কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

অরবিন্দ কুমার

 

 প্রতিবেশী সাহিত্য

 

অরবিন্দ কুমারের গল্প         

                        

(অনুবাদ : মিতা দাশ)

 

 


লেখক পরিচিতিঃ অরবিন্দ কুমারের (তিওয়ারি) জন্ম বিহারে। শিক্ষা - আচার্য চিকিৎসাবিদ, পদার্থবিদ। পেশা - রেডিয়েশন সেফটি অফিসার। তিনি হিন্দিতে গল্প, কবিতা ও নাটক লেখেন। এছাড়া তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত আছেন।

 

ইঁদুর

কন্যা ও বউয়ের সঙ্গে ঘটিত ঘটনাকে সে মনের দুর্বলতা বলে এড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখন ওর সঙ্গে পরপর তিনবার সেই সব ঘটনাগুলি হতে শুরু হয় তখন ওর টনক নড়ে। এইবারও ঠিক সেইরকম হল। এবার কিন্তু ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরও সব কিছু জানবার তাগিদে হাত-পা ঢিলে ছেড়ে দিল। খুরখুর করে সে ওর পায়ের বুড়ো আঙুল বেয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করল। ওর বড় বড় নখের আঁচড় সে পরিষ্কার অনুভব করল। ও নিজের দুই আঙুলের মাঝখানের নরম জায়গায় নিজের নাক দিয়ে নিজের জায়গা নিশ্চিত করল। তারপর নিজের তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে কূট কূট করে আমার চামড়া কাটতে আরম্ভ করল, চামড়ার নিচে মাংস অব্দি। পায়ে অসম্ভব কাতুকুতু ও একটি যন্ত্রণা বোধ করায় আমি অসহ্য হয়ে এক ঝটকায় পা হওয়ায় ছুঁড়ে দিলাম, আর সে দূরে ছিটকে পড়ল।

তারপরে তার পরিচয় খোঁজা বৃথা। তিনি ছিলেন একটি ইঁদুর। এখন এতে সন্দেহের কোন কারণ ছিল না। তাই কি তিনি আবার এসেছেন এখন এই রূপে? ওদের কপালে ভাঁজ তৈরি হয়ে গেছে। ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল, তাদের শিরা-উপশিরায় স্রোতের মতো ভয়ের ছটফটানি চলছিল। তাদের সংখ্যা কত হবে, ওরা  ভাবতে লাগল। 

বাবার আশীর্বাদে বেড়ে ওঠা এই ইঁদুরগুলো তখন থেকে ঘরের সঙ্গ ছাড়েনি। তারা সম্ভবত এই বাড়িটিকে তাদের বাড়ি মনে করে। বাবা নিয়মিত তাদের জন্য পরিবারের রেশনের একটি অংশ বের করে রাখতেন। যেন তারা এই পরিবারের বিশেষ সদস্য। এটাই ছিলো তাঁর ধর্মগত কুসংস্কার। এটাই সবার মত, প্রত্যেক জীব-জন্তু এক খুদার বান্দা (সবাই একই ঠাকুরের দ্বারা তৈরি)। যদি একজন সদস্য উপার্জন করে তাহলে তার নৈতিক কর্তব্য হল অন্যদের ও আজীবিকা করে দেয়া। আর সে যদি সক্ষম হয় তাহলে তাকে অন্যদের জন্য সম্বল হওয়া  উচিত। সব ঝামেলা, ঝঞ্ঝাট, উঁচু -নিচু হওয়া সত্ত্বেও, বাবা তাদের থাকার ব্যাপারে কখনও আপত্তি করেননি এবং কখনও নিজের নিয়মও ভঙ্গ করেননি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সে তার বাবার এই সব ব্যবহারে বেশ বিরক্ত হত। সে বাবার এই ধরনের কাজগুলির জন্য বাবাকে অপছন্দ করত। এত কী দয়া আর দান-পূণ্য? বাজারে এত মূল্যস্ফীতি আর এদিকে ইঁদুরকে এত মূল্যবান খাদ্যশস্য দেওয়া হচ্ছে। এই ধরনের কুসংস্কার এবং এই ধরনের ধর্মীয় মতে বিশ্বাসে তার একেবারেই বিশ্বাস ছিল না। অন্যকে দান দিলে বুঝি নিজেদের পেট ভরে? বাবা বোঝাতেন এটা তোর দয়া না, তাদের ভাগ, তাদের অধিকার। তারা কথা বলতে পারে না, তাতে কী? তারাও তো প্রাণী। কিন্তু এ কেমন ভাগ, ওদের অধিকার? সে এক কান দিয়ে বাবার সব কথা শুনত এবং অন্য কান থেকে তা বার করে দিত, সে পিতাকে সর্বোচ্চ মূর্খ মনে করত। এবং ইঁদুরগুলি নোংরা ও রোগের কারণ ছিল। শৈশবে এই সব অনিচ্ছা কারণে কষ্ট পেত, যখন বড় হলো সে বাড়িতে ক্ষমতায় আসার পর সমস্ত পুরনো নিয়ম এবং আইন ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। ইঁদুরদের ভাগের খাদ্য বন্টন এখন বন্ধ। কিন্তু খাওয়া-দাওয়া নিষিদ্ধ হওয়ার পরও সে তারা স্থান পরিবর্তন করেনি, কিংবা তাদের অভ্যাসে কোন  কমতি ঘটেনি। কিছু অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও  তাদের লাফানো এবং ঝাপানো আগের মতো চলতে থাকে। দমন এবং বিক্ষিপ্ত হত্যাকাণ্ডও তাদেরকে প্রভাবিত করেনি। স্ত্রী এবং বন্ধুদের সাথে অনেক আলোচনার পর সে আর তার স্ত্রী এবং বন্ধুদের সাথে একটি বৈঠকে, খুব আনন্দের সাথে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং ঘোষণা করেছিল যে, এবার রেশন লোহার বাক্সে রাখা হবে। এবং এই বাক্সগুলি লোহার দেয়ালের  পিছনে রাখা হবে এবং ভান করা হবে যে বাড়িতে অন্নর তীব্র ঘাটতি চলছে।

সেইরকম ভাবেই কাজ করা হয়েছে, কিন্তু ওদের উৎপাতে কোন পার্থক্য ঘটেনি।  এখন আর বাড়িতে কোন শক্ত শস্য নেই, কিন্তু রুটির টুকরা, ভাতের এক আধটি দানা এবং কাগজের টুকরোর উপরে ওদের বসবাস শুরু। তাদের চাহিদা ওরা নিজেরাই সীমাবদ্ধ করে এক ধরনের চুক্তি  করে নিয়েছিল। সম্ভবত হ্যাঁ,  তাদের আচরণে একটি পার্থক্য অবশ্যই লক্ষ্য করা গেছে, তাদের রুক্ষতা অনেক বেড়ে গেছে। এখন ওরা কাপড়-চোপড় ও বই-পত্র চিবুতে শুরু করে দিয়েছে। কখনো কখনো, ওরা আলমারিতে রাখা টাকা কেউ নিজেদের তীক্ষ্ণ দাঁতের শিকার বানিয়েছিল, এতে অনেক ক্ষতি হয়েছিল। এবার তার দুশ্চিন্তা আগের চেয়ে আরও বেড়ে গেল। এবং তার রাজনৈতিক মন ও মস্তিষ্ক এখানে এবং সেখানে দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকে। সে তার কিছু বিশেষ বন্ধুর সাথে পরামর্শ  করার পরপরই একটি জরুরি সভা ডেকেছিল।

এবার বিনাশের নীতি গৃহীত হয় এবং ইঁদুরের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়। সেটাও খুব জোরে। ইঁদুর মারার ওষুধ আনা হয়েছিল, ফাঁদ পাতার খাঁচা ব্যবহার করা হয়েছিল, কিছু বিড়ালও ইমপোর্ট  করা হয়েছিল, তাতে কিছু পুরনো লোভী এবং বোকা ইঁদুর অবশ্যই আটকা পড়েছিল। কিন্তু বাকিরা তাদের দলবল সহ কোথাও নিখোঁজ হয়েছিল মহান দমন অভিযানের ভয়ে। অতএব, তাদের আক্রমণ এবং ঝামেলা থেমে গেল। পুরো বাড়িতে শান্তি ছিল, যেখানে সে তার পুরো পরিবারের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে এবং অবাধ হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছিল। এবং হুইস্কির বোতল আর বন্ধুদের একটি বড়ভোজও দিয়েছিল। 

কিন্তু এখন জানা গেছে, ওরা ভয়ে পালিয়ে যায়নি বা নিখোঁজ হয়নি। কিছুদিন ওরা চুপ করে কোথাও লুকিয়েছিল। তারপর কিছু চিন্তা করার পর লুকানো ইঁদুরগুলি বেরিয়ে এল। যখন ইঁদুরগুলো বেরিয়ে আসে, তখন তাদের মনোভাব বেশ বদলে যায় এবং তারাও বেশ উগ্র হয়ে ওঠে। সারাদিন নিখোঁজ থাকার পর এখন তারা রাতের অন্ধকারে আক্রমণ শুরু করে। প্রথমে তার ছোট্ট মেয়ে শিশুটিকে আক্রমণ করে। ইঁদুর তার এক পায়ে  দাঁত বসিয়ে কামড়ে পালিয়ে  যায়। তারপর স্ত্রী জানাল যে তাকেও আঁচড় দেওয়া হয়েছিল এবং টানা তৃতীয়বারের মতো তার আঙ্গুলগুলিও কামড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তারা অনুমান করেছিল যে, একটা নয় বরং অনেকগুলি ইঁদুর। 

এ ব্যাপারে কারো কোনো আশা বা দুরাশা ছিল না। ইঁদুরগুলো তৃণভোজী প্রাণী এবং ধর্ম অনুসারে, তাদের গণেশের বাহন হিসাবে শ্রদ্ধার সাথে মান-সম্মান করা হয়। ইঁদুররা হিংস্র এবং মাংসাশী হয়ে উঠবে, এটা কেউ মেনে নিতেই পারে না। তারা তাদের বন্ধুদের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করতে ওরা বেশ সংকোচ এবং লজ্জিত বোধ করছি। কিন্তু উল্লেখ করার পর জানা গেল যে তার বন্ধুরাও আজকাল এই সমস্যায় ভুগছে। এই ধরনের হামলা সব জায়গায়  হচ্ছে। এরা রাতের অন্ধকারেও গোপনে আসে এবং কারো নরম চামড়া বা নোনতা মাংস কামড়ে ছিনিয়ে নেওয়ার সাথে সাথেই পালিয়ে যায়।             

সবাই বসে একটা বড় মিটিং করলো। অনেক উত্তেজনা ছিল সবাইকার আর ওরা বেশ মাথাও ঘামালো এই বিষয়ে। এবং এই নতুন মনোভাবের বিরুদ্ধে ব্যাপক যুদ্ধ চালানো হল, গ্রুপ ক্যাম্পেইন করা হল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, এই অভিযানের প্রথম পর্যায়ে তাদের আবাসস্থলগুলি ধ্বংস করা হবে। তখন তাদের জন্য সামরিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবিলম্বে তাদের বিল খনন করা শুরু হল। একদিন বা দু’দিন নয়, এই খোদাই সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলল। কিন্তু এই খোদাই আরম্ভ করতে কিছু কিছু ঝামেলাও বাধল। বাইরের কিছু মানুষেরা ওদের সাহায্য করল। তারপর কাজটা বেশ সহজ হয়ে উঠল।

প্রথম প্রথম সবচেয়ে বড় ঝামেলা হল মজুর খোঁজা। কিন্তু মজুর খুঁজে পাওয়া বেশ মুস্কিল ছিল সেই সময়। শহরের এ কোণ থেকে ওই কোণ খুঁজে বেড়িয়েও  মজুরের দেখা মিলল না। জানা গেল, গত কয়েকদিনে শহরের পরিচ্ছন্নতা ও বেদখল অভিযানে সে নিজেই শ্রমিক ও দরিদ্রদের সব বস্তি উপড়ে দিয়েছিল। বস্তিগুলি সরিয়ে রাস্তা প্রশস্ত করা হয়েছিল এবং বিলাসবহুল ভবন নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু সেই বস্তিহারা মানুষদের কী হয়েছিল, তারা কোথায় গিয়েছিল, তারা কি এখনো জীবিত নাকি মৃত, কারো কাছে কোনো খবর নেই। কেউ ওদের খবর রাখেনি। কোনো রিপোর্ট তার কাছে নেই। সে নিজের ভুল ও অদূরদর্শিতা'র জন্য বেশ অনুতপ্ত হল। একটু বিরক্তিও বোধ করল। কিন্তু এখন আর সেই বিষয়ে কিছু করার নেই। এটা বেশি ভাবার ও বিচার করার সমরও নয়। ভাবল ঠেকায় দিয়ে দিলে হয় বাইরের কোনো ঠিকাদারকে। টাকা-পয়সা দিয়ে কী না হয়! সব কিছুই করা যায়। তারপর ইঁদুরদের গর্তগুলোর খোদাই আরম্ভ হল। দ্রুত গতিতে খনন কাজ বেশ সফল ভাবেই সম্পন্ন হল।

খনন করতে গিয়ে দেখা গেল যে, ইঁদুরের গর্ত নয় এটা, একটি মোটা টানেল, আর তার ভেতর বিভিন্ন পথও আছে, শুধু একটা বিল নয়। সুড়ঙ্গটি ধীরে ধীরে প্রশস্ত এবং অন্ধকার হয়ে উঠছিল। অনেক খোঁড়াখুঁড়ির পর তাতে আলো দেখা গেল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তার শেষ ছিল ঘন জঙ্গলে। সেখানে সেই ইঁদুরগুলো একটা দুটো নয় হাজার হাজার মিলিয়ন সংখ্যায় ব্যারিকেড বেঁধে দাঁড়িয়েছিল। এতগুলো ইঁদুরকে এভাবে একসাথে দেখে তারা এতটাই ভয় পেয়েছিল যে, তারা নিজেদের মাথায় পা রেখে দৌড়ে গিয়েছিল, যত তাড়াতাড়ি  সম্ভব বাইরে থেকে সামরিক সাহায্য পেতে।

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন