কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

শিবাংশু দে

 

ঋত্বিকের নিজস্ব মুদ্রাগুলি - ১




--------------------------------------------    

"...Film is not made, film is built. আমি চিত্রপরিচালক নই, আমি চিত্রস্রষ্টা। চিত্র সৃষ্টি করেন একজন - সত্যজিৎ রায়। মৃণাল সেন চিত্র সৃষ্টি করেন, তাঁরা (নিছক) চিত্রপরিচালক নন।" (ঋত্বিক ঘটক)

তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন ব্যক্তি ঋত্বিক বিতর্কের কেন্দ্রে থাকলেও স্রষ্টা ঋত্বিক সেভাবে আগ্রহীদের উপযুক্ত মনস্কতা আকর্ষণ করেননি। ঋত্বিককে কেন্দ্র করে মনস্তত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, চিত্রনির্মাণ ইত্যাদি নানা বিষয়ের উদ্দীপক চর্চা শুরু হয়েছে একটু ধীরে। কিন্তু অনিবার্য অভিঘাতগুলি দিনে দিনে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে মানুষের মনে। একজন প্রকৃত শিল্পী যথাসময়ে মানুষের মনোজগতের গভীরে পৌঁছে যান, এটাই শিল্পের নিয়ম। সময়ের মাত্রা শিল্পের সার্থকতার একটা প্রধান শর্ত। ঋত্বিক আবার তা সপ্রমাণ করলেন।

------------------------------

সেকালে বিশাখদত্ত একটি অঙ্গুরীয় মুদ্রার প্রতীককে কেন্দ্রে রেখে তাঁর চিরায়ত নাটকটির মাধ্যমে আমাদের নাট্যশাস্ত্রের গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছিলেন। মুদ্রাই মন্ত্রী না মন্ত্রীর মুদ্রা, রাক্ষস শেষ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেননি। প্রকৃত প্রস্তাবে শিল্পবিচারে মুদ্রার ছাপ থেকেই আমরা শিল্পীকে চেনার প্রয়াস পাই। ঋত্বিক ঘটকও কোনও ব্যতিক্রম ন'ন। তাঁরও কিছু প্রকট মুদ্রালক্ষণ রয়েছে। এটা সর্বজানিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তাঁকে সেদেশের সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য। উড়োজাহাজে যাবার সময় তিনি আকাশ থেকে পদ্মানদী দেখে ভাববিহ্বল হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। সহযাত্রী সত্যজিৎ তাঁকে সম্বৃত করেন। কিন্তু সেদেশে পৌঁছে সেখানের তৎকালীন ভূমিগত বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে তিনি অচিরেই প্রথমে নিরাশ ও পরে মোহমুক্ত হবার প্রয়াস করেন। কিন্তু কখনও হতে পারেননি। তাঁর তক্ষশীলা ও মগধ পরস্পর ঘেঁটে গিয়েছিলো। চিরকালের মতো। তিনি কার মুদ্রা বহন করেন, শেষ পর্যন্ত ঠাহর করে উঠতে পারেননি। আমাদের জন্য সেটাই প্রাপ্তি। ট্রিলজি'র ছবিগুলি সম্বন্ধে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, "যোগসূত্র এই তিনটার মধ্যে একই মাত্র। সেটা হচ্ছে দুই বাংলার মিলন। দুইডা বাংলারে আমি মিলাইতে চাইছি। দুইডারে আমি ভালোবাসি হেইডা কমু গিয়া মিঞা, এবং আমি আজীবন কইয়া যামু, যখন মৃত্যু পর্যন্ত আমি কইয়া যামু। আমি পরোয়াই (করি না), আমার পয়সার পরোয়াই (নাই)। I can fight that out. ঋত্বিক ঘটক can do that out here and in Dhaka. আমারে কে মারব লাথি, মারুক গা যাক। বইয়া গ্যাছে গিয়া।"

এই ছবিগুলি তাঁর কীর্তির মাইলফলক, তারা কোনও না কোনও ভাবে ছিন্নমূল, মাতৃবিযুক্ত সন্তানের বিষাদবেদনায় ধূসর। যে দেশ তিনি ছেড়ে এসেছিলেন তাকে কখনই মৃণ্ময় ভেবে সান্ত্বনা পাননি, তা চিরকাল অত্যন্ত প্রকটভাবে তাঁর কাছে  চিন্ময় হয়ে থেকে গেছে। তাঁর 'দেশ'মাতৃকার সঙ্গে তাঁর নাড়ি সম্ভবত পঞ্চাশ বছর ধরেই কেউ ছিন্ন করতে পারেনি। তিনি যতদূরে যেতে চেয়েছেন তত বেশি নাড়িতে টান লেগেছে এবং তিনি ব্যথাকাতর হয়ে পড়েছেন। তাঁর ব্যক্তিজীবন, শিল্পীজীবন, রাজনীতি, উৎকেন্দ্রিকতা, কেউই তাঁকে এই বেদনা থেকে মুক্ত করার উপযুক্ত শুশ্রূষা দিতে পারেনি।

----------------------------------------

আবার অন্যদিকও আছে। এই তিনটি ছবি নিয়ে নিছক আবেগের ঊর্ধে গিয়ে তাঁর বিশ্লেষণটিও প্রণিধানে রাখা প্রয়োজন।  

"'মেঘে ঢাকা তারা' was complete my.... in my subconcious affair. 'কোমল গান্ধার' was a very concious affair. আমার এই মহিলার সঙ্গে বিবাহ ব্যাপারটা তার সঙ্গে প্রচণ্ড ভাবে জড়িত। আর 'সুবর্ণরেখা' is a very serious work. ওখানে খাটতে হয়েছে, হ্যাঁ, মানসিকভাবে... a work behind. দৈহিকভাবে খাটার ব্যাপার নয়, মানসিকভাবে প্রচণ্ড খাটতে হয়েছে এবং এটাকে আমাকে দাঁড় করাতে হয়েছে। কদ্দূর দাঁড়িয়েছে সে আমি জানি না, কিন্তু মিঞা কথা হইত্যাছে, যে খাটছি আমি।" অথচ এ কথাও বারবার বলছেন, "...বাংলার ভাগটাকে আমি কিছুতেই গ্রহণ করতে পারিনি। আজও পারি না। আর ঐ তিনটে ছবিতে (মেঘে ঢাকা তারা, কোমলগান্ধার, সুবর্ণরেখা) আমি ও-কথাই বলতে চেয়েছি। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও হয়ে গেলো একটা 'trilogy'.

এই মুদ্রাদোষটি থেকে তিনি সচেতন বা অবচেতনে কখনও রেহাই পেতে চাননি। তাই আমৃত্যু সেটি তাঁর হৃদয়লগ্ন হয়ে থেকে গিয়েছিলো। একজন শিল্পীর ক্ষেত্রে একে 'সীমাবদ্ধতা'র চিহ্ন হিসেবে গণ্য করা যায়। যদিও ঋত্বিক আজীবন দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে সৃজনশীলতার ক্যাথার্সিস খুঁজেছেন। সেটি সত্যজিৎও  স্বীকার করেছিলেন।  

--------------------------------------------

“...Film is not made, film is built”। ঋত্বিক এই উক্তিটি ধার করেছিলেন  আইজেনস্টাইনের থেকে। তিনি যে সত্যজিতের মতো হলিউডি মডেলে বিশ্বাস করেন না এবং তাঁর রচনার সঙ্গে রুশ ক্ল্যাসিক ছবিগুলি মেলে তা স্বয়ং সত্যজিৎই বলে গেছেন, তাই তা জজেও মানে। তাঁর ছবি করার উৎস এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে ঋত্বিক বলেছিলেন, "...আইজেনস্টাইন না-থাকলে আমরা কাজ-কম্মর 'ক'ও শিখতাম না। উনি আমাদের বাবা। আমাদের পিতা। তাঁর লেখা, তাঁর thesis এবং তাঁর ছবি - এগুলো ছোটবেলায় আমাদেরকে পাগল করেছিল। এবং তখন ওগুলো আসত না। বহু কষ্টে লুকিয়ে-লুকিয়ে নিয়ে আসা হত। এই আইজেনস্টাইন... সত্যজিৎ রায়কেও আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন, he will admit, that, he is the father of us." এর পরে তিনি নাম নিয়েছিলেন পুডোভকিন, কোজিনেৎসভ বা তারকোভস্কির। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ভিতরের অ্যানার্কিস্ট মুগ্ধ হয়েছিলো আরেকজনের প্রভাবে। অবাক হবার মতো কিছু নেই যদি তাঁর কাছে বুনুয়েল  শ্রেষ্ঠতার শিরোপা দখল করে নেন। যে স্ফুর্তির সঙ্গে তিনি বুনুয়েলের শিল্পকে বরণ করে নিয়েছিলেন, তাঁর থেকে এর জুড়ি আমরা আর পাইনি।

“আমার মতে বর্তমান চিত্র-পরিচালকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন লুইস বুনুয়েল। তাঁর চার-পাঁচটি ছবি আমি দেখেছি। ছবিগুলি আমাকে একেবারে পাগল করে দিয়েছে। বুনুয়েল-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিশৃঙ্খলা এবং তার মধ্যে দিয়ে আমাদের একটা ছন্দে পৌঁছে দেওয়া। তিনি আমাদের মতো সাধারণ পরিচালকদের ভঙ্গিতে গুছিয়ে শট তোলেন না বা গুছিয়ে গল্প সাজান না। মনে হবে যেন তিনি পরম অবহেলায় ছবি তুলেছেন অথচ প্রায়শ এক-একটি মারাত্মক মুহূর্তে তিনি আমাদের নিয়ে যান যা রীতিমতো স্তম্ভিত করে দেয়।

...ওঁর থেকে বড় ছবির শিল্পী আমার মতে কেউ নেই বর্তমানে”।

--------------------------------------

স্ববিরোধের অন্য নাম ঋত্বিক। হয়তো সেটা বিরোধিতাই নয়। দ্বান্দ্বিকতা ও ভারতীয় ঐতিহ্যমুখী ব্যক্তিমানসের বিবর্তনে ইতিহাস, ঐতিহ্য বা মিথস্ক্রিয়ার ভূমিকা, ব্যক্তি তথা সমষ্টির সৃজনশীলতার প্রক্রিয়ায় তার প্রতিফলন এবং এ প্রসঙ্গে ইয়ুং সাহেবের তত্ত্ব অনায়াসে মিলেমিশে গেছে। তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করছেন, "...ইয়ুং-এর সঙ্গে মার্ক্স-এর কোন বিরোধ নেই, দু'জনে দুই জগৎ নিয়ে কারবার করেছেন। দুটো প্রচণ্ডভাবে পরিপূরক। আমার ছবিতে ইয়ুং-এর যে-ব্যাপারটা প্রচণ্ডভাবে আসে, সেটা হলো ঐ mother complex. আমাকে আমার এক বন্ধু বলেছিলো, তোকে মা’য়ে খেয়েছে। আমার সব ছবিতে ঐ মা এসে পড়ে - তা মায়ে খেয়েছে কেন? এই 'যুক্তি তক্কো' ছবির entire ছৌ নাচটার raison d'etre হচ্ছে মা - mother complex. এখানে ঐ মেয়েটাকে, শাঁওলিকে তার সঙ্গে equate করো, জ্ঞানেশ বলছে নাচো, তোমরা নাচো, তোমরা না নাচলে কিছু হবে না। এটা সম্পূর্ণ Jungian, 'তিতাস'-এ ছেলেটা স্বপ্ন দেখে মা-কে ভগবতী রূপে, এই mother complex একটা basic point."  উত্তর আধুনিক পরিপ্রেক্ষিত ও ভারতীয় শিল্পবোধের নিরিখে এই উক্তির ব্যাখ্যা আজকের গুণগ্রাহীর বিচারে অনেক সহজবোধ্য হয়ে গেছে। তিনি বহুবার ওয়াজেদ আলি সাহেবের 'ট্র্যাডিশন' বিষয়ক অতি পরিচিত পরিভাষাটি উল্লেখ করেছেন তাঁর আলাপচারিতায়। বছর পঞ্চাশেক আগে যা নিশ্চিতভাবেই স্ববিরোধের সূচক ছিলো, কিন্তু আজ স্বপ্রতিষ্ঠ।

-------------------------------------

আইজেনস্টাইন বা বুনুয়েল, অনুপ্রেরণা হিসেবে তিনি যাকেই গ্রহণ করুন না কেন, 'আবেগপ্রবণতা'র 'পিছুটান' তাঁকে সতত আচ্ছন্ন করে রাখতো। বস্তুত তাঁর রচনার বিরুদ্ধে আমাদের যে প্রধান অভিযোগ, সেটাও তো তাই। আবেগের বশে মেলোড্রামার আধিক্য। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজে কী বলেন একবার দেখে নেওয়া যাক।

“...আসলে ছবি করার সময় অন্য কোন শক্তি ঢোকে। তার প্রথমে থাকে আবেগ,  আবেগই চালিত করে। সমস্ত ব্যাপারটা আবেগ থেকে আসে। যার আছে, তার আছে, যার নেই, তার নেই। এ হল ভেতর থেকে উৎসারিত। যে কোন শিল্পকর্ম সম্পর্কে এ কথা খাটে। লোকে গ্রহণ করুক অথবা না করুক। যে-দিন থেকে দর্শকরা screen ছিঁড়ে দিল, সেদিন থেকে চুল পাকতে শুরু হল”।   

অতএব ঋত্বিক সচেতনভাবেই আবেগকে চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছেন। আমরা যারা সিনেমার মূল্যায়নে য়ুরোপীয় নন্দনতত্ত্বের ধ্যানধারণার প্রতি  অধিক বিশ্বস্ত, তাদের মন্ত্র, আবেগ ভৃত্য হিসেবে উত্তম হলেও প্রভু হিসেবে তার ভূমিকা নৈব নৈব চ। আবেগের বন্ধহীন প্রকাশ মানে মেলোড্রামার 'স্থূলতা'। পরিভাষা হিসেবে 'মেলোড্রামা' শব্দটির মূল ঊনিশ শতকের ফরাসি গীতিনাট্য, মূলত অপেরার পরিবেশনার সঙ্গে জড়িত। যেহেতু প্রসেনিয়াম থিয়েটার বা ছায়াছবি দুইই আমাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, তাই এই শব্দটিকে আমরা 'অতি'নাটকের আখ্যা দিতে ব্যবহার করি। এই 'অতি' নাটকের উপাদান কী কী হতে পারে?

 ১. সমাপতনের ঘনঘটার প্রতি অধিক নির্ভরতা।

২. যে কোন মানুষী সংবেদ প্রকাশ করার সময় মন্দ্রসপ্তকের প্রতি ভরসা না রেখে তারসপ্তকের প্রতি অধিক বিশ্বস্ত হয়ে পড়া।

 ৩.  নীতিকথা প্রতিষ্ঠা করার অদম্য উৎসাহে পরিবেশনার সূক্ষ্মতর দিকগুলির প্রতি উদাসীন থাকা।

 এই লক্ষণগুলি পরিহার করার প্রতি অতিরিক্ত মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীয়তা আমরা পশ্চিম থেকে শিখেছি। যেহেতু সিনেমা একটি সম্পূর্ণ পশ্চিমী মাধ্যম, তাই দীর্ঘদিন আমরা বিশ্বাস করেছি যে পশ্চিমের তৈরি করা (বিশেষত হলিউডের) 'ভালো সিনেমা'র মডেলটিই আমাদের অনুসরণ করা উচিৎ। ঋত্বিক এই মডেলটির প্রামাণ্যতা অনেকাংশেই স্বীকার করেননি, তাই মারি সিটনকে তিনি প্রভাবিত করতে পারেন না। বাংলা ছবিতে ঋত্বিক চিরকাল নিজস্ব মুদ্রা আবিষ্কার করার তাড়নায় অস্থির থেকেছেন।

(ক্রমশ) 

 

 


1 কমেন্টস্: