কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১৪




 

ইতালির পর আজ ফ্রান্স। ইতালির পরেই যে দেশ বিদেশী সিনেমা বিভাগে বেশিবার অস্কার পুরষ্কার পেয়েছে – ১২ বার। কিন্তু ইতালি আর ফ্রান্সের সিনেমার যদি তুলনামূলক আলোচনা করতে হয়, তাহলে প্রথমেই যে কথাটা উঠে আসবে, তা হল, ইতালির সিনেমা সুন্দর, অনুভূতিপ্রবণ কিন্তু ফ্রান্সের ছবি বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল। যার প্রতি ভাঁজে কিছু নতুনত্ব আর মাথার খেলা থাকে। আমাকে যদি ফ্রেঞ্চ ছবির সঙ্গে হলিউড সিনেমার সূক্ষ্ম পার্থক্য জিজ্ঞেস করা হয়, প্রাথমিকভাবে যেটা আমার মাথায় আসবে, তা হল, ফ্রেঞ্চ সিনেমায় চরিত্র, মনস্তত্ব আর পারিপার্শ্ব নিয়ে বেশি গভীরতা থাকে, যা সিনেমার প্লট আরো জমাট করে তোলে। ফ্রান্সের ছবিতে এই জাক্সটাপোজিশন ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য ইতালির পরেই আমাদের আজকের আলোচ্য ফ্রান্সের সিনেমা। তবে আমি এখানে একটা ব্যক্তিগত কথা না বলে থাকতে পারছি না। আপনি যদি পৃথিবীর যে কোন সিনেমাপ্রেমী মানুষকে জিজ্ঞেস করেন, কোন্‌ দেশের ছবি তাকে বেশি টানে, দেখবেন ৭০% উত্তর হবে ফ্রান্স। এবং আমিও, আজ অব্ধি পৃথিবীর যে দেশের  সিনেমা সব থেকে বেশি দেখেছি, সেটা ফ্রান্স। 

যাইহোক, প্রাথমিকভাবে ফ্রান্সের কিছু সিনেমা বেছে নেওয়া যাক। ইতালির ঠিক উল্টো সংখ্যায় বাছি। ২১। ড্রেয়ারের ‘প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক’  (১৯২৭), ভিগোর ‘লা’তালান্তে’ (১৯৩৪), রেনোয়ার ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’ (১৯৩৭) এবং ‘রুলস অব দ্য গেম’ (১৯৩৯), ককতোর ‘অর্ফিয়াস’ (১৯৫০), ক্লুজোর ‘দ্য ওয়েজেস অব ফিয়ার’ (১৯৫৩), ম্যাথু ক্যসোভিজের ‘লা হাইন’ (১৯৫৫), রেনের ‘হিরোশিমা মাই লাভ’ (১৯৫৯), ত্রুফোর ‘দ্য 400 ব্লোজ’ (১৯৫৯), গোদারের ‘ব্রেথলেস’ (১৯৬০) এবং ‘কনটেম্পট্‌’ (১৯৬৩), মার্কারের ‘লা জেটি’ (১৯৬২), জ্যাক ডেমির ‘দ্য আমব্রেলাজ অব চেরবার্গ’ (১৯৬৪), ব্রেসোঁর ‘ও হাসার বালথাজার’ (১৯৬৬), জ্যাক তাঁতির ‘মাই আঙ্কল’ (১৯৫৮) এবং ‘প্লে টাইম’ (১৯৬৫), ল্যাঞ্জম্যানের ‘শোয়া’ (১৯৮৫), জুনেটের ‘আমেলি’ (২০০১), দাহানের ‘লা ভাই এন রোজ’ (২০০৭), হেনেকের ‘আমোর’ (২০১২) এবং আব্দেল্লাতিফ কেচিচের ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার’ (২০১৩)।

আজ কিন্তু উল্টো ইতিহাস দিয়ে শুরু করব। প্রথমেই ধরব একদম সাম্প্রতিক ছবি। আব্দেল্লাতিফ কেচিচের সাহসী ছবি ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার’। নিখাদ এক লেসবিয়ান সম্পর্ক নিয়ে সিনেমা। দুই প্রাণোচ্ছল তরুণী ও কিশোরীর, লিয়া  ও আদেল, খোলামেলা যৌনজীবন নিয়ে সিনেমা। এর মাঝে কিশোরী আদেলের স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজ এবং চাকরী জীবন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের যৌন জীবনের পরিণতি।

১৫ বছরের স্কুল কিশোরী আদেল। একদিন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে সে ছোট নীল চুলের অধিকারী যুবতী লিয়াকে দেখে। এবং তার মনে লিয়ার প্রতি, লিয়ার নীল চুলের প্রতি আকর্ষণ জাগে। আকর্ষণ বেড়ে চলে। স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে সে  যৌনতা উপভোগ করতে পারে না। একদিন এক লেসবিয়ান ডান্স বারে গিয়ে লিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। লিয়া এই সিনেমায় আর্ট গ্র্যাজুয়েট। খোলামেলা জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। দুজনের সম্পর্ক নিবিড় হয়। লিয়ার পরিবার তাদের সম্পর্ক নিয়ে আপত্তি করে না, কিন্তু আদেলের পরিবার রক্ষণশীল। তাই আদেল নিজের  পরিবারের কাছে লিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক জানাতে পারে না। বলে, লিয়া তার ফিলসফি ক্লাসের টিউটর। এরপর সময় গড়ায়। আদেল ১৮ বছরের যুবতী হয়। ক্যামেরায় আমরা তখন লিয়াকে তার জীবনে আর দেখতে পাই না। আদেল স্কুল টিচারের চাকরি নেয়। এক আর্ট গ্যালারিতে আবার দুজনের দেখা হয়। আবার সম্পর্কের টানাপোড়েন। ইতিমধ্যে লিয়ার সঙ্গে আরেক মহিলার লেসবিয়ান সম্পর্ক শুরু হয়েছে। শেষদিকে আমরা দেখতে পাই আদেল তার একাকীত্ব লুকিয়ে লিয়ার জীবন থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।

এই সিনেমায় ভরপুর সেক্সুয়ালিটি আছে, কিন্তু তার সাথে সমাজের শ্রেণীবিভাগ ব্যাপারটাও সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একইসঙ্গে দুজন মহিলা চরিত্রের  স্বাধীনতা ও ইচ্ছের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সামাজিক শ্রেণীবিভাগের অঙ্গ হিসেবে খাবার কীরকম হয়, কীভাবে আলাদা হয়, সেটাও যথাযথ। খাবার এখানে একটা সিম্বল। যেমন নীল চুল। পিকাসো বা ভ্যান গগ, এই রং সিম্বল হিসেবে তুলে ধরেছেন। সেই কলা এখানেও। নীল যেখানে মানসিক সম্পর্ক তৈরি করছে, ভালবাসা শেখাচ্ছে, আবার দূরত্বও তৈরি করছে। যথেষ্ট সাহসী ছবি।

কিন্তু এই সিনেমার আসল কাজ লুকিয়ে ক্যামেরায়। আর সেজন্য এটা আমার প্রিয় ছবি। কেচিচ ক্যামেরায় কখনোই নিজের বাহাদুরি দেখাতে চান নি, উল্টে চেয়েছেন যে দর্শক যেন ছবির চরিত্রগুলোয় মিশে যেতে পারে। ফলে ক্যামেরা বেশির ভাগ সময়েই মুখের খুব কাছাকাছি। মুখের শিরা উপশিরাগুলোও যাতে বোঝা যায়। ক্লোজ শট, ক্যামেরা ডায়নামিক, ভার্টিকাল, অবজেক্টকে আলাদা করে বোঝানো হচ্ছে। সেটা ভালবাসার সিন হোক বা আর্ট গ্যালারি বা বা ব্রেক-আপ। পেছনে মিউজিক আর আলোর ব্যবহার।

এই অব্ধি পড়ে আমার পাঠক-পাঠিকা যদি ভেবে থাকেন যে, এই রে, অভিজিৎ মিত্র দুজন সুন্দরী ভরন্ত ফ্রেঞ্চ যুবতীকে দেখে লোভ সামলাতে না পেরে একটা সফট্‌ পর্ণ নিয়ে এত ভাল ভাল কথা বলে গেল, তাহলে ভুল করবেন। কমল চক্রবর্তীর প্রতিকবিতা ভুলবেন না – ‘আরও কালো পিস্তলের দৃঢ়তম নল স্তনে চেপে/ যুবতীরা সমুদ্রে নেমেছে’। এই সিনেমা ২০১৩ সালে কান ফিল্ম  ফেস্টিভালে ‘গোল্ডেন পাম’ পুরষ্কার পেয়েছিল। গোল্ডেন গ্লোব আর বাফটার জন্যও মনোনয়ন পেয়েছিল। বাঘা সমালোচকরা মন্তব্য করেছিলেন, এই সিনেমা ২০১৩-য় বানানো প্রথম দশ সিনেমার ভেতর একটা। একবার দেখতে পারেন, এই সাহসী ছবি কোনভাবে আপনাদের মাথায় ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ব দিয়ে ঘা দেয় কিনা।  

এরপর বেছে নেব দুটো খ্যাতনামা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ সিনেমা – ফ্রঁসোয়া ত্রুফোর ‘দ্য 400 ব্লোজ’ এবং জাঁ-লুক গোদারের ‘ব্রেথলেস’। এই দুটোই পৃথিবীর প্রথম ২০ ক্লাসিক সিনেমার ভেতর সবসময় থাকবে।

ত্রুফোর ‘দ্য 400 ব্লোজ’ (১৯৫৯) আলোচনা করার আগে আমি পাঠককে এক বাংলা সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেব। এই সিরিজের ৮ নম্বর পর্বে তার উল্লেখ করেছিলাম মাত্র। ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৫৮)। আট বছরের এক ছেলে বাবার শাসনে ভয় পেয়ে গ্রাম থেকে কলকাতা পালিয়ে যায়। সেখানে অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে সে জীবন সম্বন্ধে নতুন করে অনুভব করে, বোঝে যে বাবার শাসন তার ভালর জন্যই। সে আবার বাড়ি ফিরে আসে। এই হল ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। উল্টোদিকে ‘দ্য 400 ব্লোজ’এর বেশ কয়েক ধাপ ওপরের মনস্তত্ত্ব  নিয়ে তৈরি। আটোয়ান এক ১৩ বছরের বখাটে ছোঁড়া। স্কুলে অনেক ধরনের বদমাশি করে বেড়ায়। রোজ তার বাড়িতে রিপোর্ট হয়। একদিন সে স্কুল থেকে পালায়। পালানোর আগে সে সঙ্গে তার সৎ-বাবার দামি টাইপরাইটারটা নিয়ে নেয়। কিন্তু কোথাও বেচতে পারে না। বাধ্য হয়ে সে যখন আবার তার সৎ-বাবাকে সেই টাইপরাইটার ফেরৎ দিতে আসে, তার সৎ-বাবা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আটোয়ান গোটা রাত পুলিশ হেফাজতে কাটায় আরো অনেক চোর, ডাকাত, বেশ্যার সঙ্গে। পরেরদিন কোর্টের নির্দেশে তাকে কারেকশনাল হোমে নিয়ে চলে যাওয়া হয়। এই নতুন আস্তানা সমুদ্রের একদম ধারে। সেখানে আটোয়ানের মতই আরো অনেকে আছে। একদিন খেলার সময় আটোয়ান সেই হোম ছেড়েও পালায়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় আটোয়ান সমুদ্রের ধারে নিজের ইচ্ছেমত চলাফেরা করছে।

দুটো ছবিতেই দুই বালক নিজের মত করে স্বাধীনতা খুঁজে নিতে চাইছে। কিন্তু ত্রুফোর ছবি অনেক গভীরে। তার ছবির কিশোর জেলে সময় কাটিয়ে সাবালক হয়ে উঠছে। হোমে গিয়েও নিজের মত পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। অনবদ্য থিম। ক্যামেরার কাজ বেশ ভাল। এখানে ক্যামেরায় বন্দী বয়ঃসন্ধীর এক কিশোরের মনস্তত্ব – যার জীবনের প্রতি দিন, প্রতি ঘটনা এক ট্র্যাজেডি। এই সিনেমা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ সিনেমার এমন এক ছবি যেখানে ‘ক্যামেরা অ্যাজ পেন’ নীতিতে বিশ্বাস রাখা হত। এই ছবি যেন ছত্রে ছত্রে ত্রুফোর নিজের কৈশোরের কথা, একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। সিনেমার দৃষ্টিকোণ একটাই – আটোয়ানের চোখে চোখ রেখে ছবি এগোবে। সিনের আবহেও সেই স্কুলছুট ছেলেটিই ফ্রেম হয়ে ওঠে। ছেলেটিকে ফোকাস করে গল্প যখন সময়ের তালে তাল না রেখে আগে-পরে ঘোরে এবং কোন এক সিনের মনস্তত্ব বোঝাতে ত্রুফো জুম করে হঠাৎ ফ্রেম ফ্রিজ করে দেন (পরবর্তীতে এই টেকনিক খুব জনপ্রিয় হয়), সেখান থেকে এই ছবি সাধারণ হয়েও অসাধারণ হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, এই ছবির ঘরে এত প্রাইজ যে  সেগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করা যাবে না।   

পরের ছবি গোদারের ‘ব্রেথলেস’ বা ‘আউট অব ব্রিদ’। ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ  সিনেমার আরেক গুরুত্বপূর্ণ ছবি। এক অপরাধী মাইকেলের ওপর এই সিনেমা।  মাইকেল একটা গাড়ি চুরি করতে গিয়ে একজন পুলিশকে গুলি করে মেরে ফেলে। পুলিশের তাড়া খেয়ে মাইকেল তার প্রেমিকা প্যাট্রিসিয়ার ফ্ল্যাটে এসে লুকিয়ে পড়ে। প্যাট্রিসিয়া এক হবু সাংবাদিক এবং সে প্যারিসের গলিতে গলিতে তার ম্যাগাজিন বিক্রি করে বেড়ায়। ফ্ল্যাটে দুজনের রোমান্সের সঙ্গে সঙ্গে মাইকেল প্যাট্রিসিয়াকে নিয়ে ইতালি পালিয়ে যাবার প্ল্যান করে। কিন্তু মেয়েটি তাতে সায় দেয় না কারণ সে গর্ভবতী। শেষে সে যখন মাইকেলের কুকীর্তির  ব্যাপারে জানতে পারে, সে মাইকেলকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। পুলিশ তাকে ধাওয়া করে রাস্তায় গুলি করে। শেষ দৃশ্যে মাইকেল ‘আউট অব ব্রিদ’ হয়ে তার প্রেমিকাকে গালমন্দ করতে করতে মারা যায়। অবশ্য এই সিন নিয়ে একটু ধন্ধ আছে।

কোন কোন দার্শনিক এই সিনেমার থিম নিৎসের ‘নিহিলিজ’-এর সঙ্গে মিলিয়েছেন। নিহিলিজম এক অসামঞ্জস্য, যেখানে আমরা কাকে বা কোন্‌ বিষয়কে গুরুত্ব দিই আর পৃথিবী সেই গুরুত্বের বাইরে কীভাবে নিজের মত বয়ে  চলে, সেই নিয়ে আমাদের ভেতরের টানাপোড়েন। এই সিনেমার অনুসরণে পরবর্তীতে অনেক ছবি বানানো হয়েছে। সিনেমার মূলে অপরাধ দেখানো হয়েছে। কিন্তু ব্রেথলেস সবার থেকে আলাদা। এর ফ্রি স্টাইল, এক ঝলক নতুন হাওয়া, প্রতি ফ্রেমে স্পেস তৈরি করা, জীবনের গতি, এমনকি অপরাধের মাঝেও রোমান্টিক কমেডির উপাদান – সব মিলিয়ে গোদার এই ছবিতে নিজের এমন এক শৈলি তৈরি করেছেন যা অননুকরণীয়।   

এবং এই সিনেমায় দেখার মত ক্যামেরার কাজ হল জাম্প-কাট। সাহসী পদক্ষেপ। এই সিনেমাতেই প্রথম জাম্প-কাট এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল যে সেটা জনপ্রিয়তা লাভ করে। কী এই জাম্প-কাট? ধরুন একটা গোটা সিন,  বেশ বড়। সেটাকে আপনি কেটে তিন-চার টুকরো করলেন। এবার সিনে থেকে সিনে যাবার সময় খানিকটা অংশ ইচ্ছে করে বাদ দিলেন। কিন্তু ক্যামেরার জায়গা বিশেষ বদলালেন না। উদ্দেশ্য – এক, সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলা, এবং  দুই, দর্শকের চিন্তাশক্তির ওপর খানিকটা ছেড়ে দেওয়া। এবার ব্রেথলেস-এ আসুন। সেই বিখ্যাত সিন। প্যারিসের রাস্তায় প্যাট্রিসিয়া ‘নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন’ বিক্রি করছে। এক লং আনকাট শট। তারপর মাইকেল আর  প্যাট্রিসিয়ার গাড়িতে চড়ে ঘোরা। সেখানে পরপর জাম্প-কাট। এত কাছাকাছি যে আপনাকে ভাবতে হবে কোথা থেকে কী হল। এটাই তারুণ্যের প্রাণশক্তির প্রতীক গোদার এবং তার ‘ব্রেথলেস’।    

সবশেষে বাছব নিউ ওয়েভ সিনেমার অনেক আগের এক ক্লাসিক ছবি। জাঁ ভিগোর ‘লা’তালান্তে’। অদ্ভুত গল্প, অন্তত সেই সময়ের প্রেক্ষিতে। এক জাহাজের ক্যাপ্টেন জাঁ তার প্রেমিকা জুলিয়েটকে বিয়ে করে সোজা নিয়ে হাজির করে নিজের জাহাজে। জাহাজ বয়ে চলে প্যারিসের উদ্দেশ্যে। জাহাজের আরো দুজন কেবিন বয় মহিলাসঙ্গ কখনো পায় নি। ফলে তারা জুলিয়েটকে দেখে মাঝে মাঝে অদ্ভুত আচরণ করে, কিন্তু সবকিছুর মাঝেও জাহাজ বয়ে চলে এবং জাঁ ও  জুলিয়েটের হানিমুন চলতে থাকে। অবশ্য জাঁ চরিত্রটা মোটেও সোজা নয়, সে খুব পোসেসিভ এবং রাগী গোঁয়ার। একদিন জুলিয়েটকে এক কেবিন বয়ের সঙ্গে  গল্প করতে দেখে রেগে সেই কেবিন বয়কে অনেক বেশি কাজ দিতে শুরু করে। এরপর প্যারিস এলে তারা প্যারিসের রাত্রিকালীন জীবন দেখার জন্য এক ডান্স হলে যায়। সেখানে এক পথচলতি যুবক জুলিয়েটের সঙ্গে নাচতে চায়। সেই নিয়ে জাঁ-র সঙ্গে সেই যুবকের হাতাহাতি হয়। জাঁ জুলিয়েটকে জোর করে জাহাজে নিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু প্যারিসের ঝলমলে রাত্তির দেখার জন্য জুলিয়েট জাহাজ থেকে পালিয়ে এসে দোকানের বাইরে উইন্ডো শপিং শুরু করে। এদিকে জাঁ যখন জানতে পারে যে জুলিয়েট জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে, সে রাগের বশে প্যারিস ছেড়ে জাহাজ নিয়ে চলে যায়। জুলিয়েট ফিরে এসে বন্দরে জাহাজ দেখতে না পেয়ে মনের দুঃখে এক চাকরি ধরে যাতে সে টাকা জমিয়ে জাহাজের পরের লক্ষ্য অব্ধি পৌঁছতে পারে। এদিকে জুলিয়েটকে ছেড়ে এসে জাঁ ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করে। অবশেষে সেই কেবিন বয় জুলিয়েটকে খুঁজে আনে এবং জাঁ-জুলিয়েট যুগলের আবার মিলন হয়।

হয়ত এরকম হ্যাপি এন্ডিং পুরো সিনেমার সাহসী প্লট খানিকটা হলেও নষ্ট করেছে, কিন্তু আজ থেকে ৮৭-৮৮ বছর আগে দর্শকরা হলে যেত নায়ক নায়িকার মিলন দেখতে, অন্য কোন রকম শেষ দেখতে নয়। সে কারণেই কম্প্রোমাইজ। সে যাইহোক, এই সিনেমা বাছার কয়েকটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।  প্রথমত, এই সিনেমা ভিগো বানিয়েছিলেন মাত্র ২৯ বছর বয়সে। এবং এটাই ছিল তাঁর শেষ ছবি। ছবি বানানোর সময় উনি টিউবারকিউলোসিসে ভুগছিলেন।  সেখান থেকে আর সেরে ওঠেন নি। উনি ১৯৩৪-এই মারা যান। দ্বিতীয়ত, এই সিনেমায় উনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন কাব্যিক বাস্তবতা, যা নব্য বাস্তব ফ্রেঞ্চ সিনেমাকে ৫০-৬০-এর দশকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তৃতীয়ত, এই সিনেমা কোন সাহিত্য থেকে নেওয়া হয় নি, ভিগো নিজে লিখেছিলেন। চতুর্থত, এই সিনেমা ১৯৩৪-এ রিলিজ হবার পর বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কিন্তু ৫০-এর নব্য বাস্তবতা শুরু হবার পর এই সিনেমা গোটা পৃথিবীর এক ক্লাসিকে পরিণত হয়। সবাই একে একে স্বীকার করেন যে সেই যুগের তুলনায় এরকম  প্লট অনেক এগিয়ে থাকা প্লট এবং অরিজিনাল।

লা’তালান্তে দেখে মনে হয়েছিল এক সহজ কিন্তু বিমূর্ত কবিতা দেখছি। যে সিনেমা দেখে কিশোর বয়সে ত্রুফো-ও এই সিনেমার প্রেমে পড়েছিলেন। এই সিনেমা দেখে মনে পড়ে জন কিট্‌সের কবিতা ‘To Autumn’ – ‘Where are the songs of Spring? Ay, where are they?/ Think not of them, thou hast thy music too –’। সত্যি, অসাধারণ সব ছবির ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমের এক  সহজ সাহসী প্লট, যার নিজস্ব সঙ্গীত কানে বাজতে বাধ্য। এবং আশ্চর্য, ভিগো আর কিট্‌স, দুজনেই মারা গেছিলেন টিউবারকিউলোসিসে, একজন ২৯, অন্যজন ২৫। যদি এরা দুজনেই আরো অন্তত ৩০ বছর বাঁচতেন, তাহলে সিনেমা আর সাহিত্যর ইতিহাস আরেকটু বদলাতো। 

তাহলে সোজা ইতিহাস কী বলছে? সেই ১৯৩৪ সালে যে সাহসী চিত্রনাট্যর বীজ  নিয়ে এসেছিল ভিগোর লা’তালান্তে, সেটা আস্তে আস্তে সৌন্দর্যের সঙ্গে ফুটে উঠেছে ৫৯-৬০-এ নিউ ওয়েভ সিনেমায়, আর সেই গাছ মহীরূহ হয়েছে ২০১৩-র ব্লু-তে। এবার বুঝলেন, কেন ফ্রেঞ্চ সিনেমাকে বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল বলা হয়?

শেষ করার আগে সিনেমাপ্রেমী পাঠকের জন্য আগের বারের মতই এক সবিনয় পরামর্শ। সময় করে গোদারের ‘হিস্ট্রি অব সিনেমা’ (১৯৮০-৯৮) সিরিজ দেখুন। মোট ৮ টা ভিডিও। ২৬৬ মিনিট। সিনেমার ধারণা ও তার বিবর্তন নিয়ে ভাবনা চিন্তার অনেক খোরাক পাবেন।  

 


1 কমেন্টস্: