কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

নিবেদিতা আইচ

 

সমকালীন ছোটগল্প


শালিক জীবন

 

(এক)

 

কোচড় ভর্তি বউশাক নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই মহামায়ার কপাল কুঁচকে গেল। কোত্থেকে একটা মরাপাখির ছানা মুখে করে এনেছে হতচ্ছাড়া বেড়ালটা। হাতের কাছে ঝাঁটা পেয়ে ছুঁড়ে মারতেই একছুটে পালাল। কুকুর বেড়াল ওর দু'চক্ষের বিষ হলেও তিনবেলার এঁটোকাঁটাগুলো রোজ রোজ উঠোনের কোণে বরই গাছের তলায় রেখে আসতে ভুল হয় না ওর

বাড়ির কর্তা হরিদাসের ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা। লোকটার স্নান হয়নি এখনো। দু'দিন ধরে পায়ের ব্যথাটা খুব বেড়েছে। মহামায়া গিয়ে না ধরলে একা একা ওঠাবসা করা মুশকিলই হয়ে যায়। লোকটা ঘরের ভেতর থেকে চেঁচাতে থাকে।

আইগন্যাত কী ফেলাইছে রে? অ বিশু এই পাকে আয়...

ঝকঝকে নিকানো ‘আইগন্যা’য় শালিকছানাটা তখনো ওভাবেই পড়ে আছে। মহামায়া রা করে না। নিজের মনে কাজ করতে থাকে। সে আর কত দেখবে!

সকাল থেকে মনের মধ্যে কুডাক ডাকছে। পাখিটাকে দেখা অব্দি বুকটা কাঁপছে ওর। মনে মনে ঠাকুরের নাম জপে মহামায়

বিশুকে ডাকাডাকি করে হরিদাসের কাশির দমকটা বাড়ে। সারারাত ঘুমোবার জো নেই, সকাল সকাল এই এক ঢোলের শব্দে মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে ওঠে মহামায়ার।

ব্যাটাটা যে বাড়িত নাই ভুলি গেইচেন? এমন করি ডাকে কী হইবে?

সাথে সাথে হাঁকডাক থেমে যায়। মহামায়া শাকে ফোঁড়ন দিতে দিতে ছেলের কথা ভাবে। বিশুটা ঠিক মতো পৌঁছুলো কিনা জানার জন্য দীপেন সাহার দোকান থেকে একবার ফোন করা দরকার। স্কুলের পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই মামার বাড়ি রওনা দিয়েছে ছেলেটা। মহামায়া পইপই করে নিষেধ করেছিল। এত টানাটানির মধ্যে অতগুলো টাকা খরচ করে বেড়াতে যাওয়ার মত বিলাসিতা ওদের মানায় না। তাছাড়া খালিহাতে ঐ বাড়িতে গিয়ে মামীর বাঁকা কথাও শুনতে হবে ওকে।

না করা সত্ত্বেও ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটা। মহামায়া তখন বলেছে- যা এ্যালায় যা। তোর জইন্যে মিষ্টি নিয়া বসি আসে ওমরা।

তারপর সত্যি সত্যি সেদিন দুপুরেই রওনা হলো ছেলে। পড়ন্ত বেলায় ওর দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল মহামায়ার। ছেলে আর ছোট নেই। তবু বয়সকালের সন্তান বলে হয়ত ওকে নিয়ে অহর্নিশি একটা দুশ্চিন্তা লেগে থাকে। বড় আদরের ছেলে বিশু, ঘরের টুকটাক সমস্ত প্রয়োজনেও ওকেই পাওয়া যায়। দিনরাত এ বাড়িতে এই একটা নামই বারবার উচ্চারিত হয়।

অ বিশু, শুকান কাপড়গুলা তুলি আন!’

বিশু বালতি ভত্তি করি জল আনি দে দেখি

এক দৌড় দিয়া নুন আনি দে বাপ।

কলাইঘাটের চিনিকলে চাকরিটা হবার পর থেকে মেজোছেলে নিশীথ বাড়িতে খুব একটা থাকে না। তার উপর কিছুদিন হলো বউ নিয়ে ওখানেই সংসার পেতেছে। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেলেছে, সেও আবার দাদার আগে! এই নিয়ে সংসারে কম অশান্তি হয়নি। বিয়ের পর নিশীথ মাসখানেক এ বাড়িতে ছিল। হাড়জ্বালানি বউ হয়েছে ওর। নিয়ম করে কানপড়া দিত নিশিকে। ছেলে প্রতিদিন বাড়ি ফিরে তুমুল ঝগড়া করতো বাপমায়ের সাথে। শেষমেশ মহামায়াই ওদের চলে যেতে বলেছে। দূরে থাকুক তবু সম্পর্ক তিক্ত না হোক। সেদিনের পর থেকে নিশি সহজে এদিকটায় পা মাড়ায় না। হরিদাস প্রায়ই বলে-ছাওয়া পোয়াক বেশী নেকাপড়া করা ভালো নোয়ায়।

মহামায়া ভালো খারাপ বুঝে উঠতে পারে না। হরিদাসের পায়ের রোগটা বেড়ে গিয়ে যখন প্রায় পঙ্গু হয়ে যাওয়ার দশা তখন অল্পবয়সে সংসারের হাল ধরেছে বড়ছেলে আশু। তাই সে পড়াশোনা বেশিদূর করতে পারেনি। তাতে বিশেষ কোনো লাভও হয়নি'দিন পরপরই ছেলেটা কামলা দিতে চলে যায় দূর শহরে। কখনো কখনো মাস পেরিয়ে যায়, ফেরার নামগন্ধও থাকে না ওর।

আজকাল আর ওদের অপেক্ষায় থাকে না মহামায়া। সব অভ্যাস হয়ে গেছে। শুধু মাঝে মাঝে ভরসন্ধ্যায় হরিদাস যখন ‘হা ভগবান!’ বলে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ভয়ে তখন হাত-পা সিঁটিয়ে আসতে চায় ওর। মুক্তির অপেক্ষায় আছে লোকটা! এতদিন ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থেকে এখন কেন মরতে চায়? বিশুটা তো ছোটই এখনো। আর আশুকেও বিয়ে-থা দিয়ে সংসারী করা বাকি। সবকিছু কি তাহলে ওর একার দায়?

রাগে দুঃখে চোখে অন্ধকার দেখে মহামায়া। এত স্বার্থপর লোকের পাল্লায় ওকেই পড়তে হলো? সেই বছর তিরিশ আগে নতুন নতুন সংসার করতে এসেই ঘানি টানার শুরু। লোকটাকে শেষ কবে সুস্থ সবল দেখেছে মনেও পড়ে না আজকাল। মহামায়া সন্ধ্যাবাতির আলোয় গলায় আঁচল পেঁচিয়ে ঠাকুরকে ঘন ঘন প্রণাম করে আর হাপুস নয়নে কাঁদে।

হাজারবার ডেকেও এসময় বিশুর সাড়া পাওয়া যায় না। ছেলেটা হয়তো তখনো ন্যাড়াখালের পারে বন্ধুদের সাথে কাদার মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মরাসন্ধ্যার আঁধারে গা ছমছম করে ওঠে মহামায়ার। আর বিশুর জন্য মনটা কেমন করে। আর কেউ নয়, ষোল বছরের এই ছেলেটাই যেন ওকে এই খাবি খাওয়া বিষণ্ণ সময় থেকে উদ্ধার করতে পারে!


(দুই)


শীতলিয়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে বিসমিল্লাহ হোটেলের সামনে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হলো বিশুকে। মধ্যদুপুরের কড়া রোদে চোখ মেলতে বেগ পেতে হয় তবু  ইতিউতি তাকিয়ে যতদূর দেখা যায় দেখে নেয় বিশু। একটু ইতস্তত করে ইদ্রিস আলীর নম্বরে ফোন করে। যা যা জানার ছিল জেনে নেয়। ফোন রাখার আগে আবার রাসেলের কথা জিজ্ঞেস করে লোকটা। এবার আর এড়াতে পারলো না বিশু। জানাতেই হলো ব্যাপারটা।

রাসেলের উপর খুব বিরক্ত সে৷ গতকাল রাতেই শীতলিয়ায় এসে পৌঁছুনোর কথা ছিল দুজনের। এতদিন ধরে শলা পরামর্শ করে দিনতারিখ ঠিক হবার পর রাসেল যে এভাবে বেঁকে বসবে কে জানত! খামোখা একটা দিন মাটি হলো। যাক গে, বিশু এখন শুধু নিজের ভাবনা ভাববে। তিন সপ্তাহ খেটেখুটে দাদনের টাকাটা শোধ করলেই ওর মুক্তি। এরপর ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফেরা।

মায়ের কথা মনে পড়ে ওর। দীপেন সাহার দোকান থেকে মা ফোন করেছিল। বিশুর খারাপ লেগেছে মিথ্যে বলতে। তবু বলেছে সে এখন গৌরডাঙ্গায় মামাবাড়িতে। শীতলিয়ায় কামলা দিতে এসেছে জানলে মানুষটা খুব দুঃখ পাবে। তবে ব্যাপারটা কতদিন চাপা থাকবে জানে না সে। পাঁচ ছ’দিন পেরুলেই মা নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরতে বলবে ওকে।

এ.বি.এল ইটভাটার সামনে এসে দাঁড়ায় বিশু। যা দেখে তাতে ভেতরে ভেতরে দমে যায়। ওর সমবয়সী প্রায় জনা পঞ্চাশেক ছেলে মাথায় ইট বয়ে নিয়ে চলেছে। কী আশ্চর্য ভারসাম্য ওদের! এত দ্রুতগতিতে হাঁটছে সবাই অথচ একটা ইটও ফসকে যাচ্ছে না। বিশু কখনো তেমন কোনো পরিশ্রমের কাজ করেনি।

হাঁটার গতি বাড়ায় বিশু। খোয়া বিছানো পথে আরো মিনিট তিনেক হাঁটার পর দেখতে পায় সুবিশাল ছাতা মেলে দিয়ে টেবিল চেয়ার জড়ো করে কয়েকজন বসে আছে। তাদের মধ্যে ইদ্রিস আলীকে চিনে নিতে কষ্ট হয় না ওর। ভয়মিশ্রিত সালাম ঠুকে বিশু। ওকে আপাদমস্তক জরিপ করতে করতে লোকটা বলে- অই, তুই কি পারবু? ফু দিলে উড়ি যাইবে এমন শরীর!

পারিম স্যার... তোমরা চিন্তা করেন না।

সোনারচান, কেমন করি পারাইতে হয় সেইটা মোর জানা আছে। তোমার রাসেল আর কেরামতোক কেমন করি সাইজ করোছো দ্যাখ খালি।

বীভৎস একটা হাসি ছুঁড়ে দেয় লোকটা। টাকার জন্য এরা নাকি খুনখারাবি করতেও বাদ রাখে না। রাসেলটা ছয় হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। ওর নাগাল না পেলে এমনকি কেরামত মুন্সীকেও ঘাড় ধরে আনতে পারে এরা।

ওদের স্কুলের পাশে কেরামত মুন্সী চা সিগারেটের দোকান খুলে বসেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। প্রতিবছর স্কুলের ফি আর কোচিংএর টাকা যোগাড় করতে না পেরে বহু ছেলে যার কাছে দাদনের জন্য ধর্না দেয় সেই কেরামতের মাধ্যমেই বিশ্বচন্দ্র রায়, পিতা হরিদাসচন্দ্র রায়, মফিজুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র একমাস আগে পাঁচ হাজার টাকা দাদন নেয়। কাগজে সই করার সময় ইদ্রিস আলী সর্দারের নামটা তখনই বিশু জেনেছে।

