কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৯

সুবীর সরকার




উত্তরকথা




(৬৪)


উড়ে যাওয়া মেঘের দিকে সে তাকিয়ে থাকে। তাকে তাকিয়েই থাকতে হয়। এ এক বাধ্যবাধকতা। মেঘেদের উড়ে যাওয়া আশ্চর্য এক দৃশ্যের ঘোর তৈরী করে। দৃশ্যের পর দৃশ্য জুড়ে দৃশ্যময়তা মায়াবী গোধূলির ধরতাই এর কিনারে, প্রান্তে চিরন্তনতার আবহলিখন হয়ে উঠতে থাকে। এইসব ছড়ানো মেঘের যৌথ উড়াল ঘিরে তার মধ্যে কিছু সংশয়ও সঞ্চারিত হতে থাকে। কেউ কি বলতে পারে মেঘেরা কোথায় যায়। নাকি মেঘেরা লুকিয়ে পড়ে মেঘেরই ভিতর। সে ক্রমে যেন সংশয়তাড়িত এক মানুষ হয়ে উঠতে থাকে।তার স্মৃতিকেই সে তীব্রতায় জাগরুক করতে চায়। সমগ্র শরীরে ফুটিয়ে তুলতে চায় আশা ও আকাঙ্ক্ষাদৃশ্যতই পুরনো স্মৃতিতে ফিরে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিতেই সে আত্মসম্মোহনে তাড়িত হতে থাকে। উড়ে যাওয়া মেঘসকল দেশকাল পেরিয়ে চলে যেতে থাকে নুতন কোন দেশখন্ডের দিকে। ভয়াবহ কোন অরণ্যভূমির ভিতর তার স্মৃতি প্রবেশ করলেই চারপাশে যেন বেজে ওঠে বরাহের আর্তনাদ সেতারের মতো। হাতির পাল দেখে হরিণেরা দৌড়ে বেড়ায়। গাছের আরো নিরাপত্তায় হায়না ও চিতাবাঘ আত্মগোপন করে। অরণ্যভূমির মধ্যস্থলে জল জলা বিষধর সর্পকুল। স্মৃতিতাড়িত হতে হতে সে দেখে ঘন নিশীথকালে পিঠে ডানা গুঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সন্নাসীঠাকুর। ঠাকুরের চারপাশে শীতল বাতাসের ঝাপট। প্রতি রাতে এভাবেই তো নিজের রাজপাটে টহল দেন সন্নাসীঠাকুর। সন্নাসীঠাকুরের পরিচিতি ডিঙিয়ে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ভবানী পাঠকই তো লোকমিথ বদলাতে বদলাতে দূরে সরে যাওয়া নদীদের মতো বন্দনাগান হয়ে উঠতে থাকেন। সন্নাসীঠাকুরের সত্যতা যাচাইয়ের প্রকৃত বৈধ পথপদ্ধতি না থাকলেও সন্নাসীঠাকুর অদৃশ্য থেকে শেষাবধি ভবানী পাঠকের ইতিহাসের  নিম্নবর্গীয়তায় রূপকার্থে যেন প্রতীক হয়েই প্রবেশ করেন সন্নাসীকাটার ডোরাকাটা হাটের ভিতর। কোন অভিবাদন থাকে না দৃশ্যতথাকে না কি? সংশয়ী হতে হতে উত্তরও সম্ভবত মিলে যায়।গোপনে বাজনা বাজে। বাঁশিয়াল সুর তোলে। ভাঙা হাটের অষ্পষ্টতায় ঘুরে ঘুরে নাচ হয়। রাত্রির রহস্যময়তাকে আরও রহস্যকুহকে ঠেলে দিতে দিতে ভবানী পাঠক কিংবা সন্নাসীঠাকুর সারারাত দেখে যেতে থাকে নাচের পর নাচ। বিবিধ জায়মান মুদ্রা।গানের সুরের দোলায় দুলতে থাকে তাদের শরীরের অবয়বখানি। এসব কি স্বপ্নের মতো, ফিরে আসে জীবনে! উড়ে যাওয়া মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে আত্মগত কোন সংশয়-সংকটের জট খুলতে গিয়ে  পুনর্বার যেন মোহাবিষ্টই হয়ে ওঠে টুকরো টুকরো ইতিহাসখন্ডের চলাচলের মতো।





(৬৫)


উড়ে যাওয়া মেঘ দেখতে দেখতে, সন্নাসীঠাকুরের, হাটের শূন্যতায় ডুবে যেতে যেতে  সে কি একসময় তার স্বপ্নের ডালপালাকে প্রসারিত করতে করতে শরীরময় সুখমাখা স্বপ্নের আকুলিবিকুলির নতুন কোন নিশানসহ স্বপ্নের কেন্দ্রভূমে ফিরিয়ে আনবে নিজেকে। না কি স্বপ্নের পর স্বপ্নে সে কেবল তার বিষাদবেদনার দীর্ঘনিঃশ্বাস ছড়িয়ে দেবে। মীমাংসাহীন এইসকল ভ্রম ও বিভ্রম থেকে যায়; থেকে যাবে, আর ওদলাবাড়ির জঙ্গল থেকে হাতির পাল বেরিয়ে আসবে একসময় সকল ফসল বিছানো দিক ও দিগরের দিকে। হাতির দল এগিয়ে যাবে আরও আরও ব্যাপ্ত প্রান্তরের দিকে। এক পর্বে ওদলাবাড়ির হাতির পালের সাথে মিশে যাবে হয়তো গজলডোবা কাঠামবাড়ির আরও আরও হাতির মিছিল। সে কি তার কল্পনার  লাটাই থেকে ছড়ানো সুতো গুটিয়ে নিয়ে বিভ্রমতাড়িত হয়ে ওদলাবাড়ির হাতির দলের মুখোমুখি দাঁড়াবে। না কি কাঠামবাড়ির গোপন ফরেষ্টের ভিতর ঢুকে পড়তে দেখবে সারিন, মাকনা কিংবা দাঁতাল হাতির সাজানো পালকে। শূন্যতার গভীরে ডুব দিয়ে  তুলে আনা অনুপম এক নিসর্গদৃশ্যকে জীবন মরণের দার্শনিকতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে সে তার সামগ্রিক স্মৃতিসত্তায় ধারাবাহিক ভ্রমই হয়তো রচনা করতে থাকবে; যদিও ওদলাবাড়ি আপলচাঁদ নাথুয়া গয়েরকাটার হাতির পালের চংক্রমনকে গুলিয়ে ফেলতে গিয়ে একসময় শূন্যতা থেকেই বিনির্মিত হবে শালকুমার ধাইধাইঘাট ফরেষ্টের সব ও সমস্ত হাতির দল। সে তার চিন্তাচেতনায় মিশিয়ে নেবে আবহমানতা আর দূরের দুরন্ত নদী তিস্তার জলতল নিংড়ে আসা হিম বাতাসে শুনতে পাবে চিরদিনের চিরন্তন ও চিরচেনা সব লোকগান।





(৬৬)


গান ও বাজনা দিয়েই তো তার হাতি চেনা নদী চেনা হাট চেনা স্বপ্ন চেনা। এইসব সত্যকে তো আর আড়াল করবার কোন উপায় থাকে না। তাই আড়ালের আড়ালে গোপনতায় তাকে ডেকে আনতে হয় পাখির ডাক, হরিৎ শস্যখেত, জলজলার বাতাস, ওদলাবাড়ির হাতির দলকে। স্বপ্নের সাদামাটা অংশে সমগ্রকে নিয়ে কোন এক পর্বে সে হেঁটে আসতে থাকে গজলডোবার দিকে। তার এই হাঁটাটা কিন্তু কেবলমাত্র হাঁটাই থাকে না; কেননা হাঁটবার নির্দিষ্ট কোন শর্তকে মান্যতা দেবার কোন তাগিদ বা প্রয়োজনীয়তা সে অনুভবই করে না। তাই জ্যোৎস্নায় অমাবস্যায়  ভরাবর্ষার কুয়াশায় তার হাঁটাটাকে সে অব্যাহত রেখে ক্রমে ক্রমে একধরনের অলৌকিকত্বে পৌঁছে দেয়। এটাই তো ভ্রম-বিভ্রম দিয়ে রচিত তার লোকপৃথিবী যেন যার প্রাণের স্পন্দন থেকে বুদবুদ কেটে বেরিয়ে আসে খোলামেলা উঠোন, তার উঠোনের বাহির খোলান দিয়ে ডানাহীন পাখিদের মতো ভাসতে থাকে স্বপ্ন ও রূপকথাগুলি।










0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন