সমকালীন ছোটগল্প |
ডিপ্রেসন
কলেজের চওড়া করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছিলো
দুজনে। অন্যমনস্ক। একদম মুখোমুখি ধাক্কা। হাতে ধরা বইগুলো ছিটকে পায়ের কাছে। দারুণ
চমকে বই তুলতে দুজনেই নিচু হয়েছে… সেভাবেই
দুজনে দুজনের দিকে প্রায় এক মিনিট চোখে-চোখে… ফ্রিজসর্ট… টি.ভি. সিরিয়াল বা সিনেমার মতো অবধারিত প্রেম প্রেম
চোখে একটা ‘এক্সট্রিমলি স্যরি’ বা ‘প্লিজ এক্সকিউজ মি’… উহুঁ! দুজনের কেউই সেরকম কিচ্ছু
বলেনি। একদম সেরকম কিচ্ছু হয়নি…
দুজনেই করিডোর ধরে হাঁটছিলো। একজন লাইব্রেরির
দিকে। আরেকজন ক্লাসের দিকে। কারুরই হাঁটার দিকে চোখ ও মন ছিলো না। কেন? আরে আপনি কি
জানেন না, এই ইউনিভার্সে একই সময়ে কত লক্ষ মানুষ একই সাথে ডিপ্রেসনে রিপ্রেসনে ইন্ডাইজেসনে,
অরণ্যে রোদনে, ফল অর ফেলিওর ইন লাভে… অন্যমনস্ক…
থাকতেই পারে। ধরাযাক একজনের নাম শুক্লা, আরেকজন শুভ্র। চরিত্রদুটি যে বিপরীত সেক্সের
হতে হবে এমন কথা নয়। তবে এক্ষেত্রে হয়েছে।
কুড়ি-একুশেরা কিসের জন্য আনমনা হতে পারে!
সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে পরীক্ষার রেজাল্টে হতাশা, প্রেমে পড়া, প্রেমে ভুল বোঝাবুঝি,
সদ্য শেষ হওয়া ক্লাসে স্যার বা ম্যাডামের পড়ানোর মুগ্ধতার রেশ…
পারের কড়ি গুনতে গুনতে কতকাল যে চলে
যায়, মৃত্যু হয় না শুভ্রার প্যারালাইজড মায়ের। হাসপাতালের বিল বিশাল হতে থাকে শুধু।
তার মধ্যেই হঠাৎ মারা যান ওর বাবা। প্রতিষ্টিত ইনজিনীয়র, খরুচে, আরও বছর কুড়ি চাকরিতে
বহাল থাকার মতো নিশ্চিন্ত বাবা শুক্লার। ওঁর ক্ষেত্রে যখন খুশি বিনা নোটিশে বন্ধ হওয়ার
হার্ট মজা দেখেছে। অর্থাগমের অনিশ্চয়তা, পড়াশোনা চালিয়ে যাবার বিপন্নতা, খরুচে বাবার
জমার ঘরে গাফিলতির চিহ্ন, এম.বি.এ. পড়বার বিপুলবপু কাঞ্চনমহিমার পথে চিরকালের মতো ফুলস্টপের
নিষ্ঠুর বাজনা অহোরহ শুনতে পাওয়া, শুক্লার
অন্যমনস্কতার যথেষ্ট কারণ হতেই পারে! শুভ্র
নাম দেওয়া ছেলেটার ক্ষেত্রেও অনুরূপ কিছু কারণ তাকে চিন্তান্বিত করেছিল হয়তো! কিংবা
হতেও পারে ক্লাসের অন্যতম সেরা ঝকঝকে মেয়েটির বিমর্ষ মুখ তাকে মুহূর্তের জন্য চিন্তায়
ফেলেছিলো! চিন্তাজনিত অন্যমনস্কতা! হয়তো মনে মনে ও শুভ্রার প্রতি আকৃষ্ট ছিলো। ভেবেছিলো আজকেই,
ওর এই বিপন্ন প্রহরেই শুভ্র মেয়েটির কাছে নিজের মনের কথা ভাষায় মেলে ধরবে! শুক্লার
বিপুল আনমনার চিন্তামেঘকে সরিয়ে দিতে ওর সঙ্গে একসাথে লড়াই করবে। ওর পিতৃবিয়োগের কথা
শুনেছে শুভ্র।
মেয়েটা একটা কথাও বলেনি ওকে। কোনো অনুযোগ
করেনি। শুধু নিচু হয়েছিল বইখাতাগুলো কুড়িয়ে তুলতে। যেন ভেবেছিলো এটাই ওর বিধিলিপি।
এসব ওর হাতে আর থাকবে না। কোনোভাবেই ধরে রাখা যাবে না এগুলোকে তার পড়ার টেবিলে।
সেও সরি বা ওইরকম কিছুই বলতে পারেনি।
শুধু বইখাতাগুলো শুক্লার হাতে তুলে দিয়ে একটুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো।
খুব কষ্ট হচ্ছিলো শুভ্রর। পড়াশোনার নিমগ্নতা
ছিঁড়ে দিয়ে বারবার বেরিয়ে আসছিলো সেই কষ্ট। এরকম কষ্ট আগে তো কোনোদিন হয়নি ওর! একবার
যদি মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে দেখতো মেয়েটার জন্য ওর চোখে কী লেখা আছে, তাহলে বুঝি এত
কষ্ট হতো না শুভ্রর। কষ্টটা বলছে একটা কথাও কি বলতে পারতো না মেয়েটা ওকে! কোনো মেয়েসুলভ অহমিকা!
তাও না! কেন! তবে কি ওর বাড়িতে বা যাপনে কোনো ভুকম্পন মেয়েটার সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে!
মেয়েটা, রাদার মেয়েটার নিরুত্তাপ নির্বাক
সত্তা এখন শুভ্রর পুরো স্টাডি-আওয়ারটা ছিনিয়ে নিয়েছে। কী করবে শুভ্র!
-
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন