কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

সুকান্ত দেবনাথ

 


ধারাবাহিক উপন্যাস



           

দূরত্ব

 

(এক)

মাঝে মাঝে কিছু অপ্রত্যাশিত কথা মাথার মধ্যে এক যুগের ভার নিয়ে উপস্থিত হয়। না তাকে পারা যায় নামাতে। না তাকে মাথায় করে, পেরনো যায় এই প্লাবন ডাকা নদী। তখন কি দিন কি রাত, সমস্ত ক্ষণ শুধু এই কথার মাঝে গলা পর্যন্ত ডুবে অপেক্ষা, কখন সে উঠে আসবে নিজের বোঝা পড়া নিয়ে। আমি নিজের পক্ষ সমর্থন করার মতো কিছু অন্তত জোগাড় করতে পারবো। এই যেমন সেদিনই এক কথা উঠে এল মাথায়। যদিও আগে থেকে কেউ আমাকে বলেনি। দেখলাম শীর্ণকায় এক মেয়ের হাতে প্লাস্টিকের শাঁখা পলা। মাথায় সিঁদুর যতটা মৃয়মান, ততটাই হয়তো তার এই উচ্ছ্বাসহীন জীবন। মাতৃত্ব এই সামান্য বয়সেই তাকে দিয়েছে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। যা তার চোখের দিকে তাকালেই অনায়াসে বোঝা যায়। সে তার ঘরকন্নার মাঝে শলার ঝাঁটায় ঝাড়ু দিতে দিতে দেখতে পেয়েছে নিঃসঙ্গ এক ভবিষ্যৎ। যা বাস্তবে কোনো ভবিষ্যতই নয়। একটু একটু শুধু দিন যাপন। তাহলে রাত্রি যাপন কি হতে পারে? এই ছিল প্রশ্ন।  

না আমি কোনো উত্তর পাইনি। কারণ উত্তর পেতে গেলে আমাকে তার রাতের ভিতরে যেতে হবে। তার ঘুমের মধ্যে পেরোতে হবে এই অলঙ্ঘনীয় সাঁকো। দৃষ্টিকটু, তবু না গেলে জানার আর কোনো উপায় দেখিনা। আমি ঘরে ফিরে আসি, আমার দেয়ালের সামনে কাগজের টুকরো ছড়িয়ে দেখতে থাকি কোনো আকৃতি নেয় কিনা। কোনো পরিবর্তন হয় কি না। না তাদের কোনো পরিবর্তন নেই তারা যেমন ছিল  তেমনই পড়ে আছে নিজেদের ভিতরে সামান্যতম কথা না বলে। বিরক্ত লাগে উঠে আসতে বাধ্য, কি করি আমি। আমি কি তার স্বামীটিকে খুঁজতে বেরবো। কারণ সেই একমাত্র সূত্র হতে পারে মেয়েটির রাতের সঞ্চরণের।

কিন্তু কে তার স্বামী? আমি আর কাউকে না পেয়ে দেয়ালকেই প্রশ্ন করে বসি। কে সে?

সাধারণত এও এক পাগলামো লাগতে পারে, কেউ কি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে। কেননা দেয়াল সে তো সীমাবদ্ধের প্রতীক। কিন্তু দেখো তার ভিতর থেকেও মুখ বেরিয়ে আসে মাঝে মাঝে। আমার কথার উত্তর দেয়, বলে -- 

এই সত্ত্বার মাঝেই হাজার প্রাণ দিনে দিনে ক্ষয় হয়ে যায়। বড় রাস্তা থেকে গলি, গলি থেকে তস্য গলি হয়ে, হারিয়ে যায় আমাদের এই সব কান্নাগুলি আঁচলে জড়িয়ে। চোখ মোছে তারপর আবার সেই হাঁড়ি, আবার সেই কালো কড়াইয়ের মাঝে সামান্য শাঁখা পলা। জন্মাবধি সাধ ছিল তার এক জোড়া শাঁখা বাঁধানো। অথচ মনে মনে বলে-

-ধুর তা আবার হয় নাকি?  

উঠে আসে সে, উঠে আসা তার নিয়তি লিখিত। 

-যা কিছু হওয়ার নয় তার দিকে কেন ফের? আমি তো জেনেছি সেই কবে?

আমি বলি 

-কবে জেনেছিলে?

-জানি না? হয়তো মায়ের পেটে, আমাকে বাবা বলেছিল। তারপর ঠাকুরের আসনে দেখেছি বিবর্ণ পর্দার পিছনে ঢেকে রাখা অদ্ভুত খেলনা বাটি। কেউকি আসবে কোনোদিন, কেউ কি নিজেকে বিলিয়ে দিতে এই টিমটিমে ঘরে? - কেউ আসার নেই, তা বলে কি সন্ধ্যে দেবো না। গলায় আঁচল জড়িয়ে প্রতি বিকেলের শেষে মা উঠে যেত মাটি ছেড়ে।   

এই ছিল সেই দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসা সেই মুখের বয়ান। কিন্তু এতটাও কি আমি জানতে চেয়েছিলাম? আমি তো তাকে সেই মেয়ের রাতের প্রশ্ন করবো ভেবেছিলাম, করিনি। সে কেন আমাকে তার মায়ের গর্ভের খবর দেবে? জানি না, না জানা কোনো অপরাধ নয়। জানতে চাওয়াও কোনো ভুল কাজ নয়। আমি সেই দেয়ালের দিকেই তাকিয়ে থাকি একদৃষ্টে। দেয়ালের আকৃতি রূপ নেয়, বেরিয়ে আসে দেয়াল থেকে। ঠিক যেন একতাল মাটির মানুষ অস্তিত্ব আছে কিন্তু আকার নেই। আমি তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি, সেই আকৃতি আমাকে বলে, যে আমাকে প্রশ্ন করে আমি তার রূপ ধারণ করি। আমি বলি কিন্তু আমি  তো প্রশ্ন করিনি? সে বলে, মেয়েটিকে দেখেছিলে কোন অশুভ ক্ষণে? জানো না সে পরস্ত্রী? 

জানি, কিন্তু তাকে দেখাও যে আমার নিয়তি লিখিত ছিল, সে মেয়ে যেমন বলেছিল। বলেছিল দেখো যার কাছে আমার ঠিকানা জানতে চাইবে সে তোমারই রূপ ধারণ করবে। চোখ মুখ তোমারই মতো কিন্তু ভিতরের মানুষ আলাদা।  বাস্তবে আমার চোখে এক ভ্রম তৈরি করার জন্য। আমি যেন দেখে বুঝতে না পারি কে এসেছে আমাকে নিতে। সত্যি হল তাই দেখতে দেখতে সেই দেয়াল থেকে বেরিয়া আসা আকৃতি আমার রূপ নিলো। অবিকল আমি যেন বসে আছি আমার সামনে। 

তবে সে কি অনেকগুলি উনিভার্সের থিয়োরি। আমারই মতো আরও কোনো মানুষ রয়েছে অন্য কোনো উনিভার্সে। আমি যদি টাইম ট্রাভেল করি তবে সেই আমার অবিকল মানুষটির অতীতে পৌঁছাব। কিন্তু না এখানে তেমন তো কিছু মনে হচ্ছে না। বরং আমার সেই নকল মানুষ আমাকে সে মেয়ের লিগ্যাল সঙ্গী বানাচ্ছে। বলছে দেখো সেই কিশোরী মেয়ে তখন তার লাল ফ্রক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটি গোল তৈরি করছে নিজের চারিদিকে।  

একটি গোল ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, ছড়াচ্ছে নিজেকে, পরিধি বেড়ে যাচ্ছে। আরও মানুষ এক পা দু’পা করে ঢুকে যাচ্ছে তার এই নিজস্ব গোলের মাঝে। খুশি সে খুশি। এত লোক এত মানুষ আমাকে ভালোবাসে!    

 

(দুই)

 

এখন আমি এক ভ্রান্তির পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে সেই মেয়ে, তার স্বামী আমার রূপ নিয়েছে। তার চোখে কিছুটা প্রেম কিছুটা ছলনা আবার কিছুটা অবিশ্বাসও রয়েছে। অবিশ্বাসের কারণ তার স্মৃতি প্রখরতা, তার ষষ্ট অনুভূতি। সে বুঝতে পারছে আমি আসলে আমি নই। আমি অন্য কেউ কিন্তু চোখ, সে যে প্রেমময়, কাছে এগিয়ে গেলাম দেখলাম তার চোখের দিকে তাকিয়ে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে সে আমাকে কিভাবে তার স্বামীর সাথে গুলিয়ে ফেলছে? তার স্বামী আমার আগে কি রুপে তার কাছে ছিল? বা স্বামীর রূপ কি পরিবর্তনশীল হতে পারে?

মেয়েটি আমার প্রশ্নের উত্তর জানে কিন্তু দিতে চায় না। ও প্রান্তে তার বাচ্চা কাঁদছে, শুয়ে আছে বিছানার উপর। হয়তো ঘুমাচ্ছিল, হয়তো খিদে পেয়েছে  তার। ঘুমের মধ্যে দুধ খাওয়া তার অভ্যাস। তাই সে চেঁচিয়ে উঠেছে। তার গলার স্বর শুনেই মায়ের বুকে উথলে এসেছে দুধ। সে আমাকে বসার জায়গা দেখায়।

শুনেছি শঙ্কারাচার্য কোনো এক তর্কমহাসভায় হেরে যাচ্ছিলেন কারণ সংসারধর্ম সম্বন্ধে তার জ্ঞান ছিল না, ব্রক্ষ্মচর্যের কারণে। তখন সংসার সম্বন্ধে জানতে এক  পাহাড়ের কোলে নিজের দেহ অনুগামীদের হাতে রেখে এক মৃত রাজার দেহে প্রবেশ করেন। কিন্তু সেই রাজার স্ত্রী বুঝতে পেরে যান তার স্বামী সে নয়। খোঁজ শুরু করেন তিনি, আসলে কে এই মহাপুরুষ, যে তার স্বামীর দেহে প্রবেশ করেছেন। এমনকি তিনি সেই গুহার খবরও পেয়ে যান যেখানে শঙ্কারাচার্যের শুষ্ক শরীর রাখা আছে। তারপর--

সে মেয়ে আমাকে ডাকল, ওখানে কেন উঠে এসো। আমি তার বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালাম। অগোছালো চাদরের উপরে একটি বছরখানেকের বাচ্চা শুয়ে  আছে। গায়ের রং টুকটুকে ফর্সা, নাদুস নুদুস যেন দেখলেই কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে করে। কত নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সে, পৃথিবীর সমস্ত চিন্তা ভাবনা থেকে দূরে। আমার দিকে তার ডান হাতটি পড়ে আছে আলগোছে। যেন সে বাড়িয়ে রেখেছে হাত। আমি খুব অদ্ভুত ভাবে তার পাশে উঠে বসলাম। তার মা এগিয়ে এলো আমার সামনে। আর এটাই সে মুহূর্ত যে আমার মাথার ভিতরে উৎপন্ন হয়েছিল। আমি দেখছি তার হাতের চুড়ি, মাথার সিঁদুর। মেয়েটি হাতে করে আমার জন্য কিছু একটা নিয়ে এসেছে। হাতের আড়ালে লুকাচ্ছে পিছনে। বললাম কী এনেছো?

সে পিছন থেকে তাদের বিয়ের ছবি বার করে, অনেকটা আমার প্রতিরূপ,  দেখতে আমারই মতো এক ছেলে। যদিও গায়ের রং সামান্য চাপা। স্বাস্থ্য আমার থেকে প্রায় দ্বিগুণ। মেয়েটিকে এভাবে এক হাতে ধরে আছে যেন সে কোথাও থেকে তাকে জয় করে এনেছে। পাশে মেয়েটির তেমনই ভাবলেশহীন মুখ। যেন জন্ম মুহূর্ত থেকে সে সব কিছুই জেনে এসেছে। আমি প্রশ্ন করলাম আমাকে কী  দেখাতে চাইছো?সে বলল - গ্রামটা ঘুরে দেখুন।

কিন্তু গ্রামটা ঘুরে দেখতে গেলে তো আমাকে তার সামনে থেকে সরে আসতে হবে। ফিরে যদি না পাই তাকে আবার! আমার বুকে এক অজানা কষ্ট জন্ম  নিলো। ছবিটার দিকে ফিরে তাকালাম। কী আছে ছবিতে? কিছু কি আছে বাস্তবিক? যে সকল মেয়েদের বিয়ের সময় এমন বিবর্ণ দেখায় তাদের জীবনে কোনো ফ্যান্টাসি থাকে না। বা বলা যায় কল্পনা করতে তারা কিছুটা সঙ্কোচ করে মনে মনে। নিজের মানুষটির সম্বন্ধে যেটুকু জানতে সে চায়। তার বেশি সবকিছুই অনধিকার চর্চা। হয়তো বা ভাবে যাকিছু পেয়েছি তার বেশি পাওয়া হয়তো অপরাধ হতে পারে। তাই কল্পনা থেকে শত ক্রোশ দূরে, নিজের জন্য এক এমন বাস্তব রাখে যার কোনো রস কষ নেই।

যাইহোক গ্রাম দেখার আমন্ত্রণও বা কি কম, আমি গ্রাম দেখতে বেরিয়ে গেলাম। সবুজের গ্রাম, যেদিকে তাকাই দেখি গাছের সজীবতা। এখানের গ্রামগুলি কি একটু বেশি সবুজ! কেননা আমাদের শহরের গাছের পাতার উপরে এক কালো আস্তরণ সব সময় দেখা যায়। ছিলাম সে গ্রামে, সেখানেই আমি আমার জন্য কিছুটা সবুজ রেখেছিলাম গায়ে মাখবো করে। কিন্তু ফিরে আসতে বাধ্য হলাম সেই দেয়ালের সামনে। যেখানে অনেকগুলি কাগজের টুকরো ছড়িয়ে এক অপেক্ষা ছিল, তাদের ভিতরে কোনো কথা হয় কিনা দেখার। সত্যি হল তাই যা ভেবেছিলাম আমি, তাদের ভিতরে অনেক কথা হয়েছে। ফিরে এসে দেখছি ছড়ানো কাগজের টুকরোর গায়ে অনেক পেনের কালির আঁচড় পড়েছে। এবং হ্যাঁ, এবং কস্তূরী দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। হয়তো গুছিয়ে রাখতে চাইছে এই টুকরো কাগজগুলিকে। ওকে কি বলবো কস্তূরী আমি এক নতুন গ্রামের খোঁজ পেয়েছি? না, বলা যাবে না এখন অন্তত, কেননা দেখতে গেলে তার হাজার খানেক প্রশ্নের উত্তর দিতে এখন আর ইচ্ছে করছে না। সে যেমন গুছিয়ে রাখতে চাইছে সব কিছু তাকে না হয় করতে দি। গোছানো তার স্বভাব, না গোছালে ভাত হজম হয় না। গোছাতে গোছাতে সব কিছু কোথায় যে রেখে দেয়, প্রয়োজনের সময় আর মেলে না। এভাবে সে আমার অনেক কাগজ হারিয়েছে। তবু এটাই মানসিক শান্তির কারণ। সে গুছিয়ে রাখছে নিজে হাতে।  

হাত। আমার চোখ তার হাতের দিকে গেল। খালি একেবারে খালি। কোনো চুড়ি বালা রিং কিছু নেই। মেয়েরা কি হাত এত খালি রাখতে পারে? কস্তূরীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, না তার কপালেও কোনো টিপ নেই। তবে কি তার জীবনেও ফ্যান্টাসির কোনো জায়গা নেই? যে সব মেয়েরা শাঁখা পলা পরে আর যারা পরে  না তাদের মধ্যে আমি বিস্তর ফারাক দেখতে চেয়েছি। পেয়েছিও অনেক। বাস্তবে আমার মনে হয়েছে ফ্যান্টাসি থেকে সরে এসে এই দু’ধারার মেয়েরা নিজেদের জন্য দু’রকম রাস্তা তৈরি করে জীবনের। যার গন্তব্য হয়তো এক হতে পারে কিন্তু চলার পথ একেবারে আলাদা। একটা যদি বাসরুট হয় অন্যটি ট্রেনের ট্র্যাক। আর গতি যেভাবে তারা আমাদের মাঝে নিজেকে বৈশিষ্ট্যহীন রেখেও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। কস্তূরী চলে গেছে অনেকক্ষণ কিন্তু সে ছিল এবং আমাকে তার হাতের কথা বলে গেছে। 

(ক্রমশ)

 


3 কমেন্টস্:

  1. দৈনিক ভাত রুটি আর যৌনতার গল্প থেকে দূরে এক সাবলীল গদ্যশৈলী এবং গল্পের বিন্যাস। ভালো শুরু হয়েছে। আশা করি আগামী দিনে এই একই ধারা বিবরণ লেখক টেনে নিয়ে যাবেন নিজস্ব কলমের মুন্সিয়ানা।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ কতটা কি পেরেছি জানি না তবে একটা প্রয়াস তো ছিলই।

      মুছুন
  2. চলুক স্যার।পড়ব যদি বেঁচে থাকি।যা শুরু হয়েছে চতুর্দিকে, মনোনিবেশ করতে পারছি না কিছুতে ।

    উত্তরমুছুন