কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

শতাব্দী দাশ

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০২


শূন্যপুর ১০

 

দূর থেকে উর্দি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়ে প্রভাকর। বুক জোরে ওঠাপড়া  করে। ধুকপুকানি চেপে এগোয় সাইকেল গড়িয়ে। যদি শুনে ফ্যালে ওরা... সন্দেহ করবে না? ভয় কেন? উতরে যায়নি কি সে এবারের মতো? লিস্টিতে নাম ছিল তার। মায়ের ছিল না। এমন ঘটছে আকছার। তবু যদি আবার কেস দেয়!  ছুটোছুটি, উকিল, কাগজ-নথি… একে মায়ের জন্য হ্যাপার শেষ নাই। ঝামেলি চায় কে?

সাইকেলে চাপানো প্লাস্টিকের রকমারি মাল। ঝুড়ি, ট্রে, কাপ, সাবানকেস, মগ, পিঠ-চুলকানো-হাত… সাইকেলের পানেই চোখ উর্দিদের। 'হেই রুক্!'

দু'পা গেলে স্টেশন। মাল গুছিয়ে দশটা তেইশ ধরতে পারলে বেচাকেনা হত। কিন্তু দম-ফুরানো প্লাস্টিক বাঁদরের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে প্রভাকর। উর্দি-এক লাল, নীল, সবুজ মগ নেড়ে-চেড়ে দেখে। উর্দি-দুই হ্যান্ডেলের ফাঁক থেকে প্লাস্টিক হাত বের করে নেয়। উর্দি-তিনের পিঠ চুলকে দিয়ে রগড় করে। প্রভাকর সিং, কৃষ্ণ সিং-এর প্রমাণিত পুত্র ও দেশের বৈধ নাগরিক, দরদরিয়ে ঘামে।

মগ পছন্দ হল। উর্দি-এক চোখে কৌতুক নাচিয়ে উর্দি-দুইকে বলে, 'পিছওয়াড় ধোনে কে লিয়ে।' হো হো হেসে ওঠে তিনজন। উর্দি-তিন বলে, 'মুঝে লগা, রাতকো তেরা পাতিয়ালা পেগ বনেগা ইসমে।' পাহাড়তলে ছোট স্টেশনচত্বরে কাঁপ ধরায় ওদের হাসি।

উর্দিদের একে অন্যের থেকে আলাদা করতে পারে না প্রভাকর। চোখ ধোঁয়া হয়ে আসে বলে? দুবছর আগে, স্টেশন-বাজারের গুমটিটায় তালা পড়ল৷ সবজি-ভাত পঞ্চাশ। মাছের থালা আশি। চিকেন একশ কুড়ি। ময়না উনুনে আঁচ দিয়ে একা হাতে বাজার করত ভোর-ভোর। আসত দোকানদার, রিক্সাওয়ালা, বাজারফেরত  সবজিওয়ালা। তারপর একদিন উর্দিরা এল।

প্রভাকর চেয়ার ঝেড়ে সালাম ঠুকেছিল। ডিমা হাসাও জেলার যেদিকে মণিপুর আর অরুণাচল, সেদিকের পাহাড়ে ওরা টহল দেয়। মাঝে মাঝে বাজারে আসে। মাছ-মাংস খেলো জমিয়ে। বিয়ার এনে দিল প্রভাকর দোকান খুলিয়ে। মৌরি  এগিয়ে দিয়ে, মা টাকা চাইল। বাপ মরার পর, সর্বস্বান্ত হয়ে দেওয়া মায়ের নতুন গুমটি। ময়না জানত না, উর্দিদের কাছে টাকা চাইতে নেই।

ওরা দোকানেই কাগজ দেখতে চাইল। খদ্দেররা মজা পেয়েছে। ভিনভাষীদের শায়েস্তা হওয়া দরকার নয় কি? ময়না মিইয়ে গেছিল। 'কাগজ দোকানে কেন রাখব বাবু?'

প্রভাকর একজোড়া বুট জাপটে ধরেছিল। লাথির চোটে ছিটকে গেল টেবিল নম্বর চারের কোণে।

একমাসের মাথায় নোটিস। হাফলং-এর হরিদেব দাস যে ময়নারই পিতা, তার প্রমাণ কী? দাস না সিং, কী নামে তার ভোটার কার্ড ও কেন? সব গুলিয়ে যেতে লাগল।

ওরা চলে যাচ্ছে। পয়সা চায়নি প্রভাকর। হাত থেকে হাতে চালান হচ্ছে গোটা তিনেক মগ, খান দুই প্লাস্টিক হাত, সাবান-কেস, চিরুনি। পা দুটো মাটিতে গেড়ে আছে। মা দুবছর হল ক্যাম্পে। মাল ফিরি করলে উকিলের টাকা ওঠে। মালগুলো গুছিয়ে থরে থরে ঝোলানো দরকার কাঁধের ভারায়। ট্রেনের ঘোষণা হল। চলচ্ছক্তিহীন সাইকেল, প্লাস্টিকের বোঝা কাঁধে, তখনও দাঁড়িয়ে। গর্জন করতে করতে ট্রেন এগিয়ে গেল প্রভাকরকে ফেলে। যন্ত্রের গর্জনে হু হু কান্না কি চাপা পড়বে না কিশোরের?

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন