কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ৩০ মে, ২০১৪

০৬) তুষ্টি ভট্টাচার্য

বনসাই


এভাবেই ছোট্ট একটা চ্যাপ্টা টবে রয়েছি দশ বছর ধরে। নড়তে চড়তে পারার উপায় নেই। আমার পূর্বসূরিরা কেউই অবশ্য নড়াচড়া করেনি, তবু শ্বাস নিয়েছিল প্রাণ ভরে, হাত পা মাথা ঝাঁকিয়েছিল সুখে-দুঃখে। কৈশোর যৌবনের বাড়ন্ত গড়নে ধরে রেখেছিল ওদের উদ্দাম স্পর্ধা। আর আমার সেই ছোটবেলাতেই হাত পা বেঁধে ফেলে রেখেছিল কেউ। ওরই মধ্যে যেই মাথা চাড়া দিতে গেছি, কাঁচি দিয়ে টুক করে কেটে ফেলেছে আমার দৈর্ঘ্য। আমাকে এখনও সেই ছেলেমানুষই দেখায়, যদিও হাবেভাবে চেহারায় বয়স্ক গম্ভীর ভাবকে খুব যত্নের সঙ্গে আরোপ করা হয়েছে আমার ওপর। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি যেন সেই বামন অবতার!


কিছু মানুষের খেয়াল খুশির শখকে আমার মোটেই বিজ্ঞান মনে হয়নি কখনই। আমি ভুক্তভোগী বলেই জানি, এ হলো সবলের দুর্বলের ওপর অত্যাচার। আমার শরীরকে বাড়তে দেওয়া হয়নি জোর করে । আমি যত হাতে পায়ে দামাল হয়ে উঠতে থাকি, ওদের শাসন ততই বাড়তে থাকে। আমিও তো জেদে কম ছিলাম না! হাতে পায়ে পারছিলাম না বলে মাটির ভেতর বাড়াতে লাগলাম আমার রাগ। ফুঁসে উঠলাম। এক সময়ে পায়ের তলার সমস্ত মাটিকে তালগোল পাকিয়ে আয়ত্বে নিয়ে এসেছিলাম আমার। কিন্তু সে সুখও বেশিদিন সইল না।

আমার শক্তির প্রধান উৎস, প্রধান মূলকে কেটে ফেলল ওরা এবার। আমি ভেঙে পরলাম এবার, শরীর মন নিস্তেজ হয়ে এলো। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখলাম, তবু মৃত্যু এলো না আমার, আমারই অদম্য প্রাণশক্তির জেরে। যেখানে ছিলাম, তার থেকেও ছোট এক চ্যাপ্টা টবে তুলে আনল ওরা আমায়। জল দিল এক ঢোঁক, কিন্তু খেতে দিল না কিছু। তবুও মরলাম না, ধিকধিক করে বেঁচে রইলাম।

ধাতস্থ হতে কয়েকদিন সময় লাগল। ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে লাগলাম আবার, আবার সব ভালোলাগাগুলো ফেরত এলো। ভাবলাম, আবার না হয় বাঁচার চেষ্টা করি! সমস্ত শক্তি নিয়ে এলাম মনে, মাথা তুললাম, এক আধ ইঞ্চি বেড়েও গেলাম এই অসময়ে। এইটুকুতেই খুশি হচ্ছিলাম, কারণ এর বেশি আমার আর কিছু করার ছিল না। যতদিন বাঁচব, না হয় এভাবেই তিলেতিলে বাঁচি!


এটুকু সুখও সইল না আমার কপালে। ওইটুকু বাড়বৃদ্ধিও মানল না ওরা। আমাকে ঘিরে আয়োজন জোরালো হচ্ছিল ক্রমশ। কিসের আয়োজন টের পেলাম দুদিন পরেই। এবার ওরা আর আমার মাথা ছেঁটে দিল না। ছাঁটল না অবশ্য ওদেরই স্বার্থে। কাটতে গেলে যে ক্ষতস্থান তৈরি হবে, তা নাকি বড্ড বাজে দেখাবে! অতএব নুইয়ে দিতে হবে মাথা! সরু তার দিয়ে টান করে বেঁধে দিল মাথাটা আমারই গোড়ার সাথে। সারা গায়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অজগরের পাকের মতো তারের বাঁধন পড়ল। ব্যাস, এভাবেই রয়ে গেলাম বেশ কয়েক বছর ধরে। যেহেতু মরিনি, তাই বাঁধনের ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু জায়গা পেলাম, ফুলে ফুলে উঠতে লাগল শরীর। যৌবনে বৃদ্ধ বৃক্ষের মতো ঝুরি নামল আমার শাখা প্রশাখা থেকে। তালগোল পাকিয়ে শিকড়ে জট ধরে গেল বেশ। আর এটাই ওরা চেয়েছিল! নিচের দিকে ঝুঁকে পড়া, গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারার এক বেঁটে গাছ।

আরও যেন কতদিন, কত যুগ গেল, হিসেব রাখিনি। শুধু বেঁচে আছি, এটুকু টের পেতাম। একমাত্র আনন্দ ছিল বৃষ্টির দিনগুলোয়। বোধহয় এই বৃষ্টিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। একসময় দেখলাম, সব বাঁধন খুলে দিল কেউ। তবে তখন আর আমার কাছে মুক্তি পাওয়ার খোলা হাওয়া এসে পৌঁছল না। বন্ধন, মুক্তি এসবের ঊর্ধ্বে তখন আমি। প্রাণ থেকেও জড়বস্তু এক। কেউ একজন এসে এবার ফিনিশিং টাচ দিতে এলো আমার শরীরে। গা খুবলে কয়েকটা কোটর এঁকে দিল, ঘষে ঘষে উঁচু নিচু, এবড়ো খেবড়ো সমান হতে লাগল। অবশেষে শেষ হলো ওদের কর্মকাণ্ড। আকারে প্রকারে যার হওয়া উচিত ছিল শালপ্রাংশু, সে আজ দীর্ঘদেহী বৃক্ষের বামন সংস্করণ মাত্র, এক সৌখিন বনসাই।

3 কমেন্টস্: