কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

দেবাশিস মল্লিক


 ফাইটার     

 

শিউলি গাছটা দেখে লোকটা বললো, ‘মরা গাছ রাখতে নেই, সংসারে ঘোর অমঙ্গল হয়।’ হঠাৎ করেই গাছটা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে, অথচ গত কুড়ি পঁচিশ বছর ধরে অবিশ্রান্ত ফুল উপহার দিয়ে গেছে। শরতে, হেমন্তে প্রতিদিন অন্তত দেড়শো দুশো ফুল দিয়ে গেছে, যেটা বছরের অন্যসময় হয়তো ক’মে ত্রিশ চল্লিশটায় দাঁড়াতো। সারাবছর গাছ ঝাঁকালেই কিছু না কিছু ফুল পাওয়া যেত! এত ফুল যে ঠাকুরঘরে পুজোর কাজে, বসার ঘরে সেন্টার টেবিলে রেখে কিংবা আশেপাশের বাড়িতে বিলিয়েও শেষ হতো না, গাছতলায় ফুল পড়ে পড়ে জায়গাটা গন্ধে বিভোর হয়ে থাকতো! শিউলির গন্ধে কি ‘মা’ শব্দটা থাকে? সেই ছোটোবেলায় মা যখন রোজ বিকেলে গা’ ধুয়ে সন্ধ্যে দিত, কাপড়ের খসখসানি, চুড়ির শব্দ, পাউডারের গন্ধ, ধূপের ধোঁয়া আর ফর্সা কপালে গোল সিঁদুরের টিপ এসমস্তই শাঁখের আওয়াজের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত! মা ভালো নেই। বেশ ক’দিন হলো আই সি সি ইউতে ভর্তি আছে। সারাজীবন পাঁজি দেখে  নানা বারব্রত, উপোস করে চলা মা এখন শাঁখ, প্রদীপ, ধূপধুনোর জগৎ থেকে অনেকটা দূরে। মাকে ঘিরে বিচিত্র যন্ত্রপাতি, হাজারো নল, সর্বক্ষণ বিপ্‌ বিপ্‌, ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ হয়ে চলেছে। মা এখন নিজে খাবার খেতে পারছে না। আয়া দিনে  চারবার রাইল্‌স টিউবে খাওয়াচ্ছে একঘেয়ে কমলা রঙের তরল। অচেতনে তলিয়ে যেতে যেতে মা চলে গেছে কোন্‌ সুদূর অতীতে। অস্ফুটে কিছু বলছে কি?  কান পেতে শুনছি শ্লেষ্মাজড়ানো মায়ের ডাক, ‘ওরে, রান্নাঘরে তিনজনের ভাত  চাপা দেওয়া আছে, খেয়ে আয় তোরা!’ ইলেকট্রনিক গ্যাজেট শোভিত ঝাঁ চকচকে মডিউলার কিচেনের আকর্ষণে এ রান্নাঘর তো আমরা হারিয়ে ফেলেছি কবে! বুকটা মুচড়ে ওঠে। বাড়ি ফিরে চলে যাই শিউলি গাছটার কাছে, দেখি শীর্ণ ডালগুলোর একেবারে ডগার দিকে দুটো একটা সবুজ পাতা এখনো! হাত বুলিয়ে চুপিচুপি বলি ‘ফাইট মা, ফাইট’!    


3 কমেন্টস্:

  1. অনবদ্য লাগল।
    আপনি একটা প্রজন্মের কথা লিখে রাখলেন, যে প্রজন্ম আজও মেয়েদের গুরুত্ত বোঝে।
    আমাদের মায়েরা শিউলির সুবাসের মতনই অমূল্য - এ কথা আমরা নানা কাজে মাঝে মধ্যেই অবজ্ঞা করে ফেলি। কিন্তু তাদের চোখে যতক্ষণ প্রাণ থাকবে, ততক্ষণই সংসারে যোতি, না হলেই বন্ধ দরজা - জানালা, ঝুলে ভরা চৌকাঠ আর শূন্য রান্না ঘর। বাড়িতে বাড়িতে আলোর মশাল জ্বেলে মায়েরা লড়াই করে যাক। প্রাকৃতিক ধ্বংসস্তূপে বসে ওই ওইটুকু সবুজের আভা আমাদের প্রজন্ম কে এক অদম্য সংগ্রামের আশ্বাস দিচ্ছে।

    উত্তরমুছুন
  2. পড়ে শুধুই কাঁদলাম খানিকক্ষণ..ঠিক আমার মায়ের গন্ধ মাখা লেখা। সে ও যে ICCU তে ভর্তি তবে ভেন্টিলেশনে রাখা। মা তো এখনো ফাইট করে যাচ্ছে..!
    আপনার সমব্যথী হলাম।

    উত্তরমুছুন