সেই ইদ্রিস আলীর সামনে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামতে থাকে বিশু। টেবিলের উপরে খুলে রাখা মোটা খাতায় ওর নাম ঠিকানা তুলে নেয় লোকটা। তারপর তখুনিই ওকে কাজে লেগে পড়তে বলে। আগামী তিন সপ্তা ওর সময়। দৈনিক অন্তত চারশো করে কাঁচা ইট বয়ে নিয়ে ইটভাটার চুল্লীর কাছে রেখে আসতে হবে। তাহলেই কুড়িদিনে ওর দাদনের টাকা শোধ হবে। বাড়ি থেকে অংকটা করে এসেছিল বিশু। ইদ্রিস আলীও একই হিসেব দিয়েছে। কিন্তু সেই সাথে শর্তও জুড়ে দিয়েছে। কুড়ি একুশ দিনের মধ্যে দাদন শোধ না হলে পরদিন থেকে ইটের সংখ্যা বেড়ে যাবে।

মাথার উপর ইট তুলে নিতে গিয়ে বিশুর অনভ্যস্ত হাত বাররবার ফসকে যায়। তবু দাঁতে দাঁত চেপে চেষ্টা করে যায় সে। এসএসসি পরীক্ষার আগে যখন কোচিং শুরু হলো বিশু জানতে পারলো এ বছর ফি এক হাজার টাকা বেড়ে গেছে। শুরুতে ভেবেছে দাদার কাছে চাইবে। কিন্তু একশোটা জেরার মুখে পড়তে হবে বলে আর ইচ্ছে হলো না। কোচিংটা না করলে পাস যে হয় না সেটা স্কুলের সবাই জানে। পাস তো দূর, পরীক্ষা দেয়াই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে আজকাল। গত কয়েক বছর ধরে এরকমই চলছে আর নিয়মটা ওরা মেনেও নিয়েছে।

বিশু ছাত্র ভাল। পাস করে ভালমন্দ চাকরি একটা ঠিকই জুটিয়ে নেবে। শুধু পরীক্ষাগুলো সময়মতো দেয়া চাই। তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি সেসে জানে মাকে সে ছাড়া আর কেউ দেখবে না। ভাইদের চেনা হয়ে গেছে। আর বা তো বরাবরই হিসেবের বাইরে, আজ আছে কাল নেই।

প্রথম দু'দিন ইট বয়ে নিয়ে যেতে যেতে এই বাপ নামের লোকটার উপর খুব অভিমান হলো ওর। হরিদাসচন্দ্র রায়কে জ্ঞান হওয়া অব্দি ওদের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকতেই দেখেছে। বিশু জানে এতে লোকটার কোনো অপরাধ নেই কিন্তু তারপরেও হরিদাসের প্রতি কোনো সমবেদনা অনুভব করে না সে।

বড়ভাই আশিস একা একা অনেকটা সামাল দিয়েছে অনেকদিন। আজকাল সেও হিমশিম খাচ্ছে। আর নিশীথ বরাবরই স্বার্থপর ছিল। নিজের প্রয়োজন মিটতেই চলে গেছে লোকটা।

বিশুর অবশ্য ভাইদের জন্য প্রাণ কাঁদে না। চুলোয় যাক ওরা। শুধু মায়ের জন্য আর নিজের জন্য এত ভাবনা ওর। এবার বাড়ি ছেড়ে আসার সময় মায়ের চোখে জল দেখেছে বিশু।


(
তিন)


জেলা শহরের ডিসি অফিসের বারান্দায় উঠে এসেই মহামায়া মাথা ঘুরে পড়ে গেল। পাশের বাড়ির কলেজ পড়ুয়া ছেলেটা ওর সাথে এসেছে। ওদের চারপাশে ভিড় জমে গেছে। ছেলেটা ছুটে গিয়ে কোত্থেকে জল এনে চোখেমুখে ছিটিয়ে দিতে একটু ধাতস্থ হলো মহামায়া।

এই শরীরোত তোমাক আইসপার মানা করছিনু কাকি। দাদারঘর কায়ো আসির পাইল না...

দম বন্ধ নাগোচে, এ্যাকনা বাতাস করবু বাপ?

এ্যাকনা সারি খাড়া হন- বলতেই ভিড়টা পাতলা হয়ে গেল। একটা খবরের কাগজ এগিয়ে দিল কেউ। ছেলেটা সেটা দিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে লাগল মহামায়াকে।

গতকাল রাতে দীপেন সাহার মুখে খবরটা জানার পর থেকেই মহামায়া বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে। ভোর হতে না হতেই হরিদাসকে ছাতিমকান্দায় একা ফেলে সে শীতলিয়ার বাসে উঠে বসেছেসাথে পাশের বাড়ির প্রদীপ ছেলেটা এসেছে। পুরো রাস্তা পাথরের মতো বসে ছিল মহামায়া। একটা শব্দও করেনি। বাস থেকে নেমে একটা অটোরিকশায় চেপে ঘন্টাখানেক হল ডিসি অফিসে এসে পৌঁছেছে ওরা।

কাকি, মুই স্যারের ঘরের সাতে আলাপ করি আসোচে, তোমরা এ্যাকনা বইসো।

মহামায়া হ্যাঁ না কিছুই বলে না। ওর এখনো বিশ্বাস হয় না যে বিশু নেই। পরশুদিন রাতে দীপেন সাহা যখন হন্তদন্ত হয়ে এসে খবরটা দিল তখনও সে মানতে পারেনি। ইদ্রিস আলী কিংবা শীতলিয়া সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।

দীপেন সাহা বলেছে ইটভাটা থেকে পাঠানো রিক্যুজিশন অনুযায়ী প্রতিবার আট মণ করে কয়লা বয়ে আনে ট্রাকগুলো। সেদিন ভোররাতে অতিরিক্ত কয়লা আনলোড করার সময় টাল সামলাতে না পেরে ট্রাকটা শ্রমিকদের ছাপড়া ঘরের উপর উল্টে পড়ে। পঁচিশ টন কয়লার নিচে চাপা পড়ে ওদের বিশুসহ আরো দশজন। এসব কথার মাথামুণ্ড মহামায়া কিছুই বোঝেনি। বিশুর তো শীতলিয়ায় থাকারই কথা নয়। কিন্তু গৌরডাঙ্গায় মামার বাড়িতে ফোন করে যখন জানা গেল বিশু সেখানে যায়নি তখন থেকেই মহামায়ার প্রাণ শুকিয়ে কাঠ হয়ে ছে।

কিছু মনে রাখতে পারছে না সে। সব গুলিয়ে যাচ্ছে ওর। জ্ঞান ফিরতেই ‘অ বিশু, কোনটে গেলু রে বাপ? বলে আর্তনাদ করছে। অথচ একটু আগেই বিশুর লাশটা সনাক্ত করে এসেছে ওরা।

প্রদীপ দশ মিনিট পর ফিরে এলো। সে শুনেছে ডিসি অফিস থেকে নিহতদের সৎকারের জন্য আপাতত পঁচিশ হাজার করে টাকা দেওয়া হচ্ছে। মহামায়াকে স্যারের রুমে গিয়ে দস্তখত করে টাকাটা নিতে হবে। আজই সব কাজ শেষ করে ফিরতে হবে ওদের। মহামায়া এই শরীরে বারবার ঘর থেকে বেরুতে পারবে বলেও মনে হয় না। প্রদীপ তাগাদা দেয়।

অ কাকি, হাঁটো, সই করি টাকা বুঝি নিবেন। আর বিশুক পুলিশ ছাতিমকান্দা থানাত পাটে দিবে কইছে।

বড় স্যারের রুমে গিয়ে যন্ত্রচালিতের মতো দস্তখত করে মহামায়া। বের হয়ে আসার সময় স্যারকে বলে- মোর বিশুক বাড়িত পাটে দ্যান স্যার, দ্যাকেন অর য্যান কোনো অসুবিদা না হয়...

ফেরার বাসে উঠা অব্দি মহামায়া যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। যেন পুরোটাই একটা দুঃস্বপ্ন। ঘড়ঘড় শব্দে ইঞ্জিনটা চালু হতেই সম্বিত ফিরে পায়। বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠে মহামায়ার। বিশুকে ফেলে সে কোথায় যাচ্ছে! বিশু কি সেই শালিক ছানা যার লাশটা ওখানে অবহেলায় পড়ে থাকবে!

 



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন