কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল


 

(২০)

 

--ঠাকুর-গড়া দেখেছো লিপি, কোনোদিন?

--দেখেছি তো।

--আগে বাঁশের ওপরে খড় একটা কাঠামো বানায়। তার ওপরে মাটি মাখিয়ে ফেলে রাখে শুকোয়, ফেটে যায় ঝুরঝুর করে।

--হুঁ।

--এরকম দ্যাখো। দাঁড়িয়ে আছি আমি, দাদা। রঞ্জুকে আনিনি।

লিপিকা ছবিটা দেখে। বুঝতে পারে না, হিজিবিজি রেখায় ভর্তি পৃষ্ঠা। মায়ায় ভিজে গিয়ে বলে,

--ভালো হয়েছে। কাপদুটো ধুয়ে রেখে আসি। তুমি বসে আঁকো।

শোভন হাসে, উঠে বাইরের ঘরে বসে। এক সংসার মাছ মাপা জলে খেলা করে তাদের মতোএকসাথে ভাসে, ডোবে। শোভনের শরীরে তোলপাড় হয়, দৌড়ে নিজের ঘরে যায় রঙের বাক্স আনতে। চটির ফটাস ফটাস জোরে জোরে! লিপিকা রুটি করবে বলে আটা নামিয়েছিল, রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় কী হল? শোভন এসে মাছের বাক্সকে মুখোমুখি রেখে সোফায় বসে, চোখ স্থির।

এই তো একেবারে ঠিক ছিল, কথা বলছিল। পাশে এসে নাড়া দেয় লিপিকা,

--কী গো?

শোভন একদৃষ্টে খাতা দেখে, বিড়বিড় করে,

--একমেটে হলো সবে।

--কী?

শোভন ফের হারিয়ে গেছে। শরীর ভালো নেই লিপিকার, দুর্বলতায় কান্না পেয়ে যায়। চোখ মুছে ঘন হয়ে বসে কাঁধের ওপরে শোভনের মাথাটা টানে পারে না। ঘাড় শক্ত, চোখ এ্যাকোয়ারিয়ামে। লিপিকার হাতের আটাগুঁড়ো লেগেছে শোভনের গালে। শাড়ির আঁচলে মুছে নেয় সে, একটু অসামঞ্জস্য হিজিবিজি পছন্দ করে না। বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে, আজকাল শাড়ি পরে আরাম লাগে। আঁচল গায়ে জড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলে উঠে রান্নাঘরে যায়।

শোভন খাতার নতুন পাতা খোলে। দ্রুত আঙুলে আউটলাইন আঁকে লাল, নীল, হলুদ, কালো মাছ। খচখচ করে লাইন টেনে পুকুরের জল, ধারে সবুজ ঝোপ। কাশবন ঘন হয়েছে ডগার সাদা ঠাসা তুলো নুয়ে গেছে। পাড় ধরে লম্বা তাল, নারকেল প্রায় একরকমের দেখতে। ক-টা লাইন কাটাকুটি করে খাঁজকাটা দাঁতে সবুজ রঙ ভরে দিলে সত্যিকারের নারকেলপাতা, তালপাতা, হয়ে যায়। তারপরে হাঁটতে হাঁটতে যায় পুকুরপাড় অবধি বাবা, দাদা, সে, রঞ্জু বাবার কোলেবাবার ছুটির দিন। তাদের তিনজনের কদমছাঁট, বাবার চুল ছোটো করে ছাঁটা। ভালো সাঁতার জানে, গামছা পরে নামে। তাদের বসিয়ে রাখবে পাড়ে।  তিন-তিনটে ছেলে, শোভন বাদে বাকি দু-টো হনুমান। মা পই-পই করে বারণ করছিল বাবাকে। ঠাকুমা বলছিল,

--অগরে লইয়া যাস না মাখন, সামলাইতে পারবি না। অ অনু, তুমি কও না।

মা কটকট করে তাকিয়েছিল, বাবা হেসে বলল,

--ভয় নাই মা। ছুডোরে ট্যাঁকে কইরা ল’ মু, অগরে বসাইয়া রাখুম।

--আর জলে নামবি যখন?

--হের দাদারা দ্যাখব। আজ বিজু জলে নামব না। কী বিজু, ভাইয়েরে দ্যাখবি না?

জলের পাশে বসে ছটপট করে দাদা দ্যাখে বাবা নেই। শোভন একটু ভয় পায়,

--বাবা কই দাদা? ডুবে গেছে?

--ভাগ্‌ গাধা একটা। বাবা যা ভালো জানে, ডুববে না কখনো। বাবা সমুদ্রেও সাঁতরাতে পারবে।

বিজু বিজ্ঞের মতো বলে। শোভন সমুদ্র দ্যাখেনি। বিজু নাকি পুরীতে গিয়েছিল শোভনের জন্মের আগে। শোভন একটু অবিশ্বাস করে কারণ দাদা সব সময়ে সত্যি বলে না। সামনে সোজা দেখতে দেখতে হঠাৎ ভুস করে দ্যাখে মাঝপুকুরে বাবা ভেসে উঠেছে। এতক্ষণ ডুবসাঁতার দিচ্ছিল। সাঁতরে আসে পাড়ের কাছে। টপটপ করে জল পড়ছে বাবার ফর্সা, পেটানো মেদহীন শরীর থেকে। গামছাখানা কোমরে লেপ্টে আছে। বাবার গায়ে আলো-আলো, যখনই খালি-গা হয় দেখা যায়। বাবা চেঁচিয়ে ডাকে,

--শোভু, আমার চশমা দিয়ে যা তো বাবা। খালি পায়ে আয়। দেখিস, পড়ে যাবি না কিন্তু

শোভন হাওয়াই চটি ছুঁড়ে ফেলে চশমা হাতে দৌড়ায়। পাড়ের কাছে প্যাচপ্যাচে কাদা, খাবলা-খাবলা ঘাস আর বাচ্চা মাছির মতো ঘাসের পোকা উড়ছে। অসাবধানে পা পড়লে জোঁক ধরবে। পুকুরটা বড়ো নয়, তবে টলটলে। দু-চারজন গামছা ছুঁড়ে কোমরজলে হেঁটে বেড়াচ্ছে, কুচো মাছ-টাছ ওঠে। বাবা এসে দাঁড়ানোমাত্র বিজু বলে,

--এবারে আমিও নামব ও বাবা! এতক্ষণ বসে রইলাম, তুমি ডাকলে না। এবারে যাই?

--আরেকদিন তোকে আনবো। আজকে দেরী হয়ে গেল বাবা।

--তাহলে তোমরা বাড়ি যাও, আমি পরে যাবো।

বিজু দৌড় দিতে যায়, বাবা খপ করে কাঁধটা ধরে শক্ত মুঠোয়। বাবার আঙুল সরু আর লম্বা। চোখ পাকিয়ে ধমকায়,

--না করে দিলাম না?

বিজু মাথা নামিয়ে থরথর কাঁপে, ছোটো ভাইগুলোর সামনে অপমানটা মানতে পারে না। বাবার কাছে সে সাঁতার শিখছে, পারেও ভালো। তবে বাবা একা ছাড়ে না। বাবা বিজুর পিঠে মাথায় হাত বোলায়,

--আজ ভাইদেরকে এনেছি, ওদের দেখতে হবে না? তুমি বড়োদাদা, তোমার দায়িত্ব। আবার পরশু-তরশু তোমাকে একা নিয়ে আসব।

হাওয়া লেগে আরামে রঞ্জু ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাবা আদর করে তোলে। সে দু-হাত ছড়িয়ে বলে,

--বাবা কোলে।

--হ্যাঁ বাবা, আয়।

আঁকা হয়ে গেছে শোভনের মন দিয়ে নড়াচড়া দেখে। বাবার কোলে রঞ্জু, পেছনে বিজু-শোভু। পুকুরধার পেরিয়ে কোম্পানির পাকা রাস্তা, ওখান থেকে  পাঁইপাঁই ছোটে বিজু। শোভু বাবার দিকে তাকায়, বাবা হেসে মাথা নেড়ে অনুমতি দিলে সে-ও পেছন পেছন কোম্পানির মাঠ পেরিয়ে দু-ধারের কোয়ার্টার পেরিয়ে  কোণারটা তাদের।  সরু রাস্তার মুখে বিরাট বেলগাছটা, বাগানের গেটঝিলমিল করে হারিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়াটে হয়ে।

ঝাঁকুনি দিয়ে শোভন সোজা হয়ে বসে দেখে কিংসিং গোরামিজোড়া ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে স্থির। লজ্জা-লজ্জা লাগে কী যেন দেখে ফেলেছে। খাতাটা নামিয়ে দেয় সেন্টার টেবিলে। বাবুলের দেওয়া জয়সলমীরের সোনালি প্ল্যান্টারে বেড়ে উঠছে লিপিকার সাধের সাকুল্যান্ট, ভারী চমৎকার দেখতে। মাঝেমাঝে টেবিল থেকে সরিয়ে ব্যালকনির হাওয়া-বাতাসে রাখে লিপিকা। বুকের মধ্যে ভেজা বাতাস বয়সব এত যত্ন করে কী করে!

লিপিকাকে ডাকে,

--খাবো না?

--খাবে বুঝি?

--হ্যাঁ, খিদে পেয়েছে।

--তাই নাকি? তুমি খিদে বোঝো?

কেমন মুখ করে মাথা নাড়ে সে, বোঝে বৈকি!

 

(ক্রমশঃ)

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন