হরীতকী ফলের মতন –
২
(৩)
এরূপ বিরহ ভালো; কবিতার প্রথম পাঠের
পরবর্তীকাল যদি নিদ্রিতের মতো থাকা যায়,
স্বপ্নাচ্ছন্ন, কাল্পনিক; দীর্ঘকাল পরে পুনরায়
পাঠের সময়ে যদি শাশ্বত ফুলের মতো স্মিত,
রূপ, ঘ্রাণ ঝরে পড়ে তবে সার্থক সব ব্যথা,
সকল বিরহ, স্বপ্ন; মদিরা বুদ্বুদের
মতো
মৃদুশব্দে সমাচ্ছন্ন, কবিতা, তোমার অপ্রণয়।
হাসির মতন তুমি মিলিয়ে গিয়েছ সিন্ধুপারে...
অনেক ছোটো ছিলুম তখন। বাবার বিশাল বইয়ের ভার গুছিয়ে
রাখার দায় নিজেই নিয়েছিলুম জাস্ট বই ঘাঁটার আনন্দ পেতে। পদ্যের
বইগুলোর মধ্যেও তেষট্টি সালের ছাপা এই সংকলনটি
ছিলো প্রায় নেই হয়েই। অনেকটা পাড়াগাঁর বাসর ঘরের
সবচেয়ে গোধূলি মদির মেয়েটির মতো। বারো তেরো বছর বয়েসে নিশ্চয়
বিনয় মজুমদারকে ছুঁয়ে থাকার মতো এলেম আমার ছিলো না। কিন্তু
পদ্যগুলি ছিলো শুধু পড়ে যাওয়ার জন্য। সব তন্তুজাল উড়িয়ে দিয়ে আটপৌরে
বা তৎসম শব্দগুলিকে হৃদমাঝারে গড়িয়ে দেবার যে মসৃণ পাকদন্ডি বিনয় আবিষ্কার করেছিলেন,
তার জাদু সেই বয়েসেই অনুভব করেছিলুম। তোমার মোহন
রূপেকে রয় ভুলে...? বাবাকে প্রশ্ন
করেছিলুম এই কবিতাগুলি কবে বুঝতে পারবো? তিনি বলেছিলেন, বোঝার চেষ্টা কোরো
না, কাছে যাওয়ার কথা ভেবো। তার জন্য সময় দিতে হবে, নিজেকে দিতে হবে মগ্নতা। বৈষ্ণবের কৃষ্ণপ্রাপ্তির মতো
অনুভব হবে একদিন, সেটাই কবিতার কাছে
আমাদের প্রার্থনা।
তারপরেও সম্ভবত সিগনেট থেকে একটা তন্বী সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছিলো,
সেটা আমরা আমাদের শহরে পাইনি।
এটা নিয়ে একটা তুমুল তর্ক চলতো জীবনানন্দের আসল উত্তরাধিকারী
কে? দাবিদার আমার প্রিয়তম দুই কবি, বিনয় ও শক্তি। তখন কবিতাকে বা বলা ভালো বিভিন্ন
'রবীন্দ্রঅনুসারী' বা অন্যরকম মূঢ় তকমাও ছিলো খুব সুলভ। একটু সরব
হয়ে মানুষের দুঃখ সুখ নিয়ে চর্চা করতেন যেসব কবি তাঁরা ছিলেন
'সংগ্রামী', কেউ ছিলেন মাতাল, আর কেউ বা পদ্যবণিক। বুদ্ধদেব বসুর 'মতো' যাঁরা, তাঁরা
'বৌদ্ধ' আর বিষ্ণু দের কাছাকাছি ছিলেন 'বৈষ্ণব'রা।
জীবনানন্দ যে ধারাটায়, অর্থাৎ পদ্যের যে প্রতিমায় শেষপর্যন্ত স্থিত হয়েছিলেন তা কিন্তু
একেবারেই 'ঘোর' সৃজনী পন্থা ছিলো না। তাঁর জীবৎকালে তাঁর সম্বন্ধে যা কিছু বলা হয়েছে, পরবর্তীকালে দেখি সবই সত্যের থেকে দূরে। তাঁর কাছে শব্দ, শব্দবন্ধ,
রূপক, প্রতীক, প্রত্নচিণ্হ সবই
আসতো অনেক শ্রমের পর। কিন্তু কবিতাটির অবয়ব স্থির হয়ে গেলে কোনও
জীবনচিণ্হ খুঁজে পাওয়া যেতো না। একজন প্রকৃত শিল্পীই পারেন
এরকম। একজন সফল মৃৎশিল্পীর প্রতিমায় পাওয়া যায় না খড়ের ভঙ্গুর নির্মাণ
বা একজন সফল কণ্ঠশিল্পীর তানকারি পরিবেশনায় থাকে না অকারণ সরগমের চমক দেওয়া ভেল্কি।
সমর সেনের সঙ্গে সুনীল গঙ্গো বা প্রেমেন্দ্র
মিত্রের সঙ্গে অলোকরঞ্জন, এভাবে সমান্তরাল খোঁজার খেলা ছিলো
পদ্য পাগলদের মধ্যে। জীবনানন্দের
সঙ্গে বিনয় বা শক্তির সমান্তরাল টানা ছিলো অত্যন্ত সুলভ ব্যসন। এর কারণ কি যেহেতু জীবনানন্দ জীবৎকালে ছিলেন
একজন দুরূহ কবি বা তদুপরি একজন নিজের মুদ্রাদোষে সম্পূর্ণ আলাদা হওয়া এক মানুষ, তাই কলকাতার মহানাগরিক মননের অংক তাঁকে নিজের সুবিধের জন্য একটা বিশেষ গোত্রে ফেলে দিলো। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, জীবনানন্দ একজন আদ্যন্ত কবি এবং কবিতা ছাড়া তিনি কিছু লেখেন না। অর্থাৎ,একজন সাবেক 'কবি'র ছাঁচে ফেলা হলো তাঁকে, আলুলায়িত যুক্তিবোধও বলগাহীন আবেগতাড়িত শব্দের বাজিকর হিসেবে, যেটা হয়তো কবিদের সম্বন্ধে
সমাজের অধিকাংশ লোকেরই ধারণা। কবিও যে সর্ব অর্থে একজন শ্রমিক, সেইবোধ বেশ বিরল। তাঁর ইতিহাসচেতনা, সামাজিক বোধির স্বরূপ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের
মাপের একজন ধীমান কবিও বুঝতে পারেননি। অন্য পরে কা কথা? তথাকথিত
'বামপন্থী' বিশ্লেষণে অবক্ষয়ের সাবেক ছাপ দাগানো হয়েছিলো তাঁর উপর। তাই
জীবনানন্দের প্রকৃত উত্তরসূরি হয়ে আসেন একজন 'পাগল' ও একজন 'মাতাল', দুই বরেণ্য উৎকেন্দ্রিক, সরকারে দরকার নেই, তাই নিজের সুড়ঙ্গে স্বচ্ছন্দ থাকাই তাঁদের ভবিতব্য। তাঁদের স্ব আরোপিত ট্র্যান্সের মুগ্ধ অমরাপুরীতে স্বপ্ননির্বাসন দেওয়া হলো?
কবিতা পড়ার বা শোনার আগে এতো কচকচি কি অনিবার্য? এতো সব নিয়ে চর্চা না করলে, ঘাম না ঝরালে কি কবিতা উপভোগ করার অধিকার জন্মায় না? কবিতা তো এভাবেই মানুষের থেকে দূরে চলে যায়।
পর্ণা আমাকে এই প্রশ্ন করেছিলো একদিন।কিছু সন্দিগ্ধ, কিছু নিরাশ। আমি ভাবি,
সত্যিই তো, যাঁরা পদ্য আর লিটল ম্যাগ নিয়ে সতত নানা নিরীক্ষায় ব্যস্ত তাঁরা ছাড়া কি কবিতায় আর কারো অধিকার নেই? জনপ্রিয় না হলেই কি তা 'প্রকৃত'
কবিতা হবে? অংকটা কি এতই সহজ?
(৪)
কিন্তু কোথায় গেলো সে আজকে? নিশ্চিত বলেছিলো আসবে, কিন্তু এতোক্ষণেও খুঁজে পেলুম না। হঠাৎ দেখি পরমা, আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি এগিয়েযেতে নিজেই বলে উঠলো ,
সুরঞ্জন, অই খানে যেওনাকো তুমি, বোলোনাকো কথা অই বালিকার সাথে...
ও নিশ্চয় কিছু জানে...
কখন এসেছো?
তুমি কি আমাকে জিগ্যেস করছো?
না, তোমাকে নয়, নিস্তারিনী পিসিকে জিগ্যেস করছি...
তাহলে তাকেই জিগাও, আমি পালাই...
বললো, কিন্তু দাঁড়িয়েও থাকলো
আমি বলি, কী হলো, পালাও
না, আমি অপেক্ষা করছি সেই প্রশ্নের, যা তুমি এখনও করোনি...
আমার তো কোনও প্রশ্ন নেই...
তাই, বেশ... ঠিক আছে আমি ওখানে গান শুনছি, ইচ্ছে হলে এসো...
বেশ চলো, কিন্তু আমাকে দেখলে অসিতদা আবার গানের জন্য টানাটানি করবে...
অসিতদা তোমার নাগাল পাবেনা আজ...
একটু এগিয়ে দেখি ঘাসের উপর তিনি বসে আছেন যেন গজেন্দ্রগামিনী। গান শুনছেন। বড্ডো ভিড় তাই দূর থেকে দেখা যাচ্ছিলো না।
পরমা বললো, বসবে না উঠবে?
বালিকে, গুরুজনদের সহিত পরিহাস! নরকগামিনী হইবে ...
তাতে আর কী? ওখানেও তো তোমায় পাওয়া যাবে...
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে...
বস করো, নয়তো আমার বন্ধুবিচ্ছেদ হয়ে যাবে...
দেখতে পেয়ে উঠে এলো সে। পরমাকে প্রশ্ন,
কীরে কখন ফিরবি?
সেটা তো তুই বলবি। আমি তো ভাবলাম ফেরার কোনও সিন নেই এখন...
সই'দের রহস্যালাপ। আমার তো কোনও ভূমিকা নেই এখানে, এখন অপেক্ষা করি, বালিকাকে বিদায় দেবার
বহুপরে পুনরায় দর্শনের অপেক্ষার মতো-
হয়তো সর্বস্ব তার ভরে গেছে চমকে চমকে।
অভিভূত প্রত্যাশায় এরূপ বিরহব্যথা ভালো।'
আমার দিকে ফিরে প্রশ্ন, তোমার কতোক্ষণের কাজ আছে এখন?
আমার তো কোনও কাজ নেই...
তবে?
তুমিই তো কাজ...
আমি...? বাত কুছ হজম নহি হুই...
আপকি মর্জি...
তবে চলি এখন...
'...বেশ, তবে চলে যাও, তবে যদি কোনোদিন কোনো
লৌকিক সাহায্যে লাগি, ডেকে নিও...'
তোমার হাতে কী?
ফিরে এসো চাকা...
চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মুখ, 'পেয়েছো শেষ পর্যন্ত! ওফ... দারুণ ব্যাপার'
গ্রহণ করহ,
করিলাম...
নামপাতাটি উল্টিয়েই 'উৎসর্গ গায়ত্রী চক্রবর্তী', নিচে লেখা, 'উৎসর্গ, পর্ণা'।
তুমি আমাকে 'উৎসর্গ' কী করে করলে? উপহার বলতে হতো... আচ্ছা গায়ত্রী চক্রবর্তী কে? কিছু জানো?
বোধ হয় সামান্য জানি। উনি বিনয়ের পর্ণা।
ধ্যাৎ...
'...একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো- এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হলো ফল।...'
এই স্মিত দৃশ্য, এই আপক্ক রক্তিম দ্রাঘিমার ছবি দেখার জন্যই তো সারা সন্ধে অপেক্ষা করেছিলুম।
(ক্রমশ)
Duronto likhchis. Continue for. Bhalo thanks.
উত্তরমুছুনধন্যবাদ..
মুছুন