কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৯

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়




ধারাবাহিক উপন্যাস


প্রিয়দর্শিনী 




(চতুর্থ অধ্যায়)  


(৯)  
  

বালিঘড়ি (তৃতীয় অংশ)


মেহেরৌলীর চক বাজারে পা দিতেই বিবাক বুঝতে পারল এখানে গোপীকে খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। গোপীর আসল বাড়ি গৌড়-মালদহ। দামুন্যা ছেড়ে গৌড়ে আসার পর প্রথম যে মানুষটি বিবাকের দিকে বন্ধুত্বর হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সে হচ্ছে গোপী। আবার গৌড় ছেড়ে দিল্লি চলে আসতে বাধ্য হল যখন, নিমেষে বিবাকের জীবন থেকে গোপী কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তারপর থেকে গোপীকে সে অনবরত খুঁজেই চলেছে, কিন্তু দেখা মেলেনি। অথচ তার মন অহরহ বলে, গোপী হারিয়ে যায়নি একদিন না একদিন ঠিক দেখা হবেই।
গোপী ভাল নাচ করতে পারে। পুরুষ হলেও নৃত্য তার একমাত্র অবসর বিনোদন। হাতে বাউটি, কন্ঠে হাঁসুলি, কর্ণে মদন কড়ি-ঘাঘরা পরিহিত নৃত্যরত গোপীকে যে দেখেছে, সে মোহিত না হয়ে পারবে না।

যে রাত্রে দামুন্যা পরিত্যাগ করে পথে নামতে বাধ্য হয়েছিল, জানা ছিল না ঠিক কোন দিকে পথ চললে একটু নির্ভর যোগ্য আশ্রয় মিলবে। প্রত্যেকেই সহায়হীন। পশ্চাতে পোড়ো ভিটে তাকে পিছু ছেড়ে তখন প্রাণ বাঁচানোই সবথেকে জরুরী। আধপোড়া কিছু থালা বাসন, দুএকটি মাটির পাত্র এসব সম্বল করে পথে নামা,  দেশ পুড়ে গেলে আর কি অবশিষ্ট থাকল? গঙ্গার উত্তর-পূর্ব্ব দিক বরাবর হাঁটা লাগিয়েছিল একদল মানুষ, বিবাকও ছিল সেই দলে। সাত দিন সাত রাত একটানা পথ হাঁটবার পর ক্রমে দলটি যে স্থানে উপস্থিত হয়, জায়গাটার নাম তর্ত্তিপুর। এর একক্রোশ উজানে গঙ্গা মহানন্দার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। প্রত্যেকেই ক্লান্ত অবসন্ন ও উদভ্রান্ত। পথ চলতি এক চাষাভুষোকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এ দেশটায় ধান পাট ইত্যাদি সারা বছর ফলে, বাদলার কালে ভাল বাদলা হয়, মাছ এত সস্তা যে মানুষ এক আধদিন ভাত ছেড়ে শুধু মাছ দিয়েই দুপুরের আহার সম্পন্ন করে। বিবাকদের দলের একজন মুরুব্বি শুধিয়েছিল, তা বাপু এ দেশে জমিদারের খাস তালুক কোনটা? আমরা ভিনদেশী, তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী। গেঁয়ো লোকটি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাত পা মাথা নেড়ে জবাব দিয়েছিল, এজ্ঞে জমিদার এখেনে থাকেন না, কাবুল চলে গেছেন! যাবার কালে প্রজা সকলকে জানিয়ে দিয়ে গেছেন, তিনি নাকি কাবুল যাওয়ার পথে লড়াই করতে করতে এগুবেন’!

এরপর মানুষটি আর কথা বাড়ায়নি। সোজা উলটো মুখে হাঁটা লাগিয়েছিল। গৌড়ের সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয় বিবাকের। সেদিনই দেখেছিল সে আকাশ কেমন ঘন নীল, মাটি সোনালি, গাছ গাছালি ঘন সবুজ। নতুন দেশ একটু একটু করে বিবাকের মনে প্রশান্তি এনে দিয়েছিল। জন্মভুমির স্মৃতি কোনও মানুষের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু দামুন্যার সঙ্গে গৌড়ের অনেকানেক সাদৃশ্য বিবাককে ধীরে ধীরে শান্ত করে তুলছিল। তার ওপর গঙ্গার মত দিগন্ত বিস্তৃত নদী এই প্রথম চাক্ষুস হল। চারিদিকের শ্যামলতা নদীজলের গন্ধ বিবাকের মনে একটা সহজ আনন্দ এনে দিল।

