কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

অর্ঘ্য ঘোষ

 

সমকালীন ছোটগল্প


হারানিধির প্রেম

ছাতিমতলায় বসে সদ্য কেনা স্মার্ট ফোনটাকে বাগে আনার চেষ্টা করছিলেন অরুন্ধতী। হঠাৎ পিছন থেকে 'কি ঠাম্মা বেশ তো খুটুর খুটুর করছো?  প্রগ্রেস হলো কিছু?'

ঘাড়ের কাছে সুন্দরের গলা পেয়ে অরুন্ধতী মৃদু হাসেন, 'কই আর হলো রে? এখন তো সরগরই হতে পারলাম না।'

'চিন্তা কোর না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।'

উৎসাহ যোগায় সুন্দর। সে’ই কিস্তিতে স্মার্ট ফোনটা কিনে এনে দিয়েছে। শুধু তাকেই নয় আরও অনেককে কিস্তিতে ফোন এনে দিয়েছে সুন্দর। মাসের প্রথম দিকে কিস্তির টাকা নিয়ে গিয়ে জমা করিয়ে রসিদ এনে দেয়। রিচার্জও করে দেওয়া এমন কী টুকটাক সমস্যা হলে ঠিক করেও দেয়। তিনি তো অত সব  জানতেন না।  সুন্দরই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। অ্যাকাউন্ট খোলার সময় ছবি তোলার উপক্রম করতেই তিনি আপত্তি তোলেন , ‘ছবি নিয়ে কি করবি আবার?’

‘বা রে একটা ছবি দেবে না? যারা বন্ধু হবে তারা দেখবে না?’

‘না, না ছবি টবি দেওয়ার দরকার নেই। আসল নাম ধামও দিতে হবে না। এমনিই বেনামে খুলে দে।’

আসলে আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। নিজের বিড়ম্বিত জীবনের কথা তাদের কাছে বেআব্রু হয়ে যাক তা চান না তিনি। সুন্দরও সম্ভবত তাঁর যন্ত্রণাটা উপলব্ধি করে। তাই আর জোরাজুরি করে না। সহমর্মিতার প্রলেপ দেয়, ‘সেই ভালো। বয়েস হলে কি হবে তুমি এখনো যা মারকাটারি দেখতে আছো,  ছেলেবুড়ো দিনরাত তোমাকে জ্বালিয়ে মারবে। তার চেয়ে একটা ফেক আউডি বানিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে দিই।’

সুন্দরের কথা শুনে এই বয়সেও লজ্জা পান অরুন্ধতী। মুদু ভৎর্সনা করেন, ‘সুন্দর তুই দিনকে দিন খুব ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস। বুড়িয়ে মরতে চললাম আর সবাই নাকি আমার প্রেমে হাবুডুবু। তোর আর কাজকর্ম নেই? যা সেইসব দেখ গিয়ে।’

হাসতে হাসতে চলে যায় সুন্দর। ছেলেটা ওইরকমই। হাসি ঠাট্টায় সবাইকে ভরিয়ে রাখে। অনেকদিন থেকেই সে এই আশ্রমে রয়েছে। তারও মা বাবা কেউ নেই। ছোট থেকেই একটা অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছে। তারপর এই আশ্রমের কর্মকর্তারা তাকে এখানে এনে রেখেছেন। আশ্রমের বৃদ্ধবৃদ্ধার মধ্যেই সে তার বিড়ম্বিত জীবনের কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করে। আবাসিকরাও তার মধ্যেই ফেলে আসা নাতি-নাতনিদের খুঁজে পান। সুন্দরই তাঁদের কেয়ারটেকার কাম  অবিভাবক। জীবনানন্দ বৃদ্ধাশ্রমে তাকে ছাড়া অচল। সবাইকে নিজের দাদু ঠাম্মি বলে আপন করে নিয়েছে সে।

মাস ছয়েক হলো এই আশ্রমে এসেছেন অরুন্ধতী। প্রথম দিকে কিছুতেই মনকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। ঘুরে ফিরে শুধু বাড়ির কথাই মনে পড়ত। বিশেষ করে সুন্দরের মুখে ঠাম্মি ডাকটা শুনে বাড়িতে ফেলে আসা বিচ্ছু দুটোকে মনে পড়িয়ে দিত। আর জলে ভরে উঠতো চোখ। আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। সব মিলিয়ে তিরিশজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন আশ্রমে। অধিকাংশই পেনশনভোগী। ছেলে বউয়ের সংসারে ঠাঁই হয় নি। তাই সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে এসেছেন। পেনশনের একটা অংশ খরচ বাবদ তুলে দেন কর্তৃপক্ষের হাতে। আবার কারও সাত কূলে কেউ নেই। তারা সমস্ত কিছু বিক্রি করে দিয়ে থোক টাকা ব্যাংকে জমা করে দিয়েছেন। সুদের টাকা থেকেই তাদের ব্যয় নির্বাহ হয়। নিছক দুবেলা দুমুঠো খাওয়া আর মাথার উপর একটা ছাদই নয়, ভুলে থাকার নানা আয়োজনও রয়েছে। সুন্দরই ঘটা করে সবার জন্মদিন সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে সবাই নিজেদের মতো করে অংশ নেন। সেইসব অনুষ্ঠানে অরুন্ধতীকেও কতবার নাচ গান করতে হয়েছে।

বিষাদময় জীবনও যে কখনো কখনো মধুময় হয়ে উঠতে পারে, মজে যাওয়া নদীও যে গতিপথ পেলে আবার আপন খেয়ালে বইতে পারে তা জীবনানন্দ আশ্রমে না এলে জানতেই পারতেন না তিনি। এমনিতে তার সংসারে বিষাদময়তা থাকার কথা নয়। ছিলও না চিরদিন। দিব্যি স্বামী সুরঞ্জন আর পিঠোপিঠি দুই ছেলে সুস্নাত আর আর অম্লানকে নিয়ে ছিল সুখের সংসার। স্বামীর নামের আদ্যাক্ষরের সঙ্গে বড়ো ছেলের নাম রেখেছিলেন তিনি। আর তার নামের আদ্যঅক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে ছোটোর নাম রাখেন সুররঞ্জন। শুধু নামেই নয়, সংসারের সবেতেই ভারি মিলজুল ছিল। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে আপ্তবাক্য সত্যি করে তুলেছিলেন অরুন্ধতী।

সুরঞ্জন একটা সরকারি অফিসে কেরাণীগিরি করতেন। আহামরি কিছু বেতন পেতেন না। তাই স্বাচ্ছল্য ছিল না। কিন্তু সংসারে মালিন্যের কোন ছাপ পড়তে দেন নি। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিলেন সংসার। গেটে মাধবীলতা, সামনে একফালি বাগান, প্রাচীরের ধারে ধারে আম, জাম, কাঁঠাল এমন কি আস্ত একটা তালগাছ পর্যন্ত। সেইসব গাছে পাখিদের  কিচিরমিচির লেগেই থাকত। তালগাছে দোল খেত বাবুইয়ের বাসা। সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যে নাচ গানের আসর বসাতেন সুরঞ্জন। বিয়ের আগে নাচগানের চর্চা ছিল তাঁর। সচরাচর বিয়ের পর মেয়েদের ওইসব চর্চার আর কোন কদর থাকে না। সুরঞ্জন কিন্তু দীর্ঘদিন তা বজায় রেখেছিলেন।

ছেলেদেরও মনের মতো মানুষ করেছেন। বড়ো সরকারি চাকুরে। ছোট বেসরকারি সংস্থায় মোটা মাইনের ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি পাওয়ার পর সুরঞ্জন আর তিনি দেখেশুনে ছেলেদের বিয়ে দিয়েছেন। বউমারাও সব রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী। বড়ো অতসী বি এ পাশ, ছোট তনুশ্রীর কলেজে পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়েছে। সুরঞ্জন চেয়েছিলেন বিয়ের পর ছোটোবউমা গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করুক। কিন্তু তনুশ্রীর তেমন একটা গরজ ছিল না। সুরঞ্জনও আর জোর করেন নি। তারপর তো পার্থ আর তীর্থ এলো। ততদিনে সুরঞ্জন অবসর নিয়েছেন। নাতিদের নিয়ে তাদের দু'জনের সুখেই কাটছিল দিন।

কিন্তু সেই সুখ কপালে বেশিদিন সইল না তাঁর। বিনা নোটিশে আচমকা হৃদরোগে চলে গেলেন সুরঞ্জন। শোক সামলে উঠতেই লেগে যায় কয়েক মাস। শোক সামলেও খুব একা হয়ে পড়েন অরুন্ধতী। একাকীত্ব ভুলতে দুই নাতিকে  আঁকড়ে ধরেন। অল্পদিনে সে বাঁধনও আলগা হয়ে পড়ে। এক বাড়িতেই দুই ভাই দুদিকে পৃথকান্ন হয়ে যায়। ছেলেদের অনুনয় করেও সেই ভাঙ্গন ঠেকাতে পারেন নি। তাই তিনি হয়ে পড়েন ভাগের মা। মাস পয়লা পেনশনের টাকাটুকু ভাগ করে নেওয়ার জন্য দুই ভাইয়ের আর তর সয় না। নিজের হাত বলে কিছুই থাকে না। এমন কি ওষুধ কেনার টাকাটুকুও। ছেলেদের বললে আজ কাল করে কাটিয়ে দেয়। বেশি বললে খিটিমিটি লেগেই থাকে। তখন আর নাতিদের কাছে আসতে দেয় না তাদের মায়েরা। বাড়িতে যে তিনি বোঝার সামিল হয়ে উঠেছেন তা টের পেতে অসুবিধা হয় না তাঁর। তাই বাড়িতে আর থাকবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। বাড়িতে থাকা যখন ক্রমেই অসহ্য হয়ে পড়ছিল তখন খবরের কাগজ দেখে বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানাটা ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলেন। একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে কালীঘাটে পুজো দিতে যাচ্ছি বলে সটান হাজির হন জীবনানন্দ আশ্রমে।

সমস্ত ঠিকঠাক করে সন্ধ্যাবেলায় ফিরে ছেলে বৌমাদের নিজের ঘরে ডেকে পাঠান। ব্যাপারটা আন্দাজ করতে না পেরে সব গুজগুজ ফুসফুস করতে থাকে। কোন রকম রাখঢাক না করি তিনি সাফ জানিয়ে দেন, 'আমি ঠিক করেছি আর তোদের সঙ্গে থাকব না।'

বড়োছেলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, 'থাকবে না তো যাবে কোথায়?'

'আমি একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছি।'

তাঁর কথা শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে সবাই। ছোটছেলে বলে, ‘বাড়ি থাকতে পয়সা খরচ করে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার কোন মানে হয়? লোকে শুনলেই বা কী বলবে?’

ছেলের কথা শুনে তাঁর মুখে ফুটে ওঠে ম্লান হাসি। মনে মনে ভাবেন, 'মা চলে যাবে সেটা কোন বিষয় নয়, পেনশনের টাকাটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকাটাই বড়ো হয়ে উঠল ওদের কাছে? নিজের বিবেক নয়, লোক নিন্দাটাই ভাবিয়ে তুলল?'

শান্তভাবেই বলেন, ‘আমি ভেবে দেখলাম বয়স হয়ে গেলে আর বাড়িতে থাকা উচিত নয়। কারণ তার প্রভাবে অন্যরাও বুড়োটে মেরে যায়। সে নিজেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। সেইজন্যই বোধহয় পুরাকালে বানপ্রস্থে যাওয়ার রীতি ছিল। আশ্রমে আমার মতো আরও অনেক বৃদ্ধবৃদ্ধা আছেন। তাঁদের মধ্যে আমি ভালই থাকব। তবে তোদের চিন্তা নেই। পেনশনের সব টাকা তো আর লাগবে না। যেটুকু লাগবে সেটুকু দিয়ে বাকিটা তোদের পাঠিয়ে দেব। কিছুটা কমে যাবে ঠিকই, কিন্তু আমার পিছনে তোদেরও তো আর খরচ করতে হবে না। আর লোকের কথা বলছিস? ওদের যা হোক একটা কিছু বানিয়ে বলে দিস।’

ছেলে বউমাদের আর কিছু বলার সুযোগ দেন নি। সামান্য কয়েকটি পোশাক আর কিছু স্মৃতি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। শেষবারের মতো দেখে নেন নিজের হাতে সাজানো সংসার। নাতিদের মুখের দিকে চেয়ে বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে। অবোধ শিশুদুটির চোখে তখন বর্ষার মেঘ। খুব ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে তাদের বুকে তুলে নিয়ে আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে সংযত করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে আশ্রমে এসে ওঠেন। সেই থেকে আশ্রমের টাকা মিটিয়ে সামান্য কিছু হাত খরচের জন্য রেখে বাকিটা দুই ছেলের নামে মানিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, হাত খরচের টাকা জমিয়ে পুজোয় সবার জন্য জামাকাপড় কেনার টাকাও পাঠান। ছেলেরা অবশ্য কোন খবর নেয় না। প্রথমদিকে আশা করতেন ছেলে বউমারা তার অভিমান ভাঙিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসবে। সেই আশায় দিন গুনতে গুনতে অভিমানবোধটাই হারিয়ে গিয়েছে।

ফোনটাকে আঁকড়েই নিজেকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেন তিনি। ফোনের দৌলতেই নিজেকে ভুয়ো পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে রেখে কত পরিচিতজনের দেখা পান। ছেলে বউমা এমন কি নাতিদেরও দেখা মেলে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছা হয়। পরক্ষণে অভিমানে বুক টন টন করে ওঠে, ‘এতদিন বাড়ি ছেড়ে এসেছি। কই, মা কেমন আছে ওরা তো কেউ একটিবারের জন্যও কই খোঁজ নিতে এলো না! ওরা যদি মাকে পর করে দিয়ে ভুলে থাকতে পারে তাহলে  তিনিই বা কেন ফোন করে ওদের বিরক্ত করবেন? তীব্র অভিমানে নিজেকে সংযত করেন। তাঁর নম্বরেই অন্য আবাসিকদের পরিচিতজনের ফোন আসে।  কেউ কেউ ফোন করেনও। কিন্তু এ যাবৎ তার কোন ফোন আসে নি। তিনিও কাউকে ফোন করেন নি। তাই দেখে একদিন রুমমেট সাগরিকা জিজ্ঞেস করেন, ‘দিদি ফোন কিনে থেকেই দেখি খুটুর খুটুর করেন। কই কাউকে ফোন করা, কারও ফোন আসা তো দেখি না?’

সাগরিকার প্রশ্নে বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে অরুন্ধতীর। কী বলবেন তিনি?  নিজের ছেলে-বউমায়ের সম্পর্কে কিছু বলতে খারাপ লাগে। তাই ম্লান হেসে বলেন, ‘আমার তেমন যে কেউ নেই ভাই!’

হেসে বলেন বটে, কিন্তু দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখতে পারেন না। সাগরিকারও কান এড়ায় না। বুকের ভিতরের অব্যক্ত যন্ত্রণা তারও অজানা নয়। কথাটা বলে খুব আপশোস হয় তাঁর। তাঁকে সান্ত্বনা দেন, ‘কে বললে কেউ নেই দিদি? আমরা তো আছি। যে’কটা দিন আছি দিব্যি হেসেখেলে কাটিয়ে দেব।’

সত্যিই আশ্রমের আবাসিকদের আন্তরিকতা তাঁকে সব ভুলিয়ে দেয়।

তবে ফোনাফুনি না হলেও ম্যাসেজ চালাচালি ভালোই হয়। প্রতিদিনই তাঁর বন্ধু তালিকায় নতুন নতুন নাম সংযোজিত হয়। এতদিন মেয়েদেরই বন্ধু করেছেন। কী যেন একটা অজানা অনীহায় পুরুষবন্ধুদের রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেন নি।  কিন্তু সেদিন দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত নামের এক ভদ্রলোকের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট তাকে ভাবিয়ে তোলে। ভদ্রলোক রিকোয়েস্টে লিখেছেন, ‘আপনার ওয়ালে আমার বেশ কিছু শিল্পীর গান এবং কবিতা রয়েছে। যা আমারও খুব প্রিয়। সেগুলো শেয়ার করার অভিপ্রায়ে আপনার বন্ধুত্ব চাই। আশাকরি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করে বাধিত করবেন। ’ চট করে ভদ্রলোকের প্রোফাইলে চলে যান তিনি। প্রোফাইল ঘেঁটে দেখেন সেখানে তারও প্রিয় হারনো দিনের বেশ কিছু শিল্পীর গান এবং কবিতা রয়েছে। ভদ্রলোকের রুচির সঙ্গে নিজের রুচির একটা সাযুজ্য খুঁজে পান। আর সেই কারণেই দোনামনা করেই তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে ফেলেন।

সেই থেকেই ম্যাসেজ চালাচালি, গান কবিতা’র ভিডিও বিনিময় চলতে থাকে। ক্রমে ম্যাসেজ আদানপ্রদান প্রতিদিন বিকালের বাঁধাধরা রুটিন হয়ে ওঠে। কিসের যেন এক অমোঘ আকর্ষণ পেয়ে বসে তাঁকে। দেবপ্রিয়র সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর অন্য কারও সঙ্গে আর চ্যাট করতে ভালো লাগে না। বিকেল হলেই দেবপ্রিয় যেন  টানতে থাকে। কোনদিন ম্যাসেজ না এলে মনে হয় দিনটাই বৃথা গেল। খুব অভিমান হয়, কিন্তু লজ্জায় প্রকাশ করতে পারেন না। পরদিন যখন দেবপ্রিয় দুঃখ প্রকাশ করে ম্যাসেজ পাঠায় তখন অভিমান গলে জল হয়ে যায়। ম্যাসেজ চালাচালি করতে করতে যখন  সময়টা অতিক্রান্ত হয়ে যায় তখন মনটা খারাপ হয়ে যায় অরুন্ধতীর।

ওইভাবেই ম্যাসেজ চালাচালি করতে করতে ফেসবুক থেকে ম্যাসেঞ্জার হয়ে হোয়াটস অ্যাপে পৌঁছে যান তাঁরা। কিন্তু দেবপ্রিয় কোনদিন সীমা ছাড়ান নি।  ফোন করা দূরের কথা, কোনদিন তার নাম ধাম এমন কি ব্যক্তিগত কোন কথা জানতে চান নি। তিনিও কোনদিন কোন কৌতুহল প্রকাশ করেন নি। তবুও ভদ্রলোক দেখতে কেমন, গলার স্বরই বা কেমন জানতে খুব কৌতুহল হয়। কিন্তু নিজের মনকে শ্বাসন করে, একজন পুরুষমানুষ যদি সংযম দেখাতে পারেন তাহলে তিনিই বা পারবেন না কেন?

অন্যপক্ষেরও যে কৌতুহল ছিল তার প্রমাণ মেলে বছর খানেক পর। একদিন দেবপ্রিয় লিখে পাঠায়, ‘আমাদের বন্ধুত্বের বর্ষপুর্তি হতে চলেছে বাইশে জানুয়ারী। দিনটাকে কি আমরা সেলিব্রেট করতে পারি না? ’

তিনি ম্যাসেজ পাঠান, কীভাবে?’

‘কোথাও মানে এই ধরুন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে দিনটা কাটিয়ে সন্ধ্যেবেলায় যে যার বাড়ি ফিরে গেলাম।’

লোকটির ম্যাসেজে হাসি পায় তাঁর। বাড়িই ফিরে আসাই বটে, তার মানে লোকটির বাড়ি আছে, ঘরসংসার আছে। কথাটা ভেবে খুব একটা ভালো লাগে না তার। পরক্ষণেই মনকে শাসন করেন, দেবপ্রিয় তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলান নি। তাকেও ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলেন নি। তাঁর মতো কপালপোড়া সবাইকে হতে হবে তার কি মানে আছে? তাঁর দেরি দেখে দেবপ্রিয় ফের তাগাদা দিয়ে ম্যাসেজ পাঠান, ‘আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি বাঘ ভাল্লুক নই। তবে আপনার যদি মন না থাকে তাহলে অন্যকথা। তবে বন্ধুত্বটা যেন হারাতে না হয়।’

ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করার মতোই দোটানায় পড়েন অরুন্ধতী। তবে দেবপ্রিয় যে নিপাট ভদ্রলোক তা নিয়ে তার আর সংশয় নেই। কিন্তু কেমন একটা লজ্জাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কিশোরীবেলার অভিসারের আহ্বানের মতো মনে হয় দেবপ্রিয়র প্রস্তাব। তার দেরি দেখে দেবপ্রিয় ফের ম্যাসেজ পাঠায়, ‘ব্যাপারটা মন থেকে মুছে ফেলুন। আসতে হবে না। সেদিন ফোনেই আমরা সেলিব্রেট করব। ’

দেবপ্রিয়র ম্যাসেজে অভিমানের আঁচ পান অরুন্ধতী। আর চুপ করে থাকতে পারেন না। ম্যাসেজ পাঠান, ‘ঠিক আছে আসব। কোথায় আসতে হবে বলুন? আর আপনাকে চিনবই বা কী করে?’

‘দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পিছনের দিকে বাঁধানো বটতলা আছে, ওখানেই আমি  আপনার জন্য অপেক্ষা করব। দু’জনের হাতে মোবাইল ফোন থাকলে চিনতে কোন অসুবিধা হবে না। তবুও আপনার চেনার সুবিধার জন্য সেদিন আমি নীল রঙের জামা পড়ে যাবো। তারপরেও যদি আমাকে চিনতে না পারেন তাহলে আমিই আপনাকে চিনে নেব।’

সেদিন রাতে উত্তেজনায় দীর্ঘক্ষণ ঘুমোতে পারেন না তিনি। মনে হয় সত্যিই যেন অভিসারে যাচ্ছেন। সুরঞ্জনের কথা মনে পড়ে যায়। কেমন যেন ইতস্তত লাগে। পরক্ষণেই মনকে বোঝান, কোন অন্যায় তো করছেন না! মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব  তো হতেই পারে। সেটা দোষনীয় নয়। যুক্তি সাজাতে পেরে শান্ত হয় মন। তারপর থেকে দিন গুনতে থাকেন।

নির্ধারিত দিনে হালকা প্রসাধন আর চওড়া পাড় একটা হালকা হলুদ শাড়ি পরে বেরোতে যাবেন, এমন সময় বিপত্তি। সুন্দর পথ আগলে দাঁড়ায়, 'তুমি কোথায় যাবে ঠাম্মি? এখানে একা যাওয়ার নিয়ম নেই। কাল বরং আমি সঙ্গে নিয়ে যাবো’।

'নিয়ম নেই তা জানি রে। কিন্তু আমাকে যে আজই যেতে হবে। ফেসবুকে একজন বাল্যবন্ধুর সন্ধান পেয়েছি। যাবো বলে তাকে কথা দিয়ে ফেলেছি। আর সেখানে একাই যেতে চাই। নিজের দুরবস্থার কথা তো আর বলতে পারি নি। বাড়িতেই আছি বলেছি।  বুঝিস তো তোরা কেউ গেলে সন্দেহ করবে। কোন চিন্তা করিস না। আমি ঠিক সময় মতো ফিরে আসবো’।

ব্যাপারটা বোঝে সুন্দর। তাই তাকে আর আকানোর চেষ্টা করে না। একটা ট্যাক্সি ডেকে চাপিয়ে দেয় তাকে। মাঝপথে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে একটা ফুলের তোড়া কিনে নেন তিনি। যেতে যেতে মনের মধ্যে একটা অন্যরকম রোমাঞ্চ অনুভব করেন। ট্যাক্সি থেকে নেমে যত নির্ধারিত জায়গার কাছাকাছি হতে থাকেন ততই তাঁর হৃদস্পন্দন দ্রুততর হতে থাকে। নীল জামার মুখোমুখি হতেই তার হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়। নির্ধারিত জায়গায় ফুলের তোড়া হাতে এ কাকে দেখছেন? মুহূর্তের মধ্যে এলোমেলো ঝড়ে স্মৃতির পাতার ধুলো উড়ে যায়।  প্রতীয়মান হয় শৈশব। এক গ্রামেই বাড়ি ছিল উদ্ভাসদাদের। তার চেয়ে তিন ক্লাস উঁচুতে পড়ত উদ্ভাসদা। তার তখন নবম শ্রেণী। উদ্ভাসদা পড়ত দ্বাদশ শ্রেণীতে। লেখাপড়াতে তুখোড়, কবিতা গল্প লিখত। তাদের দুই ভাইবোনকে পড়াতে আসত। তখন চোখে চোখ পড়লেই বুক ঢিপঢিপ করত। পড়তে পড়তে একদিন প্রেম হয়ে যায়। চিঠি চালাচালি, হাত ছোওয়াছুঁয়ি থেকে ঠোঁটে ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছে যায় তারা। তাদের সম্পর্কের কথা কানাঘুষোয় বাড়ির লোকেদের কানেও পৌঁছে যায়। কিন্তু তেমন একটা আপত্তি ওঠে নি। কারণ উদ্ভাসদা ছিল তখন আদর্শ ছেলে। অনেক মা-বাবাই তার হাতে মেয়ে দেওয়া সৌভাগ্যের মনে করতেন। তিনিও উদ্ভাসদাকে ঘিরে রঙীন স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেছেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয় না। কলেজে পড়তে গিয়ে নকশাল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে উদ্ভাসদা। বাড়ির সঙ্গে যোগসূত্র ক্ষীণ হয়ে আসে। খুব উদ্বেগে দিন কাটে অরুন্ধতীর। ভগবানের কাছে তার মঙ্গল কামনা করেন। কিন্তু কোন লাভ হয় না। বাড়ির সঙ্গে উদ্ভাসদার যোগসূত্র পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে হয়ে যায়। তার ফেরার প্রতীক্ষায় দিন গোনেন তিনি। কিন্তু উদ্ভাসদা ফেরে না। কেউ বলে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে তার। কেউ বা বলে পুলিশ লকআপে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। তিনি শোনেন আর গোপনে চোখের জল ফেলেন। মনে মনে প্রার্থনা করেন, 'ঠাকুর তুমি আমার উদ্ভাসদাকে ফিরিয়ে দাও’।

প্রার্থনা বৃথা যায়। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পরই সুরঞ্জনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে যায় তাঁর। বিয়ের পিঁড়িতে বসেও উদ্ভাসদার মুখ বার বার ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে স্বামীর ঘর করতে আসতে হয়। সেদিন তার চোখের জল দেখে সবাই ভেবেছিলেন বাবার বাড়ি ছেড়ে আসার চিরন্তনী কান্না। কিন্তু উদ্ভাসদার কথা ভেবেই সেদিন তার চোখের জল বাধ মানে নি। তারপরেও কতবার মনের পর্দায় উঁকি দিয়েছে উদ্ভাসদার স্মৃতি। ফেসবুক ফেন্ড দেবপ্রিয়র বদলে সেই উদ্ভাসদাকে দেখবেন ভাবতেই পারেন নি।

কম্পিত পায়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে ফুলের তোড়াটা এগিয়ে ধরে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর মুখের দিকে চেয়ে উদ্ভাসেরও কথা হারিয়ে যায়। নির্বাক বিস্ময়ে সময় অতিবাহিত হতে থাকে। একসময় অরুন্ধতীই প্রথম মুখ খোলেন, 'উদ্ভাসদা তুমি? তোমাকে এভাবে দেখবো ভাবতেও পারি নি। '

'কি ভেবছিলি মরে গেছি?’

'বালাই ষাট! মরবে কেন? কতদিন ঠাকুরের কাছে তোমার মঙ্গল প্রার্থনা করেছি জানো? কেমন আছো তুমি?' স্থান কাল পাত্র ভুলে সেই কিশোরীবেলার মতো  উদ্ভাসের মুখে হাত চাপা দেন অরুন্ধতী।

'কেমন আছি দেখতেই পাচ্ছিস। ফার্স্ট ক্লাস’।

স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলেন উদ্ভাস। অরুন্ধতী অনুযোগ করেন, 'তোমার শরীর কিন্তু অনেক ভেঙে গিয়েছে। নিশ্চয় আগের মতোই শরীরের কোন যত্ন নাও না? '

'শরীরের আর দোষ কি বল অরু? বয়স তো কম হলো না। আমার কথা বাদ দে। তোর এই দশা কেন? '

'কপাল পুড়িয়ে ছেলেদের কাছে বেশিদিন ঠাঁই হয় নি গো। বৃদ্ধাশ্রমে আছি। '

বলব না বলব না করেও কথাটা বলে ফেলেন অরুন্ধতী। উদ্ভাসদাকে পেয়ে যেন একাত্মতা অনুভব করেন। মনে হয় সব বলা যায় তাঁকে। উদ্ভাসের মনে হয় কথাটা জিজ্ঞেস করে অজান্তে অরুন্ধতীর ব্যথার জায়গাটাতে ঘা দিয়ে ফেলেছেন। খুব মর্মাহত হয়ে পড়েন। প্রসঙ্গান্তরে যেতে চান, 'কতদিন পরে দেখা হলো বলতো? '

'কতদিন কি বলছো উদ্ভাসদা? কত যুগ বলো! আমি কিন্তু দেবদপ্রিয়র প্রোফাইলে তোমার ছায়াই দেখেছিলাম। তাই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করি।'

'সে তো সুপ্রিয়া নামের প্রোফাইলে আমিও তোকে খুঁজে পাই।'

'তুমি বিয়ে করেছো?'

'তেমন মেয়ে পেলাম কই রে। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বাইরে আসতেই পুলিশ নিয়ে গিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিল। জেল থেকে গ্রামে ফিরে শুনি তোর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমার বিড়ম্বিত ছায়া যাতে তোর জীবনে না পড়ে সেই জন্য আর খোঁজ করি নি। দাদা ভাইদের কাছেও অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ি। তাই গ্রাম ছেড়ে চলে আসি। '

'তাহলে তুমি আছো কোথায়?'

'আছি?’ বলেই থেমে যান উদ্ভাস। সামনে বয়ে যাওয়া গঙ্গার দিকে চেয়ে গেয়ে ওঠেন,  "এই কুলে আমি আর ওই কুলে তুমি / মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়।"

'মানে?’

'তোর মতোই আমিও নদীর ওপারে একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। আমার অংশের পৈত্রিক জমিজমা দাদা ভাইদের নামে লিখে দিয়ে কিছু টাকা পেয়েছিলাম। তার সুদেই কোন রকমে চলে যায়।'

'আগের মতো আর কবিতা লেখো না?'

'লিখি তো!'

'একটা শোনাও না গো!'

অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেন না উদ্ভাস। শোনান তাঁর প্রিয় কবিতা --

বুকের ভিতর স্রোতহারা নদীর মতো ঘুমিয়ে আছে প্রিয় নারী।

পথ ভুলে কোনদিকে যাবো, সবখানে চরণচিহ্ন তারই।

কোনদিকে ফেরাবো মুখ, কোনদিকে চাবো?

সবখানে সেই প্রিয় মুখ, খেতে হলে সেই মুখে চুমু খাবো।

বুকের ভিতর সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে ঘুমিয়ে আছে প্রিয় নারী।

বুকের ভিতরেই তার ঘরবসত, আমি কি আনবাড়ি যেতে পারি?

যেতে হলে পড়ন্তবেলায় সেই নারীর কাছেই যাবো।

এক জনমে না হলে জন্ম জন্মান্তর প্রতীক্ষায় রবো।

অরুন্ধতী অভিভূত হয়ে যান। চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে তাঁর। উদ্ভাসের হাতটা নিজের হাতে তুলে নেন। গঙ্গার দিকে চেয়ে থাকেন। নৌকায় নদী পারপার করছে মানুষজন। ওপারের নদীর তীর লাগোয়া ছোট ছোট ঘরবাড়ি। মনটা উদাস হয়ে যায় তাঁর। উদ্ভাস আবেগ মিশ্রিত গলায় বলেন, 'হ্যাঁ রে, আমরা আবার নতুন করে সব শুরু করতে পারি না?'

কথাটা শুনেই বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে অরুন্ধতীর। খুব লোভ হয় তাঁর। আবার মনের মধ্যে পাপবোধ জেগে ওঠে। সামনে এসে দাঁড়ান সুরঞ্জন। তাকে অতিক্রম করে যেতে পারেন না। শংকিত গলায় বলেন, 'কী বলছো তুমি উদ্ভাসদা? আমি বিধবা মানুষ, পাপ হবে না?'

'পাপ কেন হবে অরু? তোর - আমার আর তো কারও কাছে বাধাবন্ধন নেই। আমরা কাউকে ঠকাচ্ছিও না। তাছাড়া গড়পড়তা মানুষ যে কারণে বিয়ে করে সেটা তুই আমি দু'জনেই পেরিয়ে এসেছি। জীবনের বাকি দিনগুলো একসঙ্গে কাটিয়ে দিতে চাই। তোর ভগবানেরও বোধহয় সেইরকম ইচ্ছা। নাহলে আমাদের দেখাই বা হবে কেন?'

‘তোর ভগবান’ কথাটা ফের ফিরে আসা দিনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়  অরুন্ধতীকে। দেবদ্বিজে বিশ্বাস ছিল না উদ্ভাসদার। ঠাকুর দেবতার প্রসঙ্গ উঠলেই ওইভাবে কথা বলত। তাঁর কথা শুনে খুব দোটানায় পড়ে যান। কী বলবেন ভেবে পান না। দোনামনা করেন, 'উদ্ভাসদা আমাকে কিছুদিন ভাবতে সময় দাও।'

'বেশ তো ভাব না। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। '

ফেরার সময় হয়ে আসে। কিন্তু কারো যেন ফিরে যেতে ইচ্ছা করে না। তবুও যেতে হয়। উদ্ভাস ট্যাক্সি ডেকে অরুন্ধতী চাপিয়ে দেন। হাত নাড়তে নাড়তে  মিলিয়ে যান অরুন্ধতী। মনের আনন্দে গুনগুন করতে করতে নিজের আশ্রম অভিমুখে রওনা দেন উদ্ভাস।

তারপর থেকেই ফোনালাপ চলতে থাকে। চলতে থাকে সেদিনের মতো দেখা সাক্ষাৎও। সুন্দর পিছনে লাগে, 'কি গো ঠাম্মি, ব্যাপার কী? আগে তো কাউকে ফোন করা, কারো বাড়ি যাওয়ার নাম করতে না। এখন তো দেখি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।'

রুমমেটরাও একই কথা বলেন। অরুন্ধতী হেসে বলেন, 'কী করি বল। বাল্যবন্ধু বলে কথা। তার টান যে উপেক্ষা করতে পারি না।'

মনঃস্থির করতে মাস খানেক সময় লাগে তাঁর। স্বামীর কথা, ছেলেদের কথা ভেবেই দোটানায় ছিলেন। মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ হয়। শেষে মনকে বোঝান, তিনি তো কারো প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করেন নি। কাউকে প্রতারণাও করছেন না।

ওই কথা ভাবতে পারার পর মন থেকে সায় মেলে। মনের কথা জানিয়ে দেন মনের মানুষকে। তাঁর মত জানার পর আশ্রমে এসে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিয়ের কথা বলেন উদ্ভাস। কর্তৃপক্ষ তো মহাখুশী। কোন বৃদ্ধাশ্রমের ইতিহাসে এমন যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে নি। তাই সেই ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে থাকতে মেয়েপক্ষ হিসাবে আশ্রমেই বিয়ের আয়োজনের দায়িত্ব নেন সভাপতি সুপ্রকাশ জানা।

মুখে মুখে সেই খবর ছড়িয়ে পড়তে সুন্দর অরুন্ধতীর পিছনে লাগে, 'ঠাম্মি তুমি দেখালে বটে। এ তো রীতিমতো কলেজ স্টুডেন্টদের মতো ব্যাপার গো। ভাগ্যিস ফোনটা কেনা হয়েছিল তাই। নাহলে তোমার হারানিধিকে কি করে খুঁজে পেতে বলো?'

আবাসিকরাও মহাখুশী, 'সত্যি দিদি খুব ভালো লাগছে। এবার আমাদের বেড়াতে যাওয়ার একটা জায়গা হলো। দল বেঁধে তোমাদের বাড়ি যাবো।'

অরুন্ধতী কোন প্রত্যুত্তর করতে পারেন না। কিশোরীর মতো লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে তার মুখ। খুশীর হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে উদ্ভাসের আশ্রমেও। তাঁরাও পাত্রপক্ষ হিসাবে বিয়ের আয়োজনের সুযোগ হারাতে চান না। বেছে বেছে দোল পূর্ণিমাতে বিয়ের ঠিক হয়। তিথি নক্ষত্রের বাছবিচার না করে মিলনের দিন হিসাবে বেছে  নেওয়া হয়। তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় দুই আশ্রমে। কথা চালাচালি, প্ল্যান প্রোগাম নিয়ে মেতে ওঠেন সবাই। নির্ধারিত দিনে কনের সাজে অরুন্ধতীকে সাজিয়ে দেন আশ্রমের মহিলারা। ঝোলানো হয় দোলনাও।

যথাসময়ে উদ্ভাসকে বর বেশে সাজিয়ে নিয়ে আশ্রম থেকে এসে পৌঁছোন বরযাত্রীর দল। পিঁড়িতে চাপিয়ে পাত্রী এনে বসিয়ে দেওয়া হয় মিলনদোলায়। পানপাতা দিয়ে মুখ ঢেকে বসে থাকেন অরুন্ধতী। ওই আশ্রমের কর্তৃপক্ষ উদ্ভাসের হাত ধরে এনে বসিয়ে দেন তাঁর পাশে। মহিলারা শুভদৃষ্টির জন্য কাপড়ে ঢেকে দেন তাঁদের মুখ। তাঁদের উলু আর শঙ্খধ্বনিতে আশ্রমের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।  শুভদৃষ্টির পর অরুন্ধতীর সিঁথি সিদুরে রাঙিয়ে দেন উদ্ভাস। আশ্রমিকরা আবীর ছড়াতে ছড়াতে তাদের ঘিরে গাইতে থাকেন ---

"আহা আজ কী আনন্দ... ঝুলত ঝুলনে শ্যামর চন্দ। "

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন