবে। নিজে থেকে কিছু তুলে খাবেনা। বাড়ির কাজে মামীর হাতে হাতে
কাজ করবে। নিজের কাপড় ও নিজের জিনিস পত্র নিজে পরিষ্কার করে রাখবে, অনেক কিছু
বুঝতে থাকলেন।
আমার মামি আমাকে খুব স্নেহ করে রেখেছিলেন। স্কুলটি
আমার মামার বাড়ির খুব কাছে ছিল এবং সামনের সরু পথটির দেখা যেত ও সেই রাস্তার
ওপারে ভাতখণ্ড সঙ্গীত মহা বিদ্যালয়ের পিছনের দিকের উঠান দেখা যেত। আমি স্কুল থেকে
আসতাম এবং বিকেলে গান শিখতে যেতাম, প্রথম দিকে আমি আম্মাকে খুব মিস করতাম। তাদের
স্মরণ করে যখন-তখন চোখের জল গড়িয়ে পড়ত
কিন্তু আমি সেই চোখের জল সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতাম। তাও গ্রামে ফিরে যাওয়ার
কথা ভাবতেই পারতাম না। আম্মা যখন এখানে আসতো তখন আমার খুব ভালো লাগতো। আমি
সারাক্ষণ আম্মার আশেপাশে আড্ডা দিতাম, ঘুর-ঘুর করতাম, কিন্তু ধীরে ধীরে আমার
মায়ের বাড়ি, আমার স্কুল, আমার সঙ্গীত, এত কিছুর মাঝে এত খুশি থাকতাম যে
ধীরে-ধীরে আম্মার কথাও আম্মার মুখ এখন বেশ ঝাপসা হয়ে উঠেছে।
আম্মা সামনে বসে সবুজ শাক কূটছিলেন, আমি তাদের কাছে
পীড়িতে বসলাম এবং তাদের সাথে শাক বাছতে শুরু করলাম। বাম পাশে মাঠ জুড়ে হাসপাতালের
পিছনে সূর্য অর্ধেকেরও বেশি ডুবে গিয়েছিল। আমাদের বারান্দার এই অংশে সূর্যের আলো
কমলা রঙের হয়ে আম্মার মুখে তির্যক ভাবে পড়ছিল। আমার চোখ আম্মার দিকে স্থির ছিল।
তার মুখ সূর্যের কমলা আভায় তপ্ত হয়ে উঠেছে এমনটাই মনে হচ্ছিল। মামা বলতেন তোর
আম্মা খুব সুন্দর ছিল, মামি বলতেন, সেই গ্রাম্য পোশাক আর গ্রাম্য লাইফস্টাইলে কত
দিন সুন্দর থাকা যায়। আমি ভাবতে থাকলাম তাই কি!
ঠাকুরমা সম্ভবত ভিতর থেকে আমার কণ্ঠ শুনেছিলেন তাই
তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন ও বলে উঠলেন "ভাইয়ের বিয়া শুনে ছুটে চলে এসেছে মেয়ে
আমার"
বান্না, সোহর সব কিছু তৈরি করে নিস রে মেয়ে" জেঠিমা
ও উৎফুললিত হয়ে উঠলেন। আমি চুপ করেই ছিলাম কিন্তু মন বেশ বিরক্তিতে ভরে উঠল। বৌদি
মারা গেছে যে এখনো বছরও গড়ায়নি আর এদিকে বিয়েই নয় ভবিষ্যতে বাচ্চা হবার গানও তৈরী
করার হুকুম দেয়া হয়ে গেল। বাচ্চা হতে গিয়েই তো বৌদির মৃত্যু ঘটে ছিল। ... কোন
কসাইখানায় নিয়ে যাওয়া হবে বিট্টুকে সে কথা ভাবতেই বিট্টুর মুখ চোখের সামনে ভেসে
উঠল। পরের ক্ষণেই মনে হল কোথাও যেন কিছু ভুল হচ্ছে। আমি এমনটা কেন ভাবলাম, এই
বাড়িতে খারাপ তো কেউ নয়? চিন্তাভাবনার বিচ্ছেদের কারণে একজন ব্যক্তি নিজের থেকে
আলাদা হয়ে যায়, কিন্তু কেন তাকে ভুল ভাবা হয়? এসব চিন্তার জন্য ওরা অপরাধী কি?
এরা সবাই এই পরিবেশে বড় হয়েছে। ওরা তো এরকমই হবে। আম্মা তাদের মতো ছিলেন না, তাই
তিনি কষ্টে ছিলেন। সে কারণেই সে কষ্টে ছিল, আর সে কারণেই সে কখনই জেঠিমার মতো
হাসতে পারল না।
ঠাকুমার বুড়ো ভদ্র ও ভালো মানুষের মুখে অনেক আক্ষেপ
ছিল। "সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ দু’ দু’খানি সন্তান আজ বাড়িতে খেলত ...
আর" ঠাকুরমা নিজের কথা মাঝখানেই ছেড়ে দিল। আমি ওনার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
ইচ্ছে হল ঠাকুরমা কে জিজ্ঞাসা করি "আর কি ঠাকুরমা?" কিন্তু আমি কিছু
বলতে পারলাম না। ওনার গলার স্বর শুনে মনে হল শুধু বৌদির মৃত্যুই বেশ ঝাঁকিয়ে
তুলেছে কি উনি বৌদিকেও স্মরণ করেন! না শুধু মাত্র বাচ্চাটা বাঁচলো না তাই আফসোস?
ঠাকুরমার খূব অভ্যেস ছিল উনি সব সময় প্রবাদে কথা বলতেন। কখনো ওনার মুখে শোনা
"বেঁচে থাক ভাই আমার, আর গলি-গলি বৌদি।"
আজ জানি না কেন এই সময়ে এই জিনিসটি মনে পড়ে গেল এবং
আমার মনে অস্থিরতা সঙ্গে কটুতা ভরতে শুরু করছিল। বাহ রে নারী, একজন মহিলার মনে
মহিলার মূল্য অতি সামান্য ... বা মূল্যহীন তাই তো গ্রামে কত নারী বাচ্চা জন্মানোর
সময় মরে। পুরুষদের কোনো ভাবনা নেই এই নিয়ে আর সেখানের নারীদের ও কোনো ফারাক পড়ে
না। চারদিন কান্নাকাটি করবে তারা তারপর দ্বিতীয় বিয়ের জন্য আয়োজন আরম্ভ। এটা কি কম
যে বৌদির কোন ছোটবোন ছিলনা তাই তা না হলে বৌদির বাবাই নিজের ছোট মেয়ের সম্বন্ধ
নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন!
ঠাকুরমা তাই আস্তে-ধীরে বিড়বিড় করলেন "ও বেচারি
দেখবি কি করেছে?" ওনার বুড়ো চোখ দুটি মিচমিচ করে উঠল আর উনি চুপ মেরে গেলেন।
আর জানিনা কি ভাবতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পরে আবার বিড়বিড় করে বললেন, যেন উনি নিজের
সঙ্গে কথা বলছেন। "কুমারিদের ভাগ্যেই তো আয়স্থিরা মরে।"
আমি খুব রেগে গেলাম, অনুভব করলাম মনের প্রতিটি রগে
দাপাদাপি চলছে, ভাগ্য কি, বিট্টুর ভাগ্য আর কি এমন ভাগ্য? কিন্তু আমি কিছুই বললাম
না। আম্মার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। সে কিন্তু নির্বিকার ভাবে শাক কূটছেন। ওনার
মুখের ভাব সর্বক্ষণ একি রকমের। উনি কখন
খুশি বা রাগী বা কতটা রাগী? বুঝতেও পারা যায়না। আমি ঠাকুরমার দিকে একই ভাবে তাকিয়েছিলাম,
আমি অজান্তে অনেকক্ষণ ঠাকুরমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর কেন সে বারবার রেগে যাচ্ছে,
তার উপর? কিন্তু উনার উপর রাগ করেই বা কি হবে? তার পুরো জীবন কেটেছে এই অন্ধকার
গ্রামে, এটাই তার পরম সৌভাগ্য যে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং বিবাহিত নারী হয়েছেন। এর
আগে উনার ইচ্ছা উনার স্বপ্ন, উনার
সুখ-দুঃখের কথা বোঝাটা ওনার আয়ত্বের বাইরের কথা।
হঠাৎ আমি আম্মার দিকে ফিরে তাকালাম উনি তো
বিচার-বুদ্ধি রাখেন ... তাও বাচ্চারা জন্ম নিত ও মরেও যেত যেন উনি বাচ্চা
জন্মদেয়ার মেশিন! বাপ্পার তো বুদ্ধি কম ছিল কিন্তু আম্মা তো কোন অন্য পথ খুঁজতে
পারত। গ্রামের হাসপাতালে নিজেই গিয়ে...
আমার মন আমার নিজের চিন্তায় অস্থির হতে শুরু করেছিল।
পিতামাতাকে নিয়ে বিবেচনা করাটা বা উনাদের জন্য এভাবে ভাবতে ওর নিজের ভাল লাগছিলো
না।
"চন্দরকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা যে আম্মা?"
আমি জিজ্ঞাসা করলাম। আম্মা ঘাড় তুলে মাঠ জুড়ে ছড়ানো ক্ষেতের দিকে তাকালেন। ঠোঁট
একটু নড়ল, কিন্তু কিছু বলল না। ঠাকুরমা একটু বিরক্তিকর ভাবে জবাব দিলেন "বলব
সে কথাও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারছে!" আম্মার নজর সেই দিকেই ছিল আমি
শুধু-শুধু জিজ্ঞাসা করলাম। আমি জানি সে নিশ্চয়ই রুকনদে দে কাকুর ছেলেদের সাথে
কোথাও খেলছে। রৌদ্র-ছায়া, ঝড়ের জল দিয়ে তার কোন ফারাক পড়েনা, এমনকি কারো বকুনি,
ধমক দিয়েও নয়, যেন সে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যখন সে ছোট ছিল তখন সে খুব
সুন্দর ছিল, এক্কেবারে গোল-গাল। এখন দিনরাত রোদ, ধুলোমাটির সাথে খেলার পর ওকে কেমন
যেন লাগে! মুখে তার কোন উজ্জ্বলতা নেই... কথা বলার ধরনও ভালো নয়। আমার মনটা বেশ
ভার হয়ে গেল।
ঠাকুরমা এবং জেঠিমা কিছু বা অন্য বিষয়ে কথা বলছিলেন।
আমি কারো সাথে কথা বলার মুডে ছিলাম না। আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, যদি এরা
ভিতরে চলে যায় তাহলে আমারও উঠে যাওয়া উচিত। ওরা শাক থেকে এক আধটা শাকের পড়ে থাকা
সবুজ পাতা তুলছিলেন। আমিও বেছে নেওয়ার জন্য ঝুঁকলাম। মনে মনে ভাবলাম এই সব শাক তো
আম্মার কেনা নয় সব তো খেত থেকেই আসে তাও আম্মা যেন শাকের ভেতর কি না কি
হীরে-মানিক্য মত এক একটা সবুজ পাতা খুঁজে বার করছিল।
আম্মা ভিতরে এসে চুলায় চা চাপিয়ে দিল। অন্ধকার হওয়ার
আগে, সাতনাম ঘরে প্রদীপ ও বাতি ধরিয়ে দিয়ের চলে গেল। হ্যারিকেন এর কাঁচ ও চিমনি
পরিষ্কার করে প্রত্যেক ঘরে রেখে চলে গেল। এর আগে এই কাজটি আম্মা এবং জেঠিমা দ্বারা
করা হত। এখন দুধের কাজ ভালভাবে চলছিল এবং পশুর জন্য চাকর ও রাখা হয়েছিল এমনকি তখন
থেকে মানুষগুলো হোলি দীপাবলির পাশাপাশি ছোটখাটো গৃহস্থালির কাজ করত। আমি সেখানে
পড়ে থাকা পিড়ির উপর বসে পড়লাম,
"আম্মা তুমি মামাকে এই বিয়ের জন্য মানা করোনি?" আমি খুব আস্তে কণ্ঠে
জিজ্ঞাসা করলাম।
"আমি?" আম্মা আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে
তাকাল। "কি লাভ হত"? এটা করলেও কি ফারাক পড়ত? আম্মা এক দৃষ্টিতে জ্বলন্ত
কাঠের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। "মোহন মনে মনেই সব ঠিকঠাক করে নিয়েছিল।"
রজ্জনকে খুঁজতে ওনাকে বেশি দৌড়ঝাপ করতে হয়নি, সহজেই
পেয়ে গিয়েছিল। যে মানুষের মনে মেয়ে ও মরণাপন্ন বউয়ের জন্য একটুও ব্যথা বা গ্লানি
নেই, সে আমার কথা শুনবে কেন?"
"মামী মানা করেননি?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
পরের ক্ষণেই মনে হল এ আমি কেমন প্রশ্ন করে বসলাম। আম্মা আমায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে
চেয়ে রইলেন "করেনি বলে মনে হচ্ছে তোমায়? সন্তোকে কি আমি চিনি না বলে মনে
করছিস? বললো আমি মেয়েকে ডাক্তার বানাব। এখন দেখো মোহন মেয়ের পড়াশুনা ছাড়িয়ে বিয়ে
দিয়ে দিচ্ছে!"
"আরে! এ আবার কি কথা!" আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে
গেল, কিন্তু আমি কথাটা মাঝখানেই চেপে গেলাম।
সন্তোর মৃত্যুর অপেক্ষা তো করতেই পারতো। বেচারি আর কত
দুঃখ সহ্য করবে? ওরই তো ইচ্ছে ছিল যে মেয়েটি পড়াশুনা করে ডাক্তার হোক! ওর মৃত্যুর
পরে এই কাজগুলি করলেই হত। সন্তো তো আর দেখতে পেত না যে ওরা মেয়েকে গ্রামের বাইরে
তাড়ালো কি কুওয়ায় ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলল। আম্মা গলায় কান্না চেপে বলল। "আমার
বাবা আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমাদের ফেলে রেখেছিল, কিন্তু মোহন..."
আম্মা নিজের কথা মাঝখানেই ছেড়ে দিল বোধহয় সে কথাগুলি
সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন বোধ করেনি।
আমি আগের মতই চুপচাপ বসে আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
"সন্তোর মৃত্যুর অপেক্ষা করে নি!" আম্মা তার
কথার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। ততদিনে মেয়ের হাইস্কুলও হয়ে যেত, কিন্তু না ... তার
তো বেশ তাড়াহুড়োই না লেগে ছিল। আম্মার গলার স্বরে হতাশা বেশ বোঝা যাচ্ছিল।
আমি এইবার জিজ্ঞাসা করলাম যে, ওনার এত তাড়াহুড়ার
কারণটা কি?
আম্মা ব্যঙ্গ করে মুচকি হাসলেন আর বিদ্রূপে উনার
চেহারা কুঁচকে গেল, "কেন রে?" উনি সেই উদাস চোখে আমার দিকে তাকালেন,
এইবার মামা সঙ্গে যদি তোর দেখা হত তাহলে বুঝতে পারতিস!"
আম্মার কোনো কথার তাল আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তক্ষুনি
উনি নিজের কথা সম্পূর্ণ করলেন, বৌএর ক্যানসার হয়েছে, যে কোনোদিন চোখ বুজতে পারে।
ডাক্তারের বলে দিয়েছেন বেশির চেয়ে বেশি দু-চার মাস। আর এদিকে তোমার মামার মুখে
আলোর ছায়া। যখন হাঁটেন তখন মনে হয় উনি লাফাচ্ছেন আর একদম যুবকের মত নিজেকে মনেও
করেন। চুলে কালো রঙ করে বেড়ান। মনে হয় উনি বেশ উতলা হয়ে পড়েছেন।"
আম্মা আমার প্রশ্নের সোজা জীবন না দিয়ে ও নিজের পুরো
কথা বলেই ফেলল। আমার মন উদাস হয়ে উঠল। মোহন মামার বিয়েতে আমি বোধহয় মাত্র এগারো
বছরের পা দিয়েছি। অনেকগুলি দিন - দুনিয়ার কথা বুঝতে শুরু করেছি। মামার বারবার মামির
কাছে হামেশা ঘুর-ঘুর করা, মুচকি হাসি মনে পড়ে গেল। মামী আম্মাকে বলেছিল
"মোহনবাবুকে বোঝাও যে ওর বৌ ওর সঙ্গেই যাবে, আমরা ওকে এখানে ধরে রাখবো না!
নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখে যেন কিন্তু এখানে নয়। এখানে এখন অনেক
আত্মীয়রা ঘর জুড়ে রয়েছে। এই সব পাগলামী ভালো দেখায়না। " আম্মাও মামা কে কিছুই
বলেনি, মামিও না, মোহনমামা আগের মতই নতুন বৌ এর ঘরে ঢুকে থাকত। আশেপাশের লোকেরা এই
নিয়ে কি রটনা গাইছে সেই দিকে মামার কোনো খেয়ালই নেই।
সেইসব কথা মনে পড়ে গেল তাই আরো বেশি বিতৃষ্ণা বোধ
করলাম। ভালোবাসার বাঁধন কি এতোই দুর্বল! যে বউয়ের পেছন ছাড়তেন না সেই বৌ এখন যখন
মৃত্যুশয্যায় উনার সেই দিকে কোনো দায় দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসাও যেন ফুরিয়ে গেছে।
আম্মা যা যা বলছেন সেই কথাগুলো কিন্তু কিছুই ভুল নয়। মনে হল মামা যেন মামির
মৃত্যুর দিন গুনছেন। মামিও তো মামার এই মনভাব ঠিক বুঝছেন। কি করে এই সব বরদাস্ত
করছেন উনি কে জানে? সামনে মৃত্যু, বিট্টুর
বিয়ে আর অন্তিম বিদায় দেওয়ার জন্য তৎপর ও অকৃতজ্ঞ স্বামী।
"এখানের লোকেরাও তো সব বুঝছে?" আমি জিজ্ঞাসা
করলাম।
"হাঁ সবই বুঝছে, বিট্টুর বিয়ের এত তাড়া কেন? ওরাও
জানে যে সন্তোর চোখ বুজতেই সেও নিজের বিয়ে নামাবে।"
"তাহলে?" আমার ভাবতেই অবাক লাগছে।
"তাহলে আবার কি?" আম্মাও প্রশ্ন করল।
"সবাই তো মত দিয়েছে কারুর কোন আপত্তি নেই। তোমার বাবা বলছেন "সব তো ঠিক!
সন্তো তো আজ যায় কি কাল, অসুস্থ তো সে দুই বছর ধরে। মোহন তো সেই দু বছর ধরে
বিধুরের মত জীবন যাপন করছে। "
আমি তো শুনে হতবাক! বাবা এ কথা বলছেন! মুখ দিয়ে ফসকে
গেল কথা।
আম্মা চুপ করে বসেছিল। উনুনে রাখা চায়ের জল ফুটছে।
আম্মা জলে চা পাতা, দুধ ও চিনি দিল। ইচ্ছে হল উনাকে বলি কি জল অনেকক্ষণ ধরেই
ফুটছে, কিন্তু আমি কিছু বলিনি, চুপ করে ছিলাম।
"মামার বয়স কত হবে আম্মা?
"বয়স দিয়ে কি হবে! অনেক বয়স্ক পুরুষ রয়েছে যারা
অবিবাহিত মেয়ে পেয়ে যায়। হবে বিয়াল্লিশ বছরের, কোনো দায়-দায়িত্বও নেই। একটি মেয়ে
ছিল, বার করে দিয়েছে বিয়ে দিয়ে"। আম্মা বেশ গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। এই দেশ
শ্মশান ঘাটেই মেয়ের বাপের মেয়ের সম্বন্ধ নিয়ে পৌঁছে যায়। ওদেরও তো বোঝা মাথা থেকে নামাবার
চিন্তা কুরে-কুরে খায়।" কিছুক্ষণ আগে ঠাকুরমার মুখে সোনা কথা মনে পড়ল,
"কুমারিদের ভাগ্যেই সধবা'র মৃত্যু ঘটে।"
আমার মন বিচলিত হয়ে উঠল। আমি আম্মার দিকে মুখ তুলে
দেখলাম। উনি বেশ কষ্টই পাচ্ছেন কিন্তু হতাশ ও একলা হয়ে পড়েছিলেন। আমি জানি আজকাল
আম্মা বিট্টু কে নিয়ে বেশ চিন্তিত, কিন্তু ওর জীবন নিয়েও নতুন করে নিজের দুঃখের
জীবনকে ভোগ করছিলেন। আমার মনে হল আমি শুধু শুধু মামা ও বিট্টুর কথা তুললাম, আম্মার
কাটা ঘায়ে যেন লবণ পড়ল!
আমি উঠে পড়লাম ও কাছেই রাখা থালা তুলে এক এক করে সবার
চায়ের কাপ তুলে নিলাম। তারপর সহজ ভাবে সব ডিবেগুলির ঢাকনা তুলে তুলে দেখলাম কোথায়
কি রাখা। আম্মাকে প্রশ্ন করলাম "আম্মা খাবারে কিছু আছে? আমি জানি এই বাড়িতে
লাড্ডু বা নিমকি নিশ্চই থাকে। আম্মা মুচকি হেসে বললো "তুই চা নিয়ে যা আমি
চায়ের সঙ্গে খাবার জন্য কিছু নিয়ে আসছি।"
হ্যারিকেনের ঝুলন্ত প্রকাশে আম্মার মুক্তোর মত দাঁত ও
ডান দিকের গালের টোল পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। উনার মুখে থেমে থাকে হাসির আভা বেশ
সুন্দর। মামার কথা হঠাৎ মনে পড়ল "তোর মা খূব সুন্দর ছিল।"
এখন বিট্টুর কথা আর বলবো না আমি নিশ্চিত করে
নিয়েছিলাম। আমি একটি ব্যর্থ আশা মনে মনে জাগিয়ে তুলেছিলাম যে আম্মা সর্বক্ষণ এই
ভাবেই খুশি থাকেন ও উনার মুখে এই মিষ্টি হাসিটিও যেন থাকে।
রাতে আম্মার সঙ্গেই ঘুমালাম। কত বছর পরে এইভাবে আম্মার কাছে ঘুমানো। মনে পড়ছিলো না যে আমি কখন আম্মার কাছে রাতে থেকেছি ও আম্মার সঙ্গে ঘুমিয়েছি। আমি আম্মার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। আম্মার বয়স পঁয়তাল্লিশ। আমাদের স্টাফেদের এবং এই বয়সের শিক্ষিকারা কত ফ্রেশ ও কম বয়সের মনে হয়। কিন্তু আম্মার মুখে এখনো বয়সের ছাপ পড়েনি। কিন্তু সে আম্মাকে ওদের মত কখনো ফ্রেস মনে হয়নি। আমার মন আম্মার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল।
অনেকক্ষণ আমরা দুজনে কথা বলছিলাম, আম্মা বড় মামার কথা
বলছিল, আমি যখন বড় মামার কথা ভাবি বা কথা বলি আম্মা বেশ দুখি হয়ে যায়। মামার
মৃত্যুর পরে আম্মা যেন আরো বেশি একলা হয়ে পড়েছে। আম্মার জন্য মামা একটা বড় সম্বল
ছিলেন। আমার বিয়ে আর আমার সঙ্গে মামা-মামির সম্পর্ক দেখে উনার ভরসা বেশি গভীর হয়ে
গিয়েছিল।
পাসের খাটে আরামে ঘুমন্ত চন্দরকে দেখে আম্মা অস্থির
চোখে দেখে রইলেন। "এর যে কি হবে কে জানে?" আম্মা বেশ ব্যথিত সুরে বললেন।
তোমার ভবিষ্যৎ তো মামা-মামি সুন্দর করে দিল। এতো পড়া, ডাক্তার স্বামী, এতো ভালো
শ্বশুবাড়ি সব উনাদের জন্য।" আম্মার গলা ভিজে গেল। "মা, আমি তো কখনোই এতো
বড় স্বপ্ন দেখি নাই, তোমার বাবা ও না।"
আম্মা মামাদের এতো শ্রদ্ধা করতেন যে আমার বলার জন্য
কিছুই বাকি থাকতো না। আমি আম্মার দিকে তাকালাম উনার চোখ দুটো এখনো ঘুমন্ত চন্দরকে
ঘিরে। এখন চন্দরের বয়স হবে এগারো।
"গ্রামের মেয়ে গ্রাম্য হয়েই থেকে যাবে" তখন
এই কথা আম্মা মামাকে বলেছিলেন। আমি ভাবলাম বোধহয় চন্দরের প্রতিও আম্মার একি
চিন্তা। আজ সকালে আম্মা দুখি হয়ে আমায় বললেন "ওরা অন্য রকমের বাচ্চা হয় যারা
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বসে পড়াশুনা করে, আমাদের চন্দর সেই রকমের বাচ্চা না। "
মনে মনে ভাবলাম আম্মাকে জিজ্ঞাসা করি আমিও তো লাখনৌতেই
থাকি, আম্মা কখনো চন্দরকে আমার কাছে রাখার কথা ভাবেনি। মনে হয় মামার মত আমার উপর
উনি ভরসা করতে পারেননি বা মেয়ের থেকে কোন উপকার নিতে চাননি। কিন্তু চন্দর তো আমার
ছোট ভাই, আমিও তো কখনো ওর কথা ভাবিনি।
আমার কান্না পেয়ে গেল। নিজের অস্তিত্বের কথা ভেবেই
লজ্জায় মরি। এতো বছর নিজের সুখেই আত্মলীন আমি, আমার পি.এইচ .ডি , ভাতখণ্ডে গান,
চাকরি ও কনফারেন্স নিয়ে ব্যস্ত। আরো আরো পাওয়ার সাধ। নিজেকে ছাড়া আর কারুর চিন্তা
নেই। কিন্তু এতো পাওয়ার পরও কি লাভ? আম্মার কত বাচ্চা বাঁচেনি, আমিও না বাঁচলে কি
আর হত! আমি আম্মার মুখের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। সেই আবছা আলোতেও উনার ক্লান্ত
চেহারায় একটি চিন্তার ছায়া দেখতে পেলাম। আম্মার হাতখানি নিজের হাতে নিয়ে বললাম
"আম্মা আমি চন্দরকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে এসেছি। গরমের ছুটির পর
স্কুল খুলবে। এডমিশনের জন্য এখন থেকেই দৌড়ঝাঁপ করতে হবে। টেস্টের প্রস্তুতিও করতে
হবে।"
উনি চমকে উঠলেন, যেন উনি কখনো আমার কাছে এমন
প্রত্যাশাও করেননি। উনার চোখে একটি সংশয় দোলা দিয়ে উঠল।
"জামাই কি বলবে ... আর জিজ্জি?" আম্মা ভয়ে
ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
আম্মা আবার প্রশ্ন করলেন আর আমার দিকে চেয়ে রইলেন।
উনার চোখে এখনো সংশয়। যেন কিছু পেতে পেতে হারিয়ে দিলেন। ভালোই হল আমি যেখানে
বসেছিলাম সেইদিকে বেশ আবছা আবছা আলো ছিল। আমি হেসে উঠলাম। বললাম "আম্মা ওই
ঘরটা আমারও তো!"
আম্মার মুখে ছড়ানো শান্তি দেখে আমার মনে হলো, এই
শান্তি আমি আমার বুকে বেঁধে রাখি আজীবন।
খুব ভালো আর উঁচুদরের গল্প। কিন্তু অনুবাদটি কাঁচা। বাংলা গল্পে আম্মাকে মা লেখা যেত। এত এত উনি, উনার পড়তে বাধে। তিনি তাঁর বা তার শব্দগুলো কি আমরা ভুলে গেলাম? সম্পাদনাও দরকার ছিল। প্রত্যয় বিভক্তিগুলো কোথাও আলগা আছে। বৌ এর লিখলে বৌ-এর লেখা ভালো। এটিও আছে। আবার বৌয়েরও আছে। দ্বিতীয়টিই মানায় ভালো।
উত্তরমুছুন