গাঙের উত্তর পূর্ব পাড় বরাবর সারিবদ্ধ দালান কোঠা। সবই প্রায় মাটি দিয়ে তৈরী এবং প্রত্যেক কোঠার চারধারে ওই একই রকম মাটির নতিউচ্চ প্রাচীর। স্নিগ্ধ শান্ত গ্রাম্য জীবন। হেমন্ত অপরাহ্ণের স্নিগ্ধ ছায়া নদীবুকে, গ্রাম খানার মাথায়

গঙ্গার বুকে অনেক রকম নৌকো। মাল বওয়ার মধুকর ডিঙ্গা, বজরা, ছোট পানসি। কোনও কোনও নৌকোয় মাঝি মাল্লারা রান্নাবান্নার যোগা করছে।  কোনও নৌকো মালপত্র বোঝাই। মাটির হাঁড়ি কলসী,ধান, পাট, নুন, মরিচ,কার্পাসবস্ত্র। ‘গিয়ুঞ্চী’ নামের এক জাহাজ যেখানে হাজার বস্তা মাল ধরে, এবং এর উপরে কয়েকখানা ছোট নৌকো চাপিয়ে নাবিকেরা ‘মলাক্কা’ পর্য্যন্ত বাণিজ্যে যায়। এই ধরনের জাহাজে নদীর ঘাট প্রায় ভর্ত্তি। মাথায় সফেদ পাগড়ী দিয়ে ভিনদেশী সওদাগররা জিনিষপত্র দরদাম কেনাবেচা করছে। ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা কানে পৈতা গুঁজে বগলে পুঁথি দাবড়ে দ্রূত পথে চলে যাচ্ছে। খড়মের খটাখট্ শব্দ শোনা যায়। ঘোমটা ঢাকা দুই একজন নিম্ন শ্রেণীর স্ত্রীলোক চোখে পড়ল বটে তবে এরা যে হাট বাজারের প্রয়োজনে পথে বের হয়েছে একটু খেয়াল করলেই তা বোঝা যায়। এক হাতে বড় বল্লম অন্য হাতে পাকা বাঁশের তেল চকচকে লাঠি হাতে কোতয়াল হেঁটে যায়। বড়ই দৃপ্ত তাদের চলার ভঙ্গি। পাকানো মস্ত গোঁ, কবজিতে মোটা মকর বালা। সব দেখে শুনে বিবাক খানিক ঠান্ডা  হল। গৌড়ের কর্ম ব্যস্ততা, জন জীবনে ধীরে ধীরে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেল। তার দল যেখানে আস্তানা গড়ে তুলল, সেখান থেকে গঙ্গা খুব নিকটেই। শটি বনের সুগন্ধ, নদীতীরে ঝাপসা হয়ে থাকা সবুজ সারি, আকাশের নীলিমা, বিভিন্ন মানুষ জনের হাঁকডাক ও ব্যস্ততায় দেখতে দেখতে বিবাকও তাদের একজন হয়ে গেল এখানে খাওয়া দাওয়ারও তেমন কোনও কষ্ট নেই। শালি ধানের ভাত, ফুলুরি, চিঙড়ির বড়া... মাঝে মধ্যে সরিষাবাটা সহযোগে পানিকচু, বিবাক নিজেই পাঁচপদ রান্না করতে শিখে গেল।

গোপী সব কিছুকে অবজ্ঞা করতে পারে। এমন কী প্রচন্ড মার খাওয়ার পরও সে  প্রাণ খুলে হো হো করে হাসতে পারে। হাসিতে তার ক্লান্তি নেই।
বিবাক চমকে ওঠে। বলে, আমি বিবাক। এখানে নতুন এসেছি। তুমি কে?   নদীর জোলো বাতাসে ফতফত করে তার পরনের কাপড় ঊড়ছে। দুচোখে অবাক বিস্ময়।
গোপী বলল, আমি তো একলা। তাই সব সময় হাসি পায়।
বিবাক ভাবল, বেশ জবাব! শুধলো, তুমি থাক কোথায়? কদ্দুরে বাড়ি?
বাড়ি নেই। ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াই।      
গোপীর কথার ধরনে এবার বিবাক হাসতে শুরু করল। অল্প হেসে বলল, তা বেশ কথা! তবে তো কোনও চিন্তাই নেই। খাও দাও আর ঘুরে বেড়াও! কি বলো?
নাহ্! আমার তেমন কোনও চিন্তা নেই, তবে একজনকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। তাঁকে খুঁজে পেলে একটা আর্জি পেশ করতে চাই।
সে কে? তিনি কি এই দেশের জমিদার? চেন নাকি?
ধুত্! আমি কাউকে চিনি না।
তবে যে বলছ নালিশ করবে?

গোপী আবার হো হো করে হেসে উঠল। হাসি থামতেই চায় না। বিবাক অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কিসের জন্য এত হাসি বুঝতে পারে না। না হয় না বুঝে বেমক্কা একটা প্রশ্ন করেই ফেলেছে, কিন্তু জমিদারের বাড়িটা যদি কেউ চিনিয়ে দেয় তো বিবাক নিজেই রাজ সম্মুখে আর্জি পেশ করবে। সবিনয়ে বলবে, মহারাজ আমি বিবাক। দামুন্যা থেকে এসেছি। সেই যেখানে দক্ষিণপূর্ব্ব কোণ ও খাড়া পশ্চিম, দুদিক থেকে দুটো নদী এসে পরস্পরকে ছুঁয়ে অর্ধচন্দ্রাকারে বেঁকে গিয়েছে, যেখানে জলের রঙ ঈষৎ সবুজ; চাঁদা, ইচা, কবয়ি, শফর, রুই, বোয়ালেরা ঝাঁকে ঝাঁকে জলস্তরের ওপরে ঘুরে বেড়ায়, দামুন্যা গ্রাম ঠিক সেখানেই। সেখানের বাতাসে দুধশালী ধানের গন্ধ। মহারাজ এক রাত্রে অত্যাচারী জমিদার আমাদের খড়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। অসংখ্য গ্রামবাসী আগুনে পুড়ে মারা যায়। শুনেছি সেই জমিদার গৌড় থেকেই দামুন্যা গিয়েছিলেন..., এমন বলা চলে রাজা মশাইকে? নিশ্চই চলে। না হয় বিবাক মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় দলের দুই তিন জন চলনদারকে সঙ্গে নেবে। তারপর সবাই মিলে সমবেত প্রার্থনা নিবেদন করবে!

হাসি থামলে গোপী তাকে বলল, তুমি ভাই ভয়ানক সোজা মানুষ। এমন সোজা  আমি আগে দেখিনি। রাজা মহারাজারা কি ছেলের হাতের মোয়া যে চাইলে আর অমনি দেখা হয়ে গেল!
থতমত খেয়ে বিবাক বলল, মহারাজ কি আমাদের মত গরীবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন না?
রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেলে ভেট দিতে হয় তা জান? খালি হাতে গেলে রাজার অসম্মান। তোমার কাছে আছে তেমন কিছু?
বিবাক চুপ মেরে গেল এদিকটা সে ভেবে দেখেনি। মাথাতেই আসেনি। টাকা কড়ি তার কাছে কিচ্ছু নেই। কয়েকটা দুধমুখী কড়ি ছিল, কোঁচরে গোঁজা থাকত সব সময়। অত যত্নের জিনিষগুলো কবেই খোয়া গিয়েছে। দামুন্যা থেকে গৌড় আসবার পথেই হাপিস। উদাস মুখে জবাব দিল, নাহ্ আমার কাছে তেমন কিছু নেই। বলতে পারো এখন আমি কপর্দকশূন্য
হবে ন!... মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না! খোজা প্রহরী গলা ধাক্কা দিয়ে তোমাকে সিংদরজা থেকেই তাড়িয়ে দেবে। বুঝেছো?
সাক্ষাতের সময় তুমি কি ভেট দাও?
দুচোখ বন্ধ করে তুরন্ত জবাব দিল গোপী, সে অনেক কিছু, তুমি বুঝবে না জাহাঙ্গীর বেগ লোক ভাল। ভাল জিনিষের কদর জানে। কিন্তু তেনার সাঙ্গপাঙ্গরা হচ্ছেন এক একটি তিলে খচ্চর। তুমি দেখে নিও এদের হাতেই গৌড় একদিন উৎখাত হয়ে যাবে। জাহাঙ্গীর বেগ এদের কথায় ওঠেন আর বসেন।
বিবাক বলল, মহারাজ কি দেশে থাকেন না? সে জন্য তাঁর অবর্ত্তমানে ওই সাঙ্গপাঙ্গরা রাজত্ব চালায়?
সেটাই তো হয়েছে মুশকিল! এই যে খানিকটা আগে ডান্ডাহাতে যে মুশকো মত লোকটা আমায় পেটালো, দেখলে ওর ভাবখানা? যেন ওইই দন্ড মুন্ডের কর্ত্তা। নেহাত আমি লড়াই ফড়াই ভালবাসি না তাই রক্ষে, নইলে আজ একহাত হয়ে যেত। গুন্ডাগর্দীতে এ শর্মাও কিছু কম যায় না!

বিবাক যতই শুনছে ততই অবাক হচ্ছে। বাব্বাঃ! এ কেমন দেশ যেখানে অনেকগুলো রাজা! প্রজারা কাকে ভেট দেবে? কাকেই বা সেলাম ঠুকবে? একটা
দেশে একাধিক রাজা - এমন তত্বের সঙ্গে তার এই প্রথম মোলাকাত। গোপীকে বলল, সাক্ষাৎ করতে তুমি একলা যাবে বলছিলে, চলো তোমার সঙ্গে আমিও যাচ্ছি!
আমার সঙ্গে যেতে চাও তো চলো, কিন্তু মালিককে আমি শুধু আমারই কথা বলব। তোমার কথা কী বলবে ভেবে নাও। ওখানে খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার নিয়ম নেই।
একটা প্রশ্ন করব? সত্যি বলবে? সাক্ষাতের জন্য তুমি কতদিন এই রকম করে হেথায় সেথায় ঘুরে বেড়াচ্ছ?
অনেক দিন ধরেই ঘুরছি হে! নতুন এসেছো, সব কিছু বুঝতে তোমার এখন অনেক দেরী..., চলো ওদিকটায় চলো! এখানে খুব ভিড়।

বাস্তবিক জায়গাটায় হঠাৎ করে লোকজনের ভিড় আর ব্যস্ততা দুটোই বেড়ে গেল। এইমাত্র একটা বড় সপ্তডিঙা এসে ভিড়েছে ঘাটে। গঙ্গার ঘাট থেকে নানান গাছ গাছালি ভরা সরু একটা সুঁড়ি পথ উঠে এসেছে এখানে, আমলকী শিরিষ বট ইত্যাদি বৃক্ষ এবং নানা ধরনের গুল্মলতা আগাছায় ভরা পথের দুধার। কিন্তু ঘাটে এখন এত বেশি মানুষ-এর ভিড় আর হৈ চৈ যে তা পাখ পাখালির  ডাককেও ছাপিয়ে গেছে। এখানে একটা মাঝারি আয়তনের দহ। দহটা বহুকালের পুরনো। এরই চারপাশে সারিবদ্ধ দোকান পশরা। দোকানগুলোতে সওদাগররা বেণেরা থরে থরে পণ্যদ্রব্য সাজিয়ে রেখেছে। গঙ্গার ঘাটে যে সব বাণিজ্যতরী এসে থামে, সওদাগরেরা মুটের মাথায় মালপত্র চাপিয়ে সোজা এই সব দোকানে এসে হাজির হয়ধুরন্ধর ও অতি সতর্ক গোছের মানুষজনের কোলাহল বা সংস্পর্শ বিবাকের কোনওদিনই ভাল লাগে নাউলটে এসব সে এড়িয়ে যায়। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে সে শুধোলো, এইসব বড় বড় পানসি কোথ্থেকে আসছে জানো?
গোপী জবাব দিল, রাজনীতি। এটা একটা খুব সাধারণ মানের রাজনীতি।
বিবাক বলল, তুমি রেগে গেলে? ঠিকাছে, আমি কিছু জানতে চাই না।
আবার হো হো করে একচোট হাসি গোপীর। বিবাক নিঃশব্দ হয়েই গোপীর হাসি শুনতে লাগল। হাসি থামার পর অল্প হেসে অল্প কেশে গোপী বলল, রাজনীতির মানে জানো? এর মানে হল ইচ্ছেপূরণ।
কাদের ইচ্ছেপূরণ?
অ্যায়! এতক্ষণে মোক্ষম প্রশ্নটা শুধিয়েছোবলতো কাদের ইচ্ছেপূরণ?

বিবাক জবাব দিল, যিনি রাজা ইচ্ছেপূরণ তাঁরই। আমাদের মত সাধার  মানুষদের ইচ্ছের কোনও দাম আছে?... বলতে বলতে সামান্য একটু উত্তেজিত হয়ে পড়ল বিবাক। খেয়ালে এল না যে পাশের একটা ছোট্ট সবুজ গাছের হাল্কা নীল গোলাপী ফুল তার হাতে পায়ে ঠেকছে। ফুলপাতা হাতে পায়ে লাগলে কেমন ভগবান ভগবান মনে হয়। একটা অন্যরকম অনুভূতি। একঝাঁক মেঠো চড়াই হঠাৎ খুব কিচির মিচির শব্দে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। দহ থেকে ভারী ঠান্ডা একটা বাতাস এসে দুজনের মুখে চোখে ঝাপটা দিয়ে গেল। গোপী বলল, এই দহটা গঙ্গার পুরনো খাত অনেক বছর আগে গঙ্গা তখন ওই দিকে বইত, পরে বাঁক বদল করে নেয়। পুরনো জায়গায় সেই জলটুকু এখনও আটকে রয়েছে।
বিবাক শুধলো, হঠাৎ গঙ্গা পথ বদল করল কেন?
পাপ বোঝো ? পাপ? অত্যাচার ষড়যন্ত্র চক্রান্ত মানুষের মধ্যে বেড়ে গেলে গঙ্গা বারবারই অমন করবে।
বোকার মত প্রশ্ন করল বিবাক কে চক্রান্ত করল? জাহাঙ্গীর বেগের লোকজনেরা?
ওদের চক্রান্ত খুব বেশিদিন ধোপে টেকে না। জঙ্গলের শেয়াল দেখেছ? ওরাও ওই রকম। একটুখানি রাজত্বর জন্য ওরা সবই পারে। এসব করার পরে আবার বামাল সমেত ধরাও পড়ে যায়। শেষে গর্দান কাটা পড়ে।
জাহাঙ্গীর বেগ গর্দান নেন তাই না? প্রশ্নটা করতে পেরে বেশ খুশী হল বিবাক
নাহ্! তিনি হলেন অকম্মার ঢেঁকি। তিনি শুধু শরাব পান করেন বাঈনাচ দেখেন আর সম্রাটের বকলমায় গৌড় শান করেন। প্রজারা মরল না বাঁচল তাতে ওনার কিস্যু যায় আসে না।
সম্রাট? তিনি কোথায় থাকেন?
এবার গোপীর মুখচোখ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, তবেই না বলছি, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যই তো কেবল এলোপাথাড়ি ঘুরে বেড়াই। শুনেছি খুব শিগ্গি্রি তিনি নাকি গৌড়ে আসবেন, থাকবেন এখানে মাস তিনেকের মত।

বিবাক মনে মনে ভাবে আর কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যে নামবে। এখনই পা না চালালে আস্তানায় পৌঁছতে রাত নেমে যাবে। গৌড় এত জটিল জায়গা আগে কে তা জানত? গন্ডায় গন্ডায় জমিদার সম্রাট যে যার ইচ্ছেমত হুকুমদারি চালায়। নাহ্ ওসব বড় বড় খবরে তার কোনও প্রয়োজন নেই। দিব্যি খেয়ে পড়ে দিন চলে যাচ্ছে, এই বেশ। গৌড়ই এখন একমাত্র আশ্রয়দাতা। এটা চলে গেলে চারদিক অকূল পাথার।
গোপী শুধলো, কী হল হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে গেলে যে? কী ভাবছ?
না, তেমন কিছু না। তুমি রাত্রে কোথায় থাকো?
গাছতলায়। বট অশথ্ব দাড়িম্ব যে কোনও গাছ।
তোমার ভয় করে না?                                    
ভয়? – অবাক হল গোপী। - বারে! ভয় করবে কেন? বরং আমাকে দেখেই অনেকে ভয় পায়।
এবার হাসির পালা বিবাকের। হো হো করে হেসে উঠল। মনভার যেটুকু হচ্ছিল হাসির চোটে সেটা বেমালুম গায়েব। বলল, নাহ্ তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে দেখছি আখেরে লাভ আছে।
কী রকম! কী রকম! শুনি একটু!
দুজনে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলল সামনের পথ ধরে। সূর্য অস্ত গেছে, পশ্চিমাকাশে রক্তাভা। গঙ্গার বুকে ছোট বড় নৌকোগুলো দুলছে মোচার খোলার মত। একসার বক উড়ে গেল মালার মত।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন