কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

অচিন্ত্য দাশ

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৫


আমফান

আসলে নাকি উমফুন। শ্যামদেশের ভাষায় আকাশ। তা সে তো আসছে সেদিক থেকেই। চারুপিসী সব খবর রাখে। টিভিটা খুব মন দিয়ে দেখে তো! ছেলে থাকে  কেরেলায়, মেয়ের বিয়ে হয়েছে বালুরঘাটে। আজ পনেরো বছর হয়ে গেল স্বামী মারা গেছেন। একা থাকা ছাড়া উপায় নেই। করোনাকাল বলে ছেলে-মেয়েরা কতদিন কেউ আসেনি। চারুপিসীর এই গলির ভেতর এক-কামরা ঘরে অবশ্য কেউ তেমন আসে না, এক পাশের বাড়ির ঊষা ছাড়া। কলেজ পাশ করে বসে আছে বাড়িতে।

-চারুপিসী, বিরাট ঝড় আসছে, শুনেছ?

-হ্যাঁ রে হ্যাঁ, টিভিতে তো সারাদিন ঝড়ের কথাই বলছে।

-হুঁ, বাড়ি থেকে বাইরে যেওনা, উড়িয়ে নিয়ে যাবে, হি হি…

-নিয়ে গেলে ভালোই হয় রে ঊষা, কতদিন বাইরেটা দেখিইনি…

সন্ধের পরে ঝড় এলো। এই গলির ভেতর থেকেও চারুপিসী টের পেল হাওয়ার তাণ্ডব আর সে কী বৃষ্টি! থেকে থেকে নীল বিদ্যুৎ আর কানে-তালা-লাগানো  করাক্কর বাজ। এমন সময় ইলেক্ট্রিক গেল। যাঃ! ঘোর অন্ধকার। চারুপিসীর  মাথাটা টলে গেলো, প্রেশারের ওষুধ তো খেয়েছে আজকে, তাও কী হলো? চারুপিসী বসে পড়ল মেঝেতে। মাথা ঘোরার মধ্যেই টের পেল ঝড়ের দাপটে জানালার কাচ কেঁপে কেঁপে উঠছে, এই বোধহয় ভেঙে পড়বে!

তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়েছিল। হুশ ফিরল ভোরের দিকে। দুর্বল লাগছে খুব, কোনোরকমে খাটের পায়া ধরে উঠল।

ঊষা এল বেলার দিকে। কী গো চারুপিসী, কেমন ঝড় হলো বলত! রাস্তায় কত  যে বড়বড় গাছ পড়েছে, কী বলব! গাড়িফাড়ি তো সব বন্ধ। তোমাকে যেন আজ কেমন শুকনো শুকনো লাগছে…

-শরীরটা ভালো নেই রে। এই, একটু চা করবি? মুড়ি বার করি, দুজনে বসে খাই।

চা খেতে খেতে উষার চোখে পড়ল জানালার কাচে একটা ফাটল ধরেছে। নির্ঘাত  কাল ঝড়ের ঝাপটা লেগেছে। বলল, এ হে, তোমার জানালটা দেখেছ, কাচটা তো গেছে! সারিয়ে নাও, হাত কাটবে… কানাইকে ডাকি বরং, কাচ সারায়…

বিকেলে কানাই এলো। ঊষাই নিয়ে এসেছে। দেখল চারুপিসী চিড় ধরা জায়গাটা  গোল করে দাগিয়ে দিয়েছে রক্তচন্দন দিয়ে।

-বাঃ, একেবারে দাগিয়ে রেখেছ! কানাই খরচা কীরকম হবে বল তো? বেশি চাইবে না কিন্তু…

চারুপিসী বলল, না কানাই। সারাবার দরকার নেই। যেমন আছে, থাক।

কানাই গজগজ করতে করতে চলে গেল। ভীমরতি আর কাকে বলে! ঊষাও অবাক।

-কী হল তোমার? কাচটা পাল্টে নিলে না?

-না রে। ওটা থাক।

সন্ধের মুখে ঊষা চলে গেল।

চারুপিসী চন্দনের দাগ লাগানো কাচটার দিকে হাতজোড় করে একদৃষ্টে চেয়ে ভাবছিল, কাল রাতে বিশালকায় প্রলয়কেশী অচেনা এক পুরুষ সাগর-মহাসাগর পার হয়ে এসেছিলেন গলির এই ছোট্ট ঘরে। চারুপিসীকে নিয়ে যেতেই বোধহয়! ভেতরে তো এলেন না তখন, শুধু জানালায় ধাক্কা দিয়ে চলে গেলেন। ওনার আসার চিহ্নটুকু রাখাই থাক না!

 

 


1 কমেন্টস্:

  1. আপনার লেখা গল্প "আমফান" পড়ছিলাম ..!
    পড়া শেষে একটা গান মনে এলো ...

    "যেতে যেতে একলা পথে
    নিভেছে মোর বাতি ...
    ঝড় উঠেছে, ওরে, এবার
    ঝড় কে পেলাম সাথি ..."

    চারুপিসীর পনেরো বছরের সাথিহারা জীবনে একাকীত্ব যখন বেশ আঁট হয়ে এসেছে, তখন বোধ হয় ঝড় এলো বিশ্ব সংসার তোলপাড় করে, অনেক আগল ভাঙ্গার আগাম সংকেত দিয়ে ..!

    চারুপিসি কে হতাশ করে ঝড় কিন্তু চলে গেলো ... রেখে গেলো শুধু ভাঙ্গা কাঁচের ছোট্টো ফুটোয় তার একমাত্র স্বাক্ষর ..!
    চারুপিসি রক্তচন্দন দিয়ে বরণ করে নিলো ঝড়ের সেই প্রলয়ঙ্করী স্বাক্ষর কে, যা চারুপিসির জীবনে মুক্তির অন্য এক হাতছানি, অন্য এক সিলমোহর ...!!
    গল্প টা ভালো লেগেছে ..! ভালো থাকবেন ...!!

    উত্তরমুছুন