কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

অম্লান বোস

 

ব্যাকরণবাবু - দ্বিজেনস্যার




 

গীতবিতানের নামকরা ছাত্রী নীলাঞ্জনাই কথাটা তুলেছিল। “ভীড়ের পেছন থেকে,  অনেক দূরে বসে বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে, আলোছায়া মঞ্চে আপনি গাইছেন, না হেমন্তবাবু - বুঝতেই পারা যায় না। সেই সাদা ধুতি, সাদা শার্ট, গলাটাও কাছাকাছি”।

আমাদের অতি সুদর্শনা দিদিমা ছিলেন সভা আলো করে। গোলাপী রং, ছোট করে কাটা শ্বেতশুভ্র রেশমী চুলের শোভা, দুধসাদা ধুতি পরিহিতা, সাজানো দোক্তারাঙা দাঁতে হাস্যমুখী পরিপাটি দিদিমার চোখে সবসময়েই কৌতুকের জোনাকী। উনি ছিলেন আমাদের বসুভবনের পঞ্চভ্রাতার ‘দ্রৌপদী’। আমরা সবে ঐ দীর্ঘাঙ্গ ভদ্রলোকের সঙ্গে চলনসই কথাবার্তা আরম্ভ করার চেষ্টা করছি, দিদিমা বলে বসলেন - “দ্বিজেনভাই (উনি সকলকেই ভাই বলে সম্বোধন করতেন), তোমার এত সুন্দর গলা, এত পরিষ্কার উচ্চারণ, গীতবিতানের কমা ফুলস্টপ মেনে গান গাও শুনেছি  - তবু, তোমাকে সবাই ‘হেমন্তের মতো’ বলে। তোমার নিজস্বতার কথা বলে না কেন ভাই? আমার কিন্তু ভীষণ রাগ হয়”।

আকাশকাকু বলে উঠলেন - “আরে, এটাই তো মুস্কিল দিদিমাভাই। এত সুন্দর ভরাট গলা, অথচ আপনার কথা উঠলে উনার কথা এসে যাবেই। কেন, আপনার কি নিজস্বতা নেই?”

নীলাঞ্জনার সাড়া আবার পাওয়া গেল – “নেই মানে? ওনার মত বিশুদ্ধ উচ্চারণ, ত্রুটিহীন ব্যাকরণ খুব কম গায়কেরই আছে। আমরা তো সবাই আপনাকে -  প্লিজ্ কিছু মনে করবেন না, ব্যাকরণবাবু বলি। সত্যি কথা বলি? বান্ধবীদের ইচ্ছা থাকলেও ভয়ে লজ্জায় আপনার ক্লাস নিতে পারে না”। ভদ্রলোক চোখে কৌতুক  নিয়ে কিছু বলবার আগেই সুমতিমাসী বলে উঠলেন - “তবু কেন সবাই তোমাকে হেমন্তের মতো গলা বলবে? আমি সবসময়েই প্রার্থনা করি ঐ মহান গায়ক হেমন্তবাবুর ছায়া থেকে তুমি বাবা, খুব শিগ্গিরই বেরিয়ে এসো”।

এতক্ষণে উনি সহজকণ্ঠেই বলে উঠলেন - “ওটা কিন্তু কিছু করার নেই মাসীমা!  কোন শিল্পীরই ওনাকে ছাড়িয়ে যাবার সাধ্য নেই। অনেকে আমাকেই জিজ্ঞেস করেন আমাদের কোন সম্পর্ক আছে কি না - আমি মাঝে মাঝে বলে দিই, আমি ওনার ভাইপো তো, তাই গলাটা উনি ব্যবহার করতে দিয়েছেন”। হাসির ঢেউ দুলিয়ে একেবারে হাল্কা করে দিলেন তুলনামূলক অস্বস্তিকর আলোচনাটা। ইনি - স্বর্ণযুগের অন্যতম সারথি, শ্রীদ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।

বোধহয় সেটা তাঁর দ্বিতীয়বার বসুভবনে পদার্পণ এবং দুদিনের জন্যে থাকা। সেবার সাকচির বেঙ্গল ক্লাব আয়োজিত রবীন্দ্রজয়ন্তীতে এসেছিলেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের এই পরম পাওয়া।

আমার সংস্কৃতিমনা, সর্বগুণসম্পন্না, সর্বস্তরে সমাদৃতা, অতি জনপ্রিয় এবং সঙ্গীত অনুরাগী মাতাঠাকুরাণীর স্নেহময় আতিথেয়তা এবং পেরুমামার সাদর আমন্ত্রণে গায়ক, লেখক, কবি, সাংবাদিক এবং নানান গুণীজনের আগমনে আমাদের বসুভবন সর্বদাই মুখরিত থাকত - যাদুসম্রাট পি সি সরকার, সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেন, মণিশংকর মুখোপাধ্যায়, এমন কি পরমপূজ্যা আনন্দময়ী মা’য়ের পবিত্র পাদস্পর্শেও বসুভবন ধন্য হয়েছিল। এক সূতোয় বাঁধা সংস্কৃতিপ্রিয় পাড়া পড়শীদের প্রাণেও স্বভাবতই শিহরণ জাগাতো এইসব গুণীজনদের নিকট সান্নিধ্য।

সেদিনও ব্যতিক্রম নেই। যথারীতি দোতালার বসার ঘরে সঙ্গীতানুরাগীদের অস্হির আবেগ ঐ দীর্ঘাঙ্গ ঋজু মানুষটির জন্যে ফুটন্ত ছটফট করছিল সুমিতা - সুরঙ্গমার ছাত্রী, গায়কের একনিষ্ঠ ভক্ত। বলে উঠলো - “তবে আপনার কথা উঠলেই কিন্তু মহালয়ার ঐ দুর্ধর্ষ জাগো দূর্গা গমগম করে ওঠে। উফ্ ফ্ - কী গেয়েছেন! আচ্ছা দ্বিজেনদা, তখন তো লাইভ হত, ঐ ভোরসকালে। নার্ভাস লাগতো না? তখন বোধহয় আপনার গানের জগতে প্রথম দিকে - তাই না?”

“তা প্রথম দিকে একটু… মহালয়া আরম্ভ তো হয়েছিল ছেষট্টি সালে। এত বড় টিম, এত সমন্বয়, একটার পর একটা বর্ণনা, পাঠ, গান, বীরেনবাবুর ইমোশনাল স্তোত্রপাঠ! তাছাড়া, ঐ গানটা তো হেমন্তবাবুর গাইবার কথা ছিল - কিন্তু উনি তখন বোম্বেতে খুবই ব্যস্ত। মহালয়ার আগে এসে মহড়া দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। খুব সম্ভবত বাণীকুমারের সায় ছিল না এতে - তাই উনি আমাকেই গানটা  গাইতে বললেন। তখন কিন্তু একটু… মানে, হাজার হলেও হেমন্তবাবুর গান!”

ব্যস, মামা ধরে বসলেন - “দ্বিজেন, তাহলে আজকের আসর ঐ গানটা দিয়েই শুরু হোক্!”

মা’ও বললেন - “হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, গানটা শুনলে মনে কেমন শুদ্ধ শক্তি জেগে ওঠে”। বলেই গলায় আঁচল দিয়ে একটা প্রণাম, দশপ্রহারিণীর উদ্দেশ্যেই। খুবই ভক্তিমতী ছিলেন।

আমাদের সাবেকী হারমোনিয়ামটা নামানোই ছিল, ওটার দিকে আড়চোখে একটু তাকাতেই মামা বলে উঠলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমারটা থাক্ না দ্বিজেন। এটা আমার ফুলবৌমা রীতার, গীতবিতানের ছাত্রী। এটা ওর মামার হাতেও সুর তুলেছে - শ্রদ্ধেয় শৈলজারঞ্জন মজুমদন, রীতার মামা। উনি শ্যামবাজারের বাড়িতে ওঁর বোনের বাড়ি যখন তখন যেতেন, এটা বাজিয়ে রীতার গান শুনতে চাইতেন। শৈলজাবাবুই পরে ওকে সুরঙ্গমাতে ভর্তি করিয়েছিলেন”।

গায়কের মুখের ভাব বিশ্লেষণের সাধ্য আমার নেই, তবে রীতার দিকে অবাক বিস্মিত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে, হাতজোড় করে ঐ মানুষটির উদ্দেশ্যে মাথা নীচু করার ভঙ্গীটা আজও আমার মনে কেটে বসে আছে। পরম শ্রদ্ধাভরে, খুব সাবধানে ঐ হারমোনিয়মটা সরিয়ে আর একবার গুরুজীকে নমস্কার জানিয়ে, বোধহয় মাফ চেয়ে, নিজেরটাকেই টেনে নিলেন। বসুভবনে বড়, মেজো, রাঙ্গা ভাইয়ের পরে আমি নকুল, ফুল ছেলে, সেই সুবাদে রীতা বাড়ির ফুলবৌমা। সে অবশ্য গায়কের ঐ ভক্তির প্রকাশটা দেখতে পায়নি - লজ্জাবতী তখন শৈলজামামুর সঙ্গে তার নিজের নাম, তাও স্বয়ং দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের সামনে, এক নি:শ্বাসে শুনতে পাবার লজ্জায় আর কিছু না পেরে অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে রাঙাদিদির আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকতে ব্যস্ত।

তা উনি গাইলেন গানটি - শেষও হলো। কিন্তু শিহরণ তোলা শেষের সেই বুক কাঁপানো ‘তুমি জাগো’র টানা বিলম্বিত সুরের স্বর্গীয় আশীর্বাদ যেন এক পাখি ডাকা শরতভোরের পবিত্র ধূপের ধোঁয়ায় সমস্ত বসুভবনের আনাচ কানাচ সুরভিত করে তুললো। প্রায় এক দেড় মিনিট আমরা সবাই স্তব্ধক, পাথর প্রতিমা।

এবার কল্যাণীমাসীমাই নিস্তব্ধ ভাবসমাধিটা ভাঙ্গতে তৎপর হলেন।

উফ্ ফ্ - কী গাইলে দ্বিজেন! আচ্ছা বলো তো, তুমি কার কাছে তালিম নিয়েছ বাবা, আর কত গান গেয়েছ?

হ্যাঁ সত্যিই, এরকম নির্ভুল গায়কী বিশুদ্ধ তালিম না হলে হয়?” ছন্দা ফুট কাটলো।

বেলোতে ক্লিপ লাগিয়ে দ্বিজেনবাবু বললেন, “সে তো বহু পুরনো কথা মাসীমা। ভিতটা গড়ে দিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় শ্রীশান্তিদেব ঘোষ, পঙ্কজ মল্লিক, সন্তোষ সেনগুপ্ত , অনাদি ঘোষ দস্তিদার, নীহারবিন্দু সেন মশাইরা - বিভিন্ন সময়ে। নমস্য শান্তিদেব তো একটুও ত্রুটি বিচ্যূতি সহ্য করতেন না। অসম্ভব কড়া ছিলেন। আর গান, তার কোন হিসেব করিনি মাসিমা। এই ষাট বছরে বেশ কয়েক শো গান তো গাওয়া হয়েছে, আর তার মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রায় আটশো মতো হবে হয়তো”।

অশোকদা বললেন, “আকাশবাণীতে কবে থেকে শুরু করলেন? সেই সকাল সাতটা পঁয়তাল্লিশে ঘোষকের গলায় - এখন রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনাচ্ছেন দ্বিজেন মুখাপাধ্যায়, সরি সরি – শ্রীদ্বিজেন…”

অমায়িক হাসি দিয়ে ওখানেই থামিয়ে দিলেন অশোকদাকে।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে - অভ্যেস আছে এসব শোনার। সত্যি বলতে ভালই লাগে। শ্যামল, তরুণ, হেমন্ত, সন্ধ্যা, মান্না - এগুলি নিজের মত করে, ভালবেসেই তো বলেন আপনারা, হতচ্ছেদ্দা করে তো নয়। আমরা অন্তত সেটাই

ভাবি”।

অশোকদার অপ্রস্তুত মুখের বাইরে প্রায় তিন ইঞ্চি বেরিয়ে থাকা জিভটাকে  দুহাতে চোখ মুখ ঢেকেও কিন্তু সেদিন আড়াল করতে পারেনি। দ্বিজেনবাবু স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই ফিরে গেলেন আবার অশোকদার আগের প্রশ্নটাতেই -

“ও - আকাশবাণীতে? প্রথম ডাক পাই স্বধীনতার আগে, ঐ ছেচল্লিশে”।

“আর ওরা বলছিল তুমি নাকি বম্বেতেও গেছো গান গাইতে?” করবীমামী।

“হ্যাঁ , বম্বেতে সলিলবাবুই নিয়ে গিয়েছিলেন আমায়, সেটা বোধহয় ষাট সাল। ‘মধুমতী’ ছবিতে গান রেকর্ডিং-এর জন্যে - তবে সেগুলো মনে হয় ছবিতে  অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। তা না হলেও, উনি কিন্তু লতাজীর সঙ্গেও কয়েকটি ছবিতে আমাকে ডুয়েটের সুযোগ দিয়েছিলেন, আর ‘শ্যামলবরণী ওগো কন্যা’, ‘একদিন ফিরে যাবো’ গানগুলি হিন্দীতে গাইয়েছিলেন”।

সজল অনেকক্ষণ ধরে উসখুশ করছিল, এবার বলল, “দ্বিজেনদা, আপনি তো বাইরেও অনেক দেশে গেছেন। বিদেশে স্হানীয় মানুষেরা কীভাবে আমাদের দেশের, আমাদের ভাষার গানের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন - ঐ সব অভিজ্ঞতা  যদি বলেন!”

“হ্যাঁ, সত্যিই সেটা মনে রাখার মতই”। একটু নড়ে বসলেন শিল্পী। “সেবারে সোভিয়েট ইউনিয়ন,পোল্যান্ড, রোমানিয়া, য়ুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া এসব জায়গায় গিয়েছিলাম। ওরা কতটা কী বুঝত জানতাম না। তবে রবিঠাকুরের নামেই নিশ্চয়ই অডিটোরিয়াম কিন্তু খুব একটা খালি দেখিনি কোথাও। রাশিয়ার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। বোধহয় ‘পল্লবী গো তুমি সঞ্চারিণী’ গানটা গেয়েছিলাম, শেষ করতেই দর্শকমহলে প্রচন্ড গোলমাল শুরু হয়ে গন। দেখি - সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সামনের সিটটা চাপডাচ্ছে, দু’হাত তুলে নিজেদের ভাষায় কিছু বলছে, অনেকে আবার দু’হাতের বুড়ো আঙুল তুলে উত্তেজিত। আমার তো নাজেহাল অবস্হা, ওদের ভাল লাগছে না বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি কী করব তখন? উঠে পড়ব? হতাশভাবে এদিক সেদিক তাকাচ্ছি।  হারমোনিয়মের বেলোটা দু:খের সঙ্গে বন্ধ করে উঠেই পড়লাম। আমাদের দেশের রীতি অনুযায়ী দর্শকদের অভিশাপ স্বীকার করে, মাথা নীচু করে নমস্কার করলাম। মঞ্চ ছাড়তে সত্যিই খুব কষ্ট লাগছন, অপমান লাগছিল। কলকাতার কাগজে কাগজে এই লজ্জাজনক বর্ণনার ভাষা চোখে সটান ভেসে উঠল চোখের সামনে।

হঠাৎ উইংয়ের পাশ থেকে কোঅর্ডিনেটর মলোটভ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। ইংরেজীতে বললেন, “মি: মুখার্জি, আপনাকে যেভাবে ওরা সম্বর্ধনা জানাচ্ছে, রাজ সাহেবের (রাজকাপুর)পর এমনটা আমি দেখিনি”।

“কী বলছেন? ঐ যে বুড়ো আঙুল…!”

“সে কি, জানেন না আপনি? প্রশংসা, প্রশংসা - থামস্ আপ! আর আপনি যে একেবারে উঠে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে দর্শকদের সম্মান জানালেন - তাতে ওরা অভিভূত”। মাইকে কিছু বললেন - সমস্ত হল আবার ফেটে পড়ল, এবারে ওদের মুখের উচ্ছসিত ভাষা পড়তে আমার ভুল হল না। তীব্র আলোগুলো তখন তো হলঘরের শ্রোতাদের ওপরেই ফোকাস ছিল”।

সুমিতা বললো - “ওরে বাবা, দারুণ এক্সপিরিয়েন্স তো? ভাবতেই পারছি না!”

“হ্যাঁ, অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ওরা বোধহয় সুর আর ছন্দতেই আকৃষ্ট হয়েছিল। আর বাদ্যন্ত্রীদেরও অবশ্যই যথেষ্ট অবদান ছিল”।

আমার মামা, সবসময়েই আমাদের মধ্যেকার গাইয়েদের প্রোমোট করার চেষ্টা করতেন নামকরাদের সামনে - যদি ওরা নামী কারুর চোখে পড়ে যায়, যদি আকাশবাণীতে তালিকাভুক্ত হতে পার। তাই করলেন মামা, দু’তিন জনের পর মহুল গানটা আরম্ভই করল মাঝখান থেকেই -

“তুমি নও তো সূর্য নও তো চন্দ্র

তোমার তাই বলে কি কম আনন্দ

তুমি আপন জীবন পূর্ণ করে আপন আলো জ্বেলেছো”।

গানটা সুন্দর ভাবেই শেষ হল। দ্বিজেনবাবু কিছু বলার আগেই কেতকীমাসী বলে উঠলেন – “বাবা দ্বিজেন, এ গানটা কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে একেবারে প্রযোজ্য - তোমার যা আছে তা তোমার আছে, তুমি নও তো ঋণী কারো কাছে, তোমার অন্তরে যা শক্তি আছে তারই আবেশ ঢেলেছ। তুমি তুমিই, আর হেমন্ত - হেমন্ত। তুলনা করার তো কিছু নেই - নিজের পথে নিজের সাধনা”।

দ্বিজেনবাবু কোন কথা বললেন না, অত উঁচু মাথাটা বুকের কাছে নামিয়ে চোখ বন্ধ করে মাসীমার দিকে তাকিয়ে দু’হাত জোড় করে প্রণাম করলেন। অবশ্য

মাসীমার জন্যে না কবিগুরুর উদ্দেশ্যে - বোঝা গেল না।

নিজের হারমোনিয়মটা টেনে নিয়ে এবার সুর দিলেন, পরমেশদার তবলায় পড়ল চাঁটি, পরের দুটো ঘন্টা তরঙ্গে তরঙ্গে পাল তুলে বসুভবনের উঠোনে, অলিন্দ, ঘরের কোণায় কোণায় সুরের মায়াজাল বিছিয়ে দিয়ে গেলো।

তার মাঝে মাঝে কিন্তু আলাপচারিতাও সমান তেজে চলেছে।

“রবীন্দ্রসঙ্গীতের তো কোন কথাই নেই, তবে ছায়াছবি, আধুনিক এসবে আপনার কখনো অসুবিধা হত না?”

“না, তেমন না, প্রায় শ’পাঁচেক গাওয়া হয়েছে তো। তবে, সলিলবাবুর সুরগুলি ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং”।

“মানে? অসুবিধা হত?”

“না, সেরকম নয়। ওনার সঙ্গে আমার জানাশোনা তো সেই আই পি টি এর সময় থেকে। আমি সবসময়েই বলি ওনার সুর আগামী কয়েকটা প্রজন্মকেও সন্মোহিত করবে। একদিন ফিরে যাবো চলে, সজল সজল মেঘ করেছে, পল্লবী গো সঞ্চারিণী। তারপর মাইকেল মধুসূদন ছবির গান? বোম্বেতে ওনার বাড়িতে গেছি, উনি দোতলায় সুর করছিলেন। নেমে এসে বললেন - ভাল হয়েছে, দেখি এই গানটা তোল তো চট করে! ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ বাজিয়ে শোনালেন, গাইতে বললেন। আচ্ছা, আপনারা বলুন তো ‘চিরস্হির কবে নীর হায় রে জীবন নদে’ - এইরকম একটা কঠিন বাক্যস্রোতকে আর কেউ কি ঐরকম অসাধারণ  সুরে গলিয়ে দিতে পারেন? সোজা কাজ? সত্যিই উনি ক্ষণজন্মা!”

হঠাৎ পল্লব বলে বসল - “আচ্ছা, এখনকার বাংলাব্যান্ড আর আধুনিক গান সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা দ্বিজেনবাবু? আপনাকে কিন্তু এখনকার লেখা কারুর গান গাইতে শুনিনি!”

“সে তো এক এক যুগের সৃষ্টি একেক রকম হবেই। আমার গলায় ঐসব নাও আসতে পার। তবে খারাপ লাগে যখন আমাকে কেউ কেউ বলেন আপনি আজকালকার জীবনমুখী কোন গান করেন না কেন? আমি দু’তিনজন অতি উৎসাহীকে বলতে বাধ্য হয়েছি - কেন মশাই, আমি কি এতদিন মরণমুখী গান গেয়ে এসেছি?” বলার ধরনে সবাই হেসে উঠল বটে, তবে প্রচ্ছন্ন বেদনার চাবুকটা একটা সূক্ষ্ম আঁচড় দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে গেল বুকের গ্রন্থিগুলি।

রাত গড়াচ্ছে জামসেদপুরের আকাশে, পূবের দিকটা গোলাপী হয়ে উঠেছে ব্লাস্ট ফার্ণেসের লোহাগলানো আগুনের আঁচে। খাবার টেবিলের বিবরণটা আর দিলাম না, ওটা মাতাঠাকুরাণীর নিজস্ব লীলাক্ষেত্র। আইটেম, স্বাদ আর নিজস্বতায় কত যে স্টার মার্ক পেয়েছেন, সেটা গণনার মধ্যে আনতেই চান না উনি।

কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, স্মৃতির আকাশ থেকে ঝরছে ফুলঝুরি - অবিরাম। স্মৃতিচারণটা যথেষ্ট লম্বা হয়ে যাচ্ছে - পাঠক পাঠিকাদের ধৈর্য বা প্রশ্রয়ের সীমারেখা পরীক্ষা করা আর উচিত হবে না, ভবিষ্যতে ব্রাত্য বলে পরিচিত হবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। তাই দু’একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে ইতি টানছি।

খাওয়ার টেবলে খোশগল্পের পর দ্বিজেনবাবুকে নীচের ঘরে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়ে বাড়ির পেছনের পেয়ারা, আম, কাঁঠাল, শিউলী গাছের ছায়াছায়া অন্ধকারের দিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “আচ্ছ কানুবাবুশ, নীচে আর কেউ থাকবে না - মানে একা, অন্ধকার ফাঁকা উঠোন, ইয়ে –

আমি অভয় দিলাম, “দ্বিজেনদা, আমাদের পাড়া সাউথ পার্ক খুবই সেফ্, চোর-ডাকাত, বাজে লোকেরা আসতেই পারে না কোনদিন। তাছাড়া কোলাপ্সিবল গেট”।

“না না, মানুষ টানুষ নয়, মানে ঐ… মানুষদের তো তবু দেখা যায়, আসলে যাদের দেখা টেখা যায় না, তাদের নিয়ে একটু ভয়ের ব্যাপার থাকে না? অন্ধকার তো!”

দুটো রাত্তির, আমার ডাক্তার দাদার নীচে পাশের ঘরে শোবার ডিউটি পড়ে গিয়েছিল।

শেষ দেখা হয়েছিল যেদিন, সেদিন কিন্তু উনি মায়ের হাতের চিংড়ি মালাইকারীর কথা তুলেছিলেন। সেটা ছিল তাজ বেঙ্গলের ব্যাংকোয়েটে, সালটা মনে নেই। কেমন করে জানি না, একটা ইনভিটেশান পেয়েছিলাম, যেখানে বাঙলার তখনকার সময়ের অনেক গুণীমানুষজনকে সম্মানিত করা হয়েছিল। গান গেয়েছিলেন বাংলাদেশের বন্যা। রীতাকে নিয়ে ঢুকতেই একজন কর্মকর্তা এসে চুপিচুপি বললেন “ স্যার, মি: চ্যাটার্জি এসেছেন”। বুঝলাম সৌমিত্রদার কথা জানালেন উনি। আশেপাশের প্রতীক্ষারত কর্মকর্তা আর স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে সৌজন্যবিনিময়ের পরে বললাম-

“কোথায় উনি?”

“আসুন স্যার”।

দীপ্যমান হয়ে বসেছিলেন সৌমিত্রদা, হলের মাঝামাঝি - কখনই দেখিনি নিজের প্রাধান্য বা উপস্হিতি জাহির করতে। সাধারণ কথাবার্তার পর বললেন, “অম্লান,  দ্বিজেনবাবুর সঙ্গে দেখা হল? উনি এসেছেন তো!”

“না না, জানি না তো! কোথায়?” সামনের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

গেলাম অনিশ্চিত দৃষ্টি মেলে - অনেক বছর তো কেটে গেছে। চিনতে পারবেন না জেনেও বলতে হল-

“চিনতে পারছন না তো দ্বিজেনদা?” ওনাকে অপ্রস্তুত হবার সময় না দিয়েই  বলে উঠলাম-

“জামশেদপুর বসুভবন, নীহারমাসিমা, পেরুমামা…”

আস্তে করে স্মৃতির ছায়া সরে যেতে দেখলাম, চওড়া মুখটা একটু উজ্জল হল মনে হল।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওরে বাবা! তা তুমি দ্রৌপদীর কোনজন?”

আশ্চর্য হবো না? আমাদের মনে না থাকলেও দ্রৌপদী দিদিমাকে ঠিক মনে ধরেছে?

“নীহারদি কেমন আছেন, উফ্ - সেই মালাইকারী, মোচার চপ্! ঢাকাই পরোটা আর কষামাংস ভুলব কী করে?” কিছুক্ষণ নতুন পুরনো আলাপচারিতা হল।  আলাপ করিয়ে দিলেন - সুনীল, শঙ্খ ঘোষ, পার্থ ও গৌরী, শুভাপ্রসন্ন, রুদ্রপ্রসাদ, নবনীতা আরও কয়েকজনের সঙ্গে।

নবনীতা নিজস্ব স্টাইলে বললেন - “নিশ্চয়ই অভিনয় জগতে আছেন, দেখেছি মনে হচ্ছে!” মুখ দেখে তামাশা করছেন কী না বোঝা গেল না।

পার্থ ঘোষ গলার নিজস্ব গভীরতায় জিজ্ঞেস করলেন - “আপনি কি বাচিক শিল্পী? আকাশবাণী বা দূরদর্শনের সঙ্গে যুক্ত আছেন? গলাটা শুনে মনে হচ্ছে”।

কে বলছেন? পার্থ ঘোষ। কাকে বলছেন গলার কথা? আমাকে!

কোথায় লুকাই অপদার্থ মুখটা?

রুদ্রপ্রসাদ স্মিতমুখে অপেক্ষা করছিলেন।

এত গুণী মানী শিল্পীদের সব ধারণাই যে অসার, একেবারে ভিত্তিহীন, সেটা বলতেও লজ্জা, তবু বলতে বাধ্য হলাম। আমার মত এক ধূলিকণার, ঐ সংস্কৃতিবানদের প্রতিভার ঢেউয়ে নিজের মাটি আঁকডে থাকার চেষ্টা খুই দুস্কর এবং লজ্জাজনক। বিব্রত মুখে মাথাটা একটু নাড়িয়ে পটপরিবর্তনে সচেষ্ট হয়ে তাড়াতাড়ি আবার দ্বিজেনদার দীর্ঘ ছায়ার তলায় আশ্রয় নিলাম।

“দ্বিজেনদা, এখনও গান গাইছেন তো?”

“হ্যাঁ, মানুষেরা যতদিন শুনতে চাইবেন আর কি। এই তো সামনের সপ্তাহেই দিল্লী যাচ্ছি - আকাশবাণীতে একটা পরিবেশন করার আছে।

ঠিক তখনই মধুবন্তীর সুরেলা গলা নিজস্ব একতারায় ঝিমঝিম করে উঠলো - রেজওয়ানা চৌধুরী মিষ্টি চেহারায় মঞ্চ আলোকিত করে এসে বসলেন।  যন্ত্রশিল্পীরা পাশাপাশি নানা বাদ্যযন্ত্রের হাল্কা ঝংকার তুলছেন, সঙ্গত করার জন্যে সসম্মানে তৈরী। অডিটোরিয়ম স্তব্ধ প্রতীক্ষায় উন্মুখ।

সবাইকে হাত নাড়িয়ে আর দ্বিজেনদার দু হাতে শ্রদ্ধা আর অগাধ শুভেচ্ছার চাপ দিয়েই নিজের জায়গায় ফিরে এলাম।

সেই শেষ। এর কয়েকবছরের মধ্যেই দেশে এসেছিলাম, ২০১৮র শীতকালে। সেই বছরে বড়দিনের আগেই উনি চলে গেলেন। ঐরকম মাপের শিল্পী বড়দিনের জন্যে অপেক্ষা করলেন না, তার আগের দিনই চলে গেলেন। রেখে গেলেন চিরবহমান সুর আর সাধনার অবিস্মরণীয় অনুরণন, অসংখ্য অনুরাগীর সীমাহীন শ্রদ্ধা আর অগাধ ভালবাসার শেষপারাণীর কড়ি সঙ্গে নিয়ে। দেশে বিদেশে যখনই মহালয়ার শিউলিঝরা ভোরের ফুটি ফুটি আলোতে প্রাণে যান্ত্রিক মাধ্যমে হিল্লোল তোলা সেই গভীর স্বর “জাগো দূর্গা, জাগো মা” আমাদের প্রতিটি রোমকে আগমনী সুরে উত্তাল উদ্বেল করে তোলে, তখন মুহূর্তের জন্য হলেও, ওনার অনুপস্হিতিটা কাঁটা হয়ে বিঁধতে থাকে। তখনই দ্বিজেনদার গলায় বসুভবনের প্রতিটি কড়ি বরগায়, প্রতিটি কোণায়, সিঁড়ির ধাপে ধাপে মূর্চ্ছনায়  কবিগুরুর অবিস্মরণীয় বার্তা হাহাকার করে গুমরে ওঠে (মাপ করবেন, একটু পরিবর্তিত প্রকাশে) -

কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।

সকল খেলায় -

মহালয়ায় থাকব তখন এই আমি,

আ - হা, কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন