কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

         


একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

(৭)

হৃদয় কোনও উত্তর দিতে পারে নি। কিন্তু সাঁঝের কথায় সমর্থন পেয়েছিল পরবর্তী ঘটনার। বাগানের প্রত্যেকটি ফুল নিয়ে আগ্নেয় একএকটি কার্টুন আঁকতে শুরু করেছিল। কার্টুন, কিন্তু খুব রহস্যময়। রবিবার বিকেলে সবাইকে সে এই কার্টুনগুলি দেখাত। তার এই ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে সবাই একেবারে চমৎকৃত হয়ে যেত। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হত হৃদয়। আগ্নেয়কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভরিয়ে দিত। আগ্নেয় হৃদয়ের এই উচ্ছ্বাস লক্ষ করেছিল। হৃদয় একাই এত বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করত যে অন্যদের আর মনের ভাব সেভাবে প্রকাশ করার সুযোগ থাকত না। ফলে কারও যদি ততোটা ভালোও না লাগে, সেটাও জানা যেত না। হৃদয়ের উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়েই বাকিদের মনের ভাব প্রকাশ পাচ্ছে বলে ধরে নেওয়া হতো, যা ছিল সম্পূর্ণ ভুল।

একদিন বিকেলবেলায় আগ্নেয় হঠাৎ এসে হাজির। তাকে দেখেই চমকে উঠল হৃদয়। এ কী মুখচোখের ভাব হয়েছে তার! সে রীতিমতো ত্রস্ত হয়ে জানতে চাইল, কী হয়েছে তোর? এত মনমরা লাগছে কেন!

আগ্নেয় কিছুক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। তারপর ক্লান্ত গলায় বলে উঠল, কার্টুনগুলি পুড়িয়ে এলাম।

অসম্ভব। হৃদয়ের গলা ভেঙে গেল। এ কী করেছিস তুই? কেন করেছিস? আমাদের ফুলের বাগানের অলংকার ছিল ওগুলো। সাজসজ্জা। গয়না। স্বীকৃতি। কেন ওগুলো নষ্ট করে ফেলেছিস?

আগ্নেয় চুপ করে রইল। বরাবরই নাটকীয়তার দিকে একটা ঝোঁক আছে তার। সবকিছু যখন অতি স্বাভাবিকভাবে চলছে তখন একটু-আধটু নাটক করে, লোকজনকে ঘাবড়ে দিয়ে, হতচকিত করে সে বেশ মজা পায়। আগ্নেয়র এই ঝোঁকটি হৃদয়ের খুব পছন্দের। জীবনে মাঝে মাঝে নাটকীয়তার দরকার আছে বলেই সে মনে করে। নইলে সব কিছুই কেমন যেন একঘেয়ে হয়ে যায়। আগ্নেয়র নাটকগুলি আবার সব সময়েই ধ্বংসাত্মক। কোনও কিছু হারিয়ে, ফেলে দিয়ে, ভুলে গিয়ে, পুড়িয়ে দিয়ে তবেই তার নাটক জমে ওঠে। হৃদয় আবার ওসব সহ্য করতে পারে না। ধ্বংস নয়, সৃষ্টি ও সুন্দরের দিকেই তার ঝোঁক। কোনও জিনিসের ক্ষতি হলে মনে মনে তাকে ফিরে পাওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আগ্নেয় হৃদয়ের এই ব্যাকুলতার কথা জানে। সে আরও জানে, হৃদয়কে ব্যাকুল করে  তুলতে পারলে ক্ষতিপূরণ হওয়ার পরও উপরি হিসাবে ভালো দাম পাওয়া যাবে। সে তাই মাঝে মাঝেই হৃদয়কে ব্যাকুল করে তোলে এবং নিজের জন্য চড়া দাম হিসেব করে বুঝে নেয়।

এবারও তাই হলো। হৃদয় হঠাৎ উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠল, ঠিক আছে বন্ধু, যদি বলতে না চাস, বলিস না। কিন্তু তোর কোনও ক্ষতি হয় নি। তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। আমি আগেই তোর কার্টুনগুলো স্ক্যান করে রেখেছি। ওগুলো সব আমার ই-মেলে রয়েছে। হৃদয় তাহলে ওকে চেনে! আগ্নেয়র মুখে শ্লেষ ফুটে উঠেছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই তার ক্ষতিপূরণ হয়ে গেছে। এবার উপরির পালা। আর সত্যিই হৃদয় আগ্নেয়র কার্টুনগুলোর প্রতি যেন দ্বিগুণ মনোযোগী হয়ে উঠল। আগ্নেয় এখন নতুন কোনও কার্টুন আঁকলেই সেটা হৃদয় নিজের কাছে রেখে দেয়। সে এর জন্য একটা আলাদা ফাইলই করেছে। সেই ফাইলেই জমতে থাকে আগ্নেয়র নতুন নতুন কার্টুন। শুধু আঁকা ছাড়া আগ্নেয়র এখন আর কোনও দায়িত্ব নেই। বাকি সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে হৃদয়। তার ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আগ্নেয়র প্রচার-সচিবের। সে বিভিন্ন জায়পগায় আগ্নেয়র কার্টুন পাঠায়। সেগুলো ছাপা হয়। আগ্নেয়র নাম-খ্যাতি বাড়তে থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন ফুলের প্রদর্শণীতে আগ্নেয়র কার্টুনগুলো চেয়ে পাঠায়। প্লাস্টিকের ফুলগুলোর গায়ে সেঁটে দেওয়া হয় কার্টুনগুলো। বাস্তবের নকল আর বিকৃতির সে হয় এক চমৎকার যুগলবন্দী। আর এসব ঘটনায় আগ্নেয়র চেয়ে আরও বেশি খুশি হয় হৃদয়। আগ্নেয় সংযতভাবে নিজের ভালো লাগা প্রকাশ করে। হৃদয় উচ্ছ্বাসে একদম ফেটে পড়ে।

ফুল নিয়ে অপরিসীম কৌতূহল আগ্নেয়র। বাধ্য ছাত্রের মতোই সে মাঝে মাঝে ফোন করে হৃদয়কে। ফুলের বিষয়ে নানা কথা জানতে চায়। হৃদয়ও নিজেকে সবটুকু উজাড় করে দেয় তখন। শুধু আগ্নেয়র কৌতূহলের জন্যই নয়। যে বিচিত্র পরিবেশের ভেতরে ঢুকে আগ্নেয় ফোন করে, সেটাও তার প্যাশনকে বাড়িয়ে দেয়। আগ্নেয় কখনও জঙ্গলের গভীরে ঢুকে যায়, কখনও দুর্গম পাহাড়ে ওঠে, কখনও কোনও ঝর্ণার ধারে বসে ফোন করে, কখনও বা কোনও প্রাচীন স্থাপত্যের পাশে বসে জানতে চায়। ফুলের খোঁজেই সে এসব করে। আগ্নেয়র এই সৃষ্টিশীল মন আর জীবনযাপনই হৃদয়কে প্রেরণা যোগায়। আগ্নেয় নিজেকে নিয়ে বেশ রহস্য করতে জানে। সে ঠিক কোথায় আছে, কখনই স্পষ্ট করে কিছু বলে না। শুধু আভাসমাত্র দেয়। আর তাতেই হৃদয় উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আর কিছুতেই বুঝতে পারে না, কোথাও বেড়াতে গেলে কেন আগ্নেয় এত আরামপ্রিয় হয়ে ওঠে। দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমোয়, ভালো খাবারের জন্য ছটফট করে, ঠাট্টা মজায় সময় কাটিয়ে দেয়। ওর মধ্য থেকে এ্যাডভেঞ্চারের নেশা কেন যে তখন পুরোপুরি উবে যায়!

একদিন একটু সঙ্কোচ করেই হৃদয় আগ্নেয়কে বলে, আমিও কয়েকটা ছবি এঁকেছি। ফুলেরই। দেখবি নাকি?

কার্টুন? আগ্নেয় উৎসাহ নিয়ে জানতে চায়।

না, কার্টুন আমার হবে না। এগুলো নিছক পেনসিল স্কেচ।

কয়েকদিন পরে আগ্নেয় একটা প্রস্তাব দেয়। বলে, তোর এই স্কেচগুলো নিয়ে একটা বই হওয়া উচিত!

এরকম একটা প্রস্তাবে হৃদয় একটু অবাকই হয়। আগ্নেয় বুঝিয়ে বলে, ফুল নিয়ে তোর এইসব আশ্চর্য কল্পনা বহু মানুষের কাছে পৌঁছানো দরকার। একমাত্র বই হলে তবেই সেটা সম্ভব...

হৃদয় রাজি হয়ে যায়। কিন্তু বই কী করে হয়? এ ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। আগ্নেয়ই তখন ভরসা দেয়, আমার এক প্রকাশক বন্ধু আছে। সে-ই তোর বইটা করে দেবে। কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার আছে...

হৃদয় সরলভাবেই তাকিয়ে থাকে। বন্ধুর ওপর তার পুরো ভরসা আছে। আগ্নেয় বুঝিয়ে বলে, একটা বই করা মানে অনেক টাকার ব্যাপার। তা, সেটা নিশ্চয়ই তোর ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হবে না...

আগ্নেয় একদিন তার প্রকাশক বন্ধুর সঙ্গে হৃদয়ের দেখা করিয়ে দেয়। অবশ্য আগেই সে বন্ধুটির সম্পর্কে হৃদয়ের কাছে ভূয়সী প্রশংসা করে রেখেছিল। এই লোকটি না কি ফুল খুবই ভালোবাসে। ফুল দেখলে, ফুলের কথা শুনলে মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ফুল যারা ভালোবাসে, তাদের সঙ্গে লোকটির আত্মার সম্পর্ক। হৃদয়ের কিন্তু লোকটিকে দেখে মোটেই সেরকম মনে হল না। তার বরং মনে হল, টাকা-পয়সা ছাড়া লোকটি আর কোনও বিষয়েই জানতে তেমন আগ্রহী নয়। যদিও লোকটির কথা শুনলে ভালো লাগে। সে কথা বলে খুব মিষ্টি করে, যদিও সেই মাধুর্যের মধ্যে কৃত্রিমতা রয়েছে, তাকে আড়াল করতে পারে না। হৃদয় নিজের স্কেচগুলো এবং যে টাকা ওরা চেয়েছিল, সবটাই লোকটির হাতে দিয়ে দিল।

মনের অস্বস্তিকেও সে আমল দিল না।

কিন্তু টাকাটা দিয়ে দেওয়ার পরই বইটি নিয়ে আগ্নেয়র যেন আর কোনও আগ্রহ রইলো না। তাকে কিছু বলতে গেলেই সে বলে ওঠে, তুই সরাসরি আমার সেই বন্ধুকেই ফোন কর না। আমি তো শুধু যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি। বাকিটা ওর কাছ থেকেই জেনে নে।

হৃদয় ফোন করে সেই বন্ধুটিকে। সে নানারকম আশ্বাস দেয়। সুখবর শোনায়। নানা অজুহাতে আরো টাকা চায়। হৃদয় টাকাটা দিয়ে দেওয়ার পরই আবার সব চুপচাপ হয়ে যায়।

বইটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত বেরোয় একদিন। আগের দিন খবর পেয়ে হৃদয় আগ্নেয়কে ফোনে বলল, এইমাত্র তোর বন্ধু ফোন করেছিল, কাল সকালে বইটা বাঁধাইখানা থেকে নিয়ে আসতে হবে, তুই যাবি তো আমার সঙ্গে?

না রে। আগ্নেয়র কেমন যেন একটা এড়িয়ে যাওয়া ভাব। সে বলল, কাল তো আমার অনেক কাজ। তুই বরং অন্য কাউকে বল।

ঠিক আছে আমি একাই যাