সমকালীন ছোটগল্প |
অন্য সম্ভাবনা
ক্লাশ
প্রায় শেষ হয়ে গেছে, লাস্ট বেঞ্চ থেকে একটি মেয়ে উঠে দাঁড়াল। ছিপছিপে লম্বা, শ্যামলা
রঙ। ম্যাডাম Sampling Theory টা আমার ঠিক ক্লিয়ার
হয়নি, আরো একদিন ডিসকাস করবেন?
রেজিস্টার
থেকে মুখটা একটু তুলে মেয়েটির দিকে তাকালেন নন্দিনী। যেমন হয় সিরিয়াস টাইপের ছাত্রীরা... তেমনি, ঘর্মাক্ত মুখ,
প্রচুর চুল মাথায়, ভালো করে আঁচড়ানোর সময় পায়নি হয়তো, একটি রাবার ব্যান্ড দিয়ে কোনোমতে
আটকানো, কুর্তা আর প্লাজো পরা, কোন প্রসাধন নেই। দুই সেকেন্ডের মধ্যে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ
করে, নন্দিনী সরকার আবার মুখ নামিয়ে বললেন, এই সপ্তাহের তিনটি ক্লাশ আমি sampling
Theory 'র ওপর করিয়েছি। আর বেশি সময় তো আমি এটায় দিতে পারব না, অন্য টপিক শুরু করতে
হবে, তোমার কনফিউশন থাকলে ক্লাশে বললে না কেন?
নাম কী তোমার?
রুহানি।
অদ্ভুত
নাম তো! ওকে, আমি কোয়ার্টারে থাকি, ছুটির দিনে তুমি আমার কাছে আসতে পারো, বিকেলের দিকে, বুঝিয়ে দেবো। আমার নাম্বারটা
রেখে দাও।
মেয়েটির
মুখে খুশি খুশি ভাব জেগে উঠল। আচ্ছা, ম্যাডাম আমি অবশ্যই আসব।
তারপর প্রায় একসপ্তাহ কেটে গেছে, ম্যাথস ম্যাডাম নন্দিনী সরকার রুহানির কথা ভুলেই গেছেন। এরমধ্যে কয়েকদিন ছুটিও নিয়েছিলেন তিনি, তাই আজ ক্লাশে এসে মনে মনে খুঁজছেন মেয়েটিকে। খুব সম্ভবত অ্যাবসেন্ট, একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন রুহানির কথা। মেয়েটি বলল, রুহানি কয়েকদিনের মধ্যে আসেনি। নন্দিনী আর মাথা ঘামালেন না, তিনি তখন এস্টিমেশন, পয়েন্ট ওব এস্টিমেশন, আনবায়াসডনেস, কন্সিস্টেন্সি বোঝাতে মগ্ন হয়ে গেছেন।
অবশেষে মেঘে ঢাকা এক গুমোট বিকেলে, রুহানির দেখা মিলল। সে আগে থেকে ফোন করেনি নন্দিতাকে, জিজ্ঞেস করে করে ওর কোয়ার্টার খুঁজে বের করেছে।
নন্দিনী
সরকার তাঁর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে কোয়ার্টারে থাকেন। ওনার স্বামী চাকরিসূত্রে
অন্য শহরে। ছেলে এখনও বেশ ছোট, তাই ছেলেকে এখানকারই একটি ভাল স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন নন্দিনী। একবার
নন্দিনী ছুটি পেলে স্বামীর ওখানে যান, আর একবার তিনি আসেন, এভাবেই চলছে।
আজ
ছেলেকে নিয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বিকেলের দিকে, নন্দিতা বুঝতে পারেননি, এইসময় রুহানি
আসবে ফোন না করেই। তাই তিনি একটু অবাক হলেন। কী ব্যাপার, তোমার? এতদিন পর?
-ম্যাডাম
বাড়িতে অসুবিধে ছিল, তাই আসিনি।
-তোমার
বাড়ি কোথায়?
-একটু
দূরে, তবে খুব বেশি নয়।
নন্দিতা
মিতভাষী, আর কথা বাড়ালেন না, পড়াতে লেগে গেলেন। প্রথমেই বুঝলেন রুহানির এই বিষয়ে বেস
খুব দুর্বল, তাই একদম প্রবেবিলিটি থেকেই শুরু করলেন।
কিছুক্ষণ
পড়ানোর পর মনে হলো, ওর মেধা ভালোই, আরো একটু মনোযোগ দিলে তৈরি করে নেওয়া যাবে।
এদিকে সন্ধ্যা ঘনীভূত, নন্দিনী লক্ষ্য করেছেন, রুহানিকে আজ অদ্ভুত মায়াবী সুন্দর লাগছে এবং তাকে বেশ সচ্ছল পরিবারের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। প্রথম থেকেই কেন যেন নন্দিনী একটিই আউটকাম ভেবে যাচ্ছিলেন, রুহানি গরিব, অসহায়। কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে বেহালায় অন্য সুর আছে। সব ইভেন্টের আউটকাম পূর্বনির্ধারিত নাও হতে পারে। এবার খুব আশ্চর্য হলেন নন্দিনী, তিনি এভাবে ভাবছেন কেন? হাসি পেলো। রুহানি তো একজন তরুণী, সে ইভেন্ট হতে যাবে কেন?
আজকাল সবকিছুতেই তাঁকে প্রবেবিলিটি পেয়ে বসেছে। জীবনের কোনকিছুতেই তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না।
চিন্তা
করছেন অংকের থিয়োরির মতো, তাঁর শ্বাস প্রশ্বাস ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে এমন একটি জগতে যেখানে সবকিছু সংখ্যানির্ভর। রুহানি
চলে যাওয়ার পর নন্দিনী অজয়কে ফোন করলেন। দু'মাস হয়ে গেলো, তুমি আসোনি, ছেলে তো বাবা
বাবা করতে অজ্ঞান।
অজয়
বলল, তুমি এসো ।
-আমার
পক্ষে আসা সম্ভব নয় এখন। খুব চাপ।
-তাহলে
থাক।
-না
বুঝতে চাইছি তোমার আসার সম্ভাবনা কতদূর? নন্দিনী অস্থির সুরে বললেন।
-বাদ
দাও তো তোমার সম্ভাবনা। জীবনে সম্ভাবনা ছাড়া অনিশ্চিত কিছু করো, উদ্দাম। অজয়ের গলার স্বরে সামান্য শ্লেষ ও আনন্দের
আভাস পেল নন্দিনী।
-কী
হলো বলো তো? এভাবে কথা বলছো কেন?
অজয়
ফোন রেখে দিলেন।
নন্দিনী
অবাক, দু"মাস না দেখা হলে আউটকাম হিসেবে আসে শ্লেষ ও সামান্য অনির্নীত আনন্দ।
তার
এখন অজয়ের কাছে যাওয়া উচিত জীবককে নিয়ে। না হলে ব্যাপারটা ঘোরালো হবে। তবে এসপ্তাহে
সম্ভব নয়, প্রচুর ক্লাশ আছে এই কদিন, ছুটি নেই একটাও। তাছাড়া রুহানিকে রোজ আসতে বলেছেন,
ওর প্রবলেমগুলো ক্লিয়ার করে দেবার জন্য। রুহানিও বেশ সিরিয়াস মনে হয়েছে, খুব ভালো হোমওয়ার্ক
করে আসে, মনে রাখে।
নন্দিনী ভাবছিলেন, আচ্ছা ! জীবক কি বড় হয়ে ডাক্তার হবে? এধরনের কোন রেনডম চিন্তা থেকেই হয়তো তিনি নিজের ছেলের নাম রেখেছিলেন জীবক। জীবকের জন্মের কিছুদিন আগে নন্দিনী একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন, অসাধারণ সুন্দর একটি হাসপাতাল, দেখে মনে হয় গভীর শান্ত বন, বৃক্ষের আদলে সবকিছু তৈরি করা হয়েছে, ওপরের ছাদ নীল আকাশের মতো, হাসপাতালের ডাক্তার থেকে নার্স সূর্যাস্তের রঙের ইউনিফর্ম পরে হাসিমুখে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। আর একজন তরুণ সন্ন্যাসীর মতো দেখতে ডাক্তার একজোড়া বৃদ্ধ অসুস্থ দম্পতিকে কিছু একটা বলছে, তাতে তাদের মুখে ফুটে উঠছে নির্ভরতা। স্বপ্ন ভাঙল, ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই চোখ পড়ল, সামনে রাখা বুদ্ধের মূর্তির দিকে। তখনই নামটা মনে এলো, 'জীবক', হ্যাঁ ছেলে হলে অবশ্যই তার নাম হবে জীবক, যেন বুদ্ধের চিকিৎসক।
অজয়
কেন উড়িয়ে দেয় সম্ভাবনার কথা। এখন যে সম্ভাবনা নন্দিনীকে অস্থির করেছে তা হলো, অজয়ের
জীবনে কোন ভীষণ রিয়েক্টিভ ভেরিয়েবলের উপস্থিতি।
নন্দিনীর
অসংলগ্ন চিন্তাভাবনা থেমে গেলো। কারণ রুহানি এসেছে, হর্স টেইল বেঁধেছে চুলে, ঝকঝকে
শ্যামলা ত্বকে হলুদ আভা, এমন মুখখানা দেখে
নন্দিনীর নিজের কলেজবেলার কথা মনে পড়ল।
রুহানি
হেসে বলল, আজ কিন্তু পড়ব না ম্যাডাম।
-কেন?
আমি কিন্তু বেশিদিন সময় দিতে পারব না রুহানি।
-জানি
ম্যাডাম। তবুও আজ পড়ব না। আপনি আমাদের সাথে বেড়াতে যাবেন? চলুন না প্লিজ!
নন্দিনী
অবাক হয়ে বললেন, বেড়াতে যাবো? কোথায়? আর তোমাদের মানে?
-মানে
গৌতমদা এসেছে আমার সঙ্গে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আপনারই ছাত্র থার্ড ইয়ার, আমার মাসতুতো
দাদা তো। আপনি তো একা থাকেন, আজ আমরা প্ল্যান করে এসেছি আপনাকে নিয়ে একটু বেড়াতে যাবো।
জীবকও খুব খুশি হবে।
নন্দিনী
হঠাৎ পৃথিবীতে ফিরে এলো যেন। আরে বেড়ানো জিনিসটার কথা তার মনেই ছিল না, মন খারাপ হলে
তো এভাবে একটু ঘুরে আসাই যায়।
রুহানির
এই আন্তরিকতা ও জেদ নন্দিনী এড়াতে পারল না। কতদিন হলো সত্যিই ঘুরতে যাওয়া হয় না, ছেলেটা সারাদিন চার দেওয়ালের
মধ্যে বন্দী।
বাইরে বেরুতেই হালকা ঠাণ্ডা বাতাস চোখেমুখে লাগল, ঘরে অদ্ভুত গুমোট লাগছিল এতোক্ষণ।
জীবক
গৌতমের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে এবড়োখেবড়ো
রাস্তায়।
নন্দিনী
আর রুহানি পেছন পেছন। সামনে একটি বড় জলাশয় আছে, বর্ষায় অজস্র পদ্ম ফুটেছে সেখানে, এটা
দেখাতেই রুহানি নন্দিনীকে নিয়ে এসেছে।
বিকেলের
ম্লান আলো পদ্মের পাপড়িতে লেগে আছে। এই বেড়ানোটার দুটো আউটকাম পেলেন নন্দিনী, আনন্দ
এবং মনখারাপ। অজয়ের জন্য মনখারাপ। এইসময়টাতে যদি অজয় থাকত, হয়তো এটা একটা সাকসেসফুল
ইভেন্ট হতো, কিন্তু এখন কোথাও ভুল থেকে যাচ্ছে। নন্দিনী কোন একটি ঘটনাকে কখনো এককভাবে
নিতে পারে না। যেন একান্ত নিজের বলে কিছু নেই, সবসময় প্রত্যেকটি যাপন তার কাছে চার
পাঁচটি সম্ভাবনা নিয়ে আসে আর নন্দিনী আবছা অন্ধকারে হারিয়ে ফেলেন বাস্তবজগৎ। কোন্ সম্ভবনা তাকে আনন্দ দেবে ভাবতে
ভাবতে একসময় সব সংখ্যা হারিয়ে যায়। নন্দিনীর
নিজেকেও কোন অবাস্তব সূত্র মনে হয়। তার কাছ
থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে সবাই তাকে একদম একা একটি ঘরে ঠেলে দিচ্ছে, সেখানে সারাক্ষণ
যেন জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে আছে।
-এসব
দরকার নেই বাবা, ছবি তুলে নাও, পাঠাবো।
-না,
ভিডিও কল।
জীবক
নিজেই মায়ের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে ভিডিও কল করল। দু তিনবার করার পর, ওপাশে ফোন রিসিভ
হলো।
নন্দিনী
যেন দেখল, অজয়ের ঘরে একটি অপরিচিত ছায়া সরে যাচ্ছে। দেয়ালে ছায়াশরীর দেখা গেলো একঝলক,
তারপর আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেলো সেই নিঁখুত নান্দনিক অবয়ব!
চোখবুজে
নন্দিনী দ্রুত ভাবল, সে একজন সাইকো পেশেন্ট। কোনো কোনো ইভেন্টের শুধু একটাই আউটকাম
হয়, দুটো হলে গেমটা নষ্ট হয়ে যায়।
দ্রুত
জীবকের কাছ থেকে ফোন নিয়ে নন্দিনী বললেন, আমি আর জীবক কাল আসব অজয়।
-তুমি
দুদিন পর এসো নন্দিনী, আমি অফিসে এই দুদিন খুব ব্যস্ত থাকব, জীবককে সময় দিতে পারব না, তারপর এসো, কেমন!
নন্দিনীর
মনে হলো সে কেউ না। জীবককে সময় দেবার কথা বলেছে অজয়, নন্দিনী তাহলে পুরো ইভেন্টে ঢুকে
পড়া একটি ভুল...
রুহানি
হঠাৎ চিৎকার করে বলল, আরে ম্যাডাম পড়ে যাবেন, আর নামবেন না নিচের দিকে, এখানে কিন্তু
জল খুব গভীর, সাপও আছে।
গভীর!
নন্দিনী অস্ফুটে বলল, কত গভীর রুহানি? কতগুলো সাপ থাকতে পারে? জানো তুমি নিশ্চিত? ডুবে
যাবো পুরোপুরি? ডুবে গেলে আবার ভেসে উঠতে পারবো তো? মোট কতগুলো আউটকাম হলো? বলতে পারো?
রুহানি
বুঝতে পারল না নন্দিনীর কথা, শুধু ওনার চোখমুখের
অস্বাভাবিক ভাব দেখে ভয় পেয়ে গেলো একটু। জোরে হাত টেনে উঠিয়ে আনল নন্দিনীকে।
আসুন ম্যাডাম ফিরে যাই। আর একটু পরেই পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাবে সব।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন