কোরোনা রে কেউ ঝগড়াঝগড়ি, মানা হোক শক্তই
করোনা-সগড়ি
ছ’বছর ধরে লিখতে থাকা একটা অপাঠ্য
বই করোনায় আগে কেটে গেলে অসমাপ্ত রয়ে যাবে এই ভয়ে গত মার্চ থেকে এই এপ্রিল পর্যন্ত
খেটে শেষ করতে গিয়ে বাংলা লিখতে প্রায় ভুলেই গেছি। কিন্তু কাজলবাবুর অনুরোধ এবার লেখা
দিতেই হবে। লিখতে গিয়ে মনে এলো এই কথাটা।
লেখার নাম দেখে নতুনরা জিজ্ঞেস
করতে পারেন সগড়ি-টা আবার কী ব্যাপার। হ্যাঁ, অধুনা অচেনা এই কথাটি একটি দেশি শব্দ।
হাওড়া হুগলি জেলায় সকড়িও বলতো। তবে অভিধানকার হরিচরণ সকড়া, সকড়ি, সখড়া, সগড়ি, সঁকুড়ি
এই সবগুলিকেও ঠাঁই দিয়েছেন। আজ থেকে ষাট-আশি বছর আগে কারুকে মানে ব’লে দিতে হতো না।
ভাত থেয়ে মুখ না ধুয়ে, আসন বা পিঁড়ি থেকে উঠে ধুতিচাদর, গা’গতর ভালো ক’রে চেক না ক’রে
বিছানায় বসার যো ছিল না। একটা বা আধখানা ভাত
জামাকাপড়ে থেকে গেলেই বিছানা সগড়ি/সকড়ি। বিছানায় পড়লে ভাত তো কথাই নেই! সবই আবার ক্ষারে
কাচতে হবে। সকড়ি-দোষীকে জামা কাপড়ও ছাড়তে হবে। শীতে বেরাতে চান করতেও বা না করতেও হ’তে
পারে, বাড়িটি ব্রাহ্মণ কিনা, অব্রাহ্মণ কিনা; ব্রাহ্মণ হ’লে নৈকষ্য, বা কুলীন কিনা;
রাঢ়ী, বারেন্দ্রী, বা পুবের মানে বাঙাল কিনা; এই সব বিবেচনায়। কতখানি অসৈরন কে সয় তা
এই সবেরই উপর নিভ্ভর করে কিনা!
সাহিত্যেও সগড়ি ছিল। অন্য বানানেও!
বঙ্কিমচন্দ্রের ঐ দেবী চৌধুরানী-র গপ্পোটা
মনে আচে? শর্টে বলি! সেই যে ব্রজেশ্বর সাগরের বাপের বাড়িতে বাপের দেনা শোধের কারণে
গিয়ে শ্বশুরের ক্যাঁটক্যাঁট কথা শুনে রাগে ফুলে চলে আসার সময় পা আঁকড়ে ধরা সাগরের কোল
থেকে পা জোরে টেনে বের করতে গিয়ে গায়ে লাগিয়ে
বসলো, আর সাগরের আহত স্বাভিমানের মুখে বসিয়ে দেবী জানলার বাইরে থেকে বসিয়ে দিলেন এই
কথাটা যে “কিন্তু আমি যদি ব্রাহ্মণের মেয়ে হই, তবে তুমি আমার পা— … … আমার পা কোলে
লইয়া চাকরের মত টিপিয়া দিবে।” তারপর যখন পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তনের পথে ব্রজেশ্বরকে যখন
রঙ্গলালকে দিয়ে বজরায় তুলে তাকে সাগরের পা
টিপে দেবার অনিচ্ছুক শপথ পালন করার রোম্যান্টিক সুযোগ করে দেওয়া সহ, দেবী থুড়ি প্রফুল্ল,
নিশিঠাকরুনকে পাঠালেন তার খেদমত করতে, তখন ব্রজেশ্বরের সামনে সাগরের সঙ্গে রহস্যালাপের
মধ্যে নিশির সেই কতাগুনো মনে আছে?
“নিশি।আমি ত তা মনে করি— পুরুষ
মানুষ স্ত্রীলোকের তৈজসের মধ্যে। না থাকিলে ঘর সংসার চলে না— তাই রাখিতে হয়। কথায় কথায়
সক্ড়ি হয়— মাজিয়া ঘষিয়া ধুইয়া ঘরে তুলিতে নিত্য প্রাণ বাহির হইয়া যায়। না ভাই সাগর,
তোর ঘটিবাটি তফাৎ কর— কি জানি, যদি সক্ড়ি হয়।” এখানে কথাটা কিন্তু সক্ড়ি!
কিম্বা মনে করুন দীনবন্ধু মিত্রর
বিয়ে পাগলা বুড়ো প্রহসনে রাজীবলোচন মেয়ে
রামমণি তাকে এই প্রশ্ন করায়, — তা বাবা তুমি রাগ কর কেন, পেঁচোর মা হলো ডোম, পেঁচোর
মারে তুমি বিয়ে কত্তে গেলে কেন’ অগ্নিশর্মা রাজীবলোচন তার এঁটো ভাত তার গায়ে ছড়িয়ে
দেয়। তখন সংলাপে আসে এই সংলাপ, “রাম। এমন কপাল করেছিলেম — ঘর দোর সব সগড়ি হয়ে গেল।”
এখানে কথাটা সগড়ি।
কিম্বা মনে করুন বিভূতিভূষণের
পথের পাঁচালীর সেই অংশটা আকাশে উড়ন্ত চিল দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেলে বিধুর অপু, “… অমনি সে চোখ নামাইয়া লইয়া
বাহির-বাটী হইতে এক দৌড়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় উঠিয়া গৃহকার্য্যরত মাকে জড়াইয়া ধরিত। মা
বলিত — দ্যাখো দ্যাখো, ছেলের কাণ্ড দ্যাখো — ছাড় ছাড় — দেখছিস সকড়ী হাত?” এখানে কথাটা
সকড়ী!
মানে, আমরা সেই সময়ের লোক যখন
বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, “কথায় কথায় সকড়ি হয়”। তার সঙ্গে এই ২০২১-এর করোনার সম্পক্ক কী?
আমরা আর সগড়ি মানি নাকি? আচে, স্যার। মনে করুন আপুনি হাঁটতে বেইরেচেন। বেরোনর সময় কী
করবেন? আমার মতো চললে, আগে সাতদিন আগে ছেড়ে রাখা একটা জামাপ্যান্ট গলাবেন, তারপর হাত
সাবান দিয়ে ধোবেন, বা স্যানিটাইজারে মুছবেন।
এবার নাকে দুটো মাস্ক লাগিয়ে
হাত সাবান দিয়ে ধোবেন, বা স্যানিটাইজারে মুছবেন। তাপ্পর জুতো প’রে ফিতে বেঁধে তারপর
হাত স্যানিটাইজারে মুছবেন বা সাবান দিয়ে ধোবেন। তারপর ধোয়া চাবি হাতে নিয়ে তালায় ঢুকিয়ে
হাত স্যানিটাইজারে মুছবেন বা সাবান দিয়ে ধোবেন। হ্যাঁ আগে বাড়ির গেটটা বন্ধ ক’রে নেবেন।
নইলে আবার গেট বন্ধ করার পর হাত স্যানিটাইজারে মুছতে বা সাবান দিয়ে ধুতে হবে। সে যাই
হোক পোস্কার হাতে ব্যাগ থেকে ফেসশিল্ডটা বের করে হাত হাত স্যানিটাইজারে মুছে বা সাবান
দিয়ে ধুয়ে মাথায়, না না মুখে লাগাবেন।
এবার হেঁটে ফেরার পর প্রথমে হাত
সাবান দিয়ে ধোবেন, বা স্যানিটাইজারে মুছবেন। ধুয়েমুছে ফেসশিল্ডটা বের করে ডেটল জলে
ডোবাবেন, আর মাস্কগুলো টাঙিয়ে দেবেন, এবার হাত স্যানিটাইজারে মুছবেন বা সাবান দিয়ে
ধোবেন। তারপর জামাকাপড় ইউভিবক্সে ঢুকিয়ে, কিম্বা কোনো অগম্য আলমারিতে সাতদিনের জন্যে
ঝুলিয়ে তারপর হাত সাবান দিয়ে ধোবেন, বা স্যানিটাইজারে মুছবেন। তারপর স্যানিটাইজারের
শিশির গায়ে সাবান বুলিয়ে রেখে হাত স্যানিটাইজারে মুছে বা সাবানজলে ধুয়ে, শিবল্যাংটা
গায়ে জল ঢালবেন। তাপ্পর গা মুছে বেরিয়ে দেখে নেবেন আধঘন্টার হাঁটার আগেপরে হাত স্যানিটাইজারে
মুছতে বা সাবান দিয়ে ধুতে কতক্ষণ লেগেছে। যদি দেড় ঘন্টার মধ্যে হয়ে গিয়ে থাকে, তবে
বুঝবেন যে আপনি কোভিড প্রোটোকলের কোবিদ হয়ে গেছেন। আর হ্যাঁ, আর একটা কথা বুঝবেন, সকল
সকড়ির বাবাসগড়ি হলো করোনা সক্ড়ি।
কিম্বা শিব্রামের গল্পে সেই মহিলা
যাত্রিণীর মতো ক্রমাগতঃ ছোটব্যাগ থেকে বড়ব্যাগ বের ক’রে বড়ব্যাগ বন্ধ ক’রে, ছোটব্যাগ
থেকে পয়সা বের ক’রে ছোটব্যাগ বন্ধ ক’রে বড়ব্যাগ খুলে, আবার বড়ব্যাগ খুলে তার পরে ভিতরে
ছোটব্যাগ রেখে বড়ব্যাগ বন্ধ ক’রে ইত্যাদিতে কন্ডাক্টরের হাতে চড় খাওয়া মহিলার মতো,
বা আমার মতো গুলিয়ে যাওয়া পাবলিকে চড় মারার ইচ্ছে দমন ক’রে একটা পন্থা বের করুন করোনাসগড়ি
আটকাবার! প্লিজ!
তবে এই সব কিছুই না ক’রেও পার
পেতে পারেন যদি এই যুযুধান দুই দলের রোড শো, সভা ইত্যাদিতে নিয়মিত হাজিরা দেন, চিবুখোশ
(chinask) বা নাখোশ (nosk)পরে’ বা না পরে’। অথবা আরো ভালো হয়ে যদি হরদ্বারের কুম্ভমেলায়
গিয়ে শাহী স্নানটি সেরে নেন। উত্তরাখন্ডের
মুখ্যমন্ত্রীজী তিরথ সিং রাওয়াতজী তো বলেই দিয়েছেন যে ২০২০ সালে দিল্লিতে তবলিঘি জামাতের
ডাকে ৭০ দেশ থেকে জানুয়ারি থেকে মার্চে আসা দুহাজার যাজক আর ২৫শে মার্চে লকডাউন চালু
হওয়ায় নিজামুদ্দিন মার্কাজে আটকে যাওয়া একহাজার
যাজকের দ্বারা ছড়ানো করোনা সংক্রমণের সঙ্গে কিছুতেই তুলনা করা যাবে না ২০২১-এর মহাকুম্ভ
মেলায় সোমাবতী অমাবস্যার শাহী স্নানে অদ্যাবধি ৩৫ লক্ষ মানুষের গঙ্গাবগাহনের। কারণ
তবলিঘি হয়েছিল ঢাকা জায়গায় ‘কোঠি ধরণকা কাঠামোতে’, আর শাহী স্নান হচ্ছে ফাঁকা জায়গায়, শ্রোতস্বিনী গঙ্গার তীরে। আর তবলিঘির
লোকরা ছিল বাহারকা, আর কুম্ভের লোক হামাদের! ১০ই এপ্রিল থেকে কুম্ভমেলা প্রাঙ্গনে ১২৭৮
জন সংক্রমিত হোক না, আর একই সময়ে হরদ্বার জেলায় যার অনেক অঞ্চল কুম্ভমেলা প্রাঙ্গনের
অধীনে পড়ে ২১৬৭ জন সংক্রমিত হোক না!
মানছেন, তিরথজীর কথা? তবে গোল্লায়
যান! মানছেন না, সত্যি? তবে করোনাসগড়ির আচার এক্ষুণি শুরু করুন। কুসংস্কার ফিরে আসুক
সুসংস্কার হয়ে। কোভিড প্রোটোকলের নাম দিন করোনাসগড়ি। নইলে এমনিতেই ভোটের পরে কে জিতবে
জানিনা। তবে রাজ্য ফৌত হয়ে যাবে!
এটো বা এ রকম কোন বর্তমানে চলিত শব্দের টিপ্পনি ব্যবহারে আরও ভালো বুঝতে সুবিধা হতো
উত্তরমুছুন