ধারাবাহিক
উপন্যাস
দূরত্ব
(নয়)
চলমান এক অসুখ। যে ছিল আমাদের জীবনের ছায়া সঙ্গী। আমি বললাম, কস্তূরীর দিকে তাকিয়ে।
কস্তূরী আমাকে দেখিয়ে শৈলেশের হাতে বানানো কাশ্মীরি পোলাও খেতে শুরু করে দিল। কিন্তু আমার মনে হল আজ হয়তো শৈলেশের হাতে বানানো কিছু খাওয়ার থেকে আমরা যদি তার বউয়ের বা তার ফিয়ন্সের হাতে বানানো কিছু খেতে পেতাম তাহলে বেশি স্বাদ হত।
কস্তূরী আমাকে বলল, আমার বাবার যে এত সব বই আছে। বা শৈলেশের তোলা এত সব ছবি। বা আমার রান্নার রেসিপির বই। বা এত কসমেটিক্স। সে সব কি তোমার কাছে কোনো দাম আছে।
বললাম,
নেই
সে
বলল তাহলে, সব কিছু ফালতু কেমন।
বললাম, তা কী করে হয়। আমি বুঝি না তো কী হয়েছে, কেউ তো বোঝে। যে বোঝে তার কাছে তার দাম।
কস্তূরী বলল, তাহলে তোমার দিস্তা দিস্তা কাগজ, আর ওই ভাঙা ল্যাপটপের কতটা দাম তুমি চাও। বিক্রি করবে তো দেখো বাইরে, কেউ কিনতে চায় কিনা। একে যদি অসুখ বল তো অসুখ না হলে, আমাদের মাঝের বিজনেস ডিল।
বললাম,
তাহলে তোমার কি মনে হয় না, যে শৈলেশের এবার এমনই একটি ডিলের দরকার হয়ে পড়ছে?
কস্তূরী
বলল, সে তো সেই বলতে পারে, আমি কেন বলতে যাব।
সেই কেনর কোনো উত্তর কোথাও যেন নেই, কেউ তেমন এই সব উত্তরের পিছনে খুব বেশি সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। তাও আমি সে সব কথা যেন এড়িয়ে যেতে পারি না। আমাকে টানতে থাকে সে রাতের পর রাত। সেই যে ছেলেটির কথা বলেছিলাম, আমার আগের কোম্পানির সেই ছেলেটি, যে খুব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে পারতো। আর এক নারী থেকে খুব সহজেই চলে যেতে পারতো অন্য নারীতে। অবশ্য তারা কিন্তু সবাই খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। যারা সবাই ভাবতো ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে পারবে তাদের। আসলে সেখানে কিন্তু ভালোবাসার অপ্রতুলতা ছিল না। বরং সেখানে ভালোবাসার প্রতি যে টান থাকার কথা সেখানেই ছিল কিছুটা গোলমাল, বা তার কাছে প্রকৃত অর্থহীন। সে এক মেয়ের সাথে খুব বেশি দিন ধরে কথা বলতে পারতো না। বা খুব বেশি দিন ধরে একই মেয়ের সাথে একই কথা বলা ছিল তার কাছে অসহ্য। যদিও খুব বেশি দিন আমি সেই ছেলের সাথে থাকিনি। তবু আমার মনে হয়েছিল হয়তো খুব বিষণ্ণ ছিল সে ভিতরে ভিতরে। এই বিষণ্ণতাবোধ তাকে ঠেলে দিত এক মেয়ে থেকে অন্য মেয়েদের দিকে। মনে হত আমার প্রতিবারেই সে হয়তো কোনো একটা সীমা অতিক্রম করতে চাইতো। যা সে আগে করেনি, তাই লাইফ রিক্স নিতে চাইতো সে। কোনো একদিন কোনো এক সময় খুব নেশার ঘোরে সে আমাকে বলে ফেলেছিল। কোনো রকম গভীরতায় তার বিশ্বাস নেই, তাই পারে এক মেয়ে থেকে অন্য মেয়েতে চলে যেতে। যেখানে সেই সব মেয়েরাও জানে যে এই ছেলে কখনওই তাদের বিয়ে করে লাইফ পার্টনার করবে না। বরং সে বলেছিল একবার প্রবিষ্ট হওয়ার পরেই তার মনে হত যে, আর কিছুই তার কাছে রইলো না, যা সে এই মেয়েটিকে দিতে পারে। বরং তার কাছে অনেক বেশি আনন্দের ছিল, যে কাজ সাধারণত সবাই যখন ভয় পাচ্ছে, তার নিজের মধ্যে সেই ভয়কে অতিক্রম করা। যদিও সেই সামান্য মুহূর্তই সে তার বিষণ্ণতাকে অতিক্রম করতো।
শৈলেশও কি তেমনই কিছু একটা চাইছিল? আমাদের কাছে যা সে কোনোদিন বলে উঠতে পারেনি। আমাকে সে প্রথম থেকেই কিছুটা গুরুজনের স্থানেই রেখেছিল। তার মা বা বাবার থেকে একবারে অন্য মেরুতে গিয়ে। এক সন্ধ্যের পরে, এক ফাঁকা সময়ে, যদিও ফাঁকা সময় বলতে কিছু হয় না। আমি তার কাছে এমনই কিছু কথা রাখলাম। বললাম, আর কোথাও কেউ থাকুক বা না থাকুক আমাদের মনে কথা থাকবেই।
শৈলেশ কিন্তু উঠে চলে গেল না, বা মনের দরজা খুলে দেখাও না আমাকে। যেমন বসে ছিল তেমনই বসে থাকলো, শুধু তার সিগারেটের প্যাকেটটা প্রথমবার বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। তারপর মুখে বলল, আমি অতসব পাপ বা পুণ্য নিয়ে কোনোদিন এত ভাবিনি। বলতে গেলে কিছুই ভাবিনি এখনও পর্যন্ত। যা আমার সামনে এসেছে আমি খুলে দেখেছি কী আছে সেখানে। যা বাস্তবে স্বর্গ বা নরকের মাঝে যে কোনো একটি জায়গা হতে পারে।
আমি
বললাম, এমন ফ্যামিলির ছেলে হয়ে তুমি কীভাবে স্বর্গ আর নরকের জায়গা নিয়ে ভাবতে পার।
সে
বলল, স্বর্গ বা নরক কোনও জিওগ্রাফিক্যাল প্লেস নয় বরং ষ্টেট অফ মাইন্ড।
আমি বললাম, তাহলে তুমি কি বলতে চাও দুঃখ আর আনন্দের মতো স্বর্গ আর নরকও তোমার সাথে সাথে চলাফেরা করে।
সে বলল, জানি না, যখন আমি ভাবতে থাকি, এবার হয়তো সবকিছু ছেড়ে আমি ভালোবাসার রাস্তায় হাঁটতে পারবো, তখনই ওপ্রান্ত থেকে আমার দিকে ছুঁড়ে দেয় এক বিষণ্ণ বাসিফুল। যা আমিই হয়তো গতরাতে তাকে দিয়েছিলাম।
বললাম,
তারপর তুমি কী কর?
সে
বলল, তারপর আমি আবার নতুন ফুল আর নতুন মেয়ের দিকে হাঁটতে থাকি।
বললাম, নিজের বাবার কথা তুমি ভাবো না?
সে বলল, ভাবি কিন্তু যে মুহূর্তে আমি নিজেকেই ভুলে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। সে সময় সমস্ত কিছুই আমার কাছে অ্যাবসার্ড। মনে হয় প্রেমের পরিণতি শুধু ব্যর্থতায়। ব্যর্থতা একটু একটু করে জীবনের রংগুলির সাথে নিজেদের পরিচয় করিয়ে দিতে থাকে। না হলে জীবনটাও রং-হীন মনে হবে হয়তো। আর একটি ধবধবে সাদা চাদরের উপর শুয়ে জীবন কাটানোর থেকে, অনেক ভালো কিছুটা ময়লা হলেও সামান্য রং নিয়ে বেঁচে থাকা।
আমি
বললাম, কটা রং তুমি দেখতে চাও?
সে
বলল, অন্তত সবকটি।
আমি
বললাম, দেখো সে সব রং কিন্তু অনেক প্রতিকূলতার সাথেই দরজায় কড়া নাড়ে।
সে বলল, জানি কিন্তু সেই সব প্রতিকূলতার সাথে লড়াই ছাড়া জীবনের আবেগগুলি মেলা খুব দুষ্কর।
বললাম, তাহলে কী বলতে চাইছ তুমি, স্পষ্ট হচ্ছে না। সবকিছুই যদি ব্যর্থতার মধ্যে খুঁজতে থাকো তবে জীবনটাই তো প্রতিকূল হয়ে উঠবে। সে জীবনে বেঁচে থাকার মতো কিছু কি থাকবে অবশিষ্ট?
সে বলল, আমি জানি না এবং কোনো কিছু অবশিষ্ট রাখাও আমার চাহিদা নয়। আসলে কিছুই আমি প্রায় রেখে যেতে চাই না, যা কিছু আমি তৈরি করছি আমিই সবকিছু শেষপর্যন্ত ভোগ করতে চাই। আর তার জন্য সব থেকে যা প্রয়োজন তা হল নিজেকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা। আমি যদি আমাকে ভুলে যেতে পারি তবেই সুইসাইড থেকে দূরে থাকতে পারবো। সব যদি মনে করতে চেষ্টা করি, তবে হয়তো আমি, নিজেকে শেষ করার চেষ্টা থেকে সরে আসতে পারবো না।
বললাম, তুমি কি জীবনটা কোনও একজনকে দিতে রাজি নও?
শৈলেশ আমার দিকে ঘুরে তাকাল এবং তার দৃষ্টি ছিল কিছুটা অর্থময়। যা হয়তো আমি অনুমান করতে পারছিলাম। সে আমাদের সম্পর্কের দিকে আঙ্গুল তুলতে চাইছিল।
যাইহোক আমাদের এই ভাগ করা দেশের এপ্রান্তে আমি আর সাথী ওপ্রান্তে কস্তূরীর বাবা। আর মাঝখানে সেই সীমারেখা যেখানে শৈলেশ তার সুইসাইড পয়েন্ট ঠিক করেছিল। যখনই আমার বাবার কথা মাথায় এসেছে মনে হয়েছে তার জীবনেও কি কোনও সাথীর প্রয়োজন ছিল? যখন এমনই সাধারণ একটি মেয়ে আমাকে এক ভার্চুয়াল জগতের মাঝে নিয়ে যাচ্ছে। আমি একটি চেয়ারে বসে বসে আধশোয়া ভাবে দেখে যাচ্ছি সাথীর রাত আর দিনের ব্যবধান। জানি না সে কখন উঠে এসেছে আর আমার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসেছে। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি তার হারানো যৌনসাথী। কিন্তু সে জানে বাস্তবে আমি এক মিথ্যে। সে বলেছিল আমি যেন বসে থাকি আর দেখতে থাকি তাকে। অথচ সে উঠে এসেছে আর হাত রেখেছে আমার হাঁটুতে। তন্দ্রার মতো ছিল, কিন্তু তাও আবার ভেঙে যেতে যেতে আমার ভিতরটা মোচড় দিয়ে বলে উঠলো, আজ রাতের মতো কি তুমি তার সাথে তোমার আত্মার বিনিময় করতে পার? উত্তর নেই বা বলা যেতে পারে উত্তর হয় না। শুধু বোঝা যায় আমি উঠে যাচ্ছি, ধীরে ধীরে তার হাত ধরে, আর সে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে তার হারানো দেনা পাওনার দিকে। তাহলে আমিও কি বহুগামী হয়ে নিজের বিষণ্ণতাকে জয় করতে পারবো। যেখানে এসে কস্তূরীর বাবা তার স্বেচ্ছা নির্বাসনে দ্যাখে, তার অভিজ্ঞতার ঝুলি একেবারে ফাঁকাই রয়ে গেছে। আর একটি ওল্ডেজ হোমের দেয়ালে কিছু সিপিয়া ছবি ফুটে উঠেছে।
আমি ধীরে ধীরে তার দিকে এগোতে শুরু করি। সে খুব স্থির ভাবেই যেন আমাকে টানতে থাকে। তারপর সে শুয়ে পড়ে বিছানায়। বালিশে মাথা দেওয়ার সাথে সাথেই যেন ঘুমিয়ে পড়ে। আলগোছে একটি হাত বাড়িয়ে রাখে তার ছেলেটির দিকে। যেন ছেলেটিকে দেখাতে চাইছে, দেখো কী সুন্দর, তোমার দিকে বাড়িয়ে রেখেছে তার ছোট্ট ছোট্ট হাত। কোলে নিতে পার, বা বুকে জড়িয়ে ধরতে পার। আমি স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু কীভাবে সম্ভব, এই আমি তার ডাকেই হেঁটে এসে এখানে দাঁড়িয়েছি। সেই তো আমাকে ডেকে এনেছিল এখানে। তাহলে এভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারে কীভাবে। আমি এক মূঢ়। বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে তাদের দু’জনকে দেখে যাচ্ছি। তার মাথার নিচে খুব পাতলা এক বালিশ। মাথার চুল এলোমেলো হয়ে নেমে এসেছে মুখের উপর। গায়ের কাপড় আলগা হয়ে নেমে এসেছে কিছুটা। আমি দেখতে পাচ্ছি। বাস্তবিক সে কি ঘুমিয়ে পড়েছে, নাকি ঘুমের অভিনয় করে চলেছে এভাবে? একটি শীতল পাথরের মূর্তি যেন নিজেকে বিছিয়ে রেখেছে আমার চিন্তার চেতনার ভিতর। আমার তপ্ত শাণিত সাহস কোনোরকম ঝুঁকি নেয় কিনা। কোনোরকম ভুল করে বসে কিনা, যেন এক ট্র্যাজিক মুহূর্তের দিকে ফিরে যাওয়া অভিশপ্ত দেবতা। কিছু ভুল করার জন্য বসে আছে। তাকে ফিরে যেতে হবে তার এই মাটির পৃথিবীর দিকে। হয়তো তার জীবনের একই দৈন্যদশার দুটি বিপরীত দিকে বসে আছে দুজন নারী। তুমি যেদিকেই যাবে ফিরে পাবে একই রকম প্রেমহীনতা।
তবে কি আমার জন্য কিছু পাথরের মূর্তি অবশিষ্ট রয়েছে? আমি দূরে সরে আসি, দূর থেকে দেখি সত্যিই কি আমার কল্পনা আমাকে আঘাত করার জন্যই সৃষ্ট?
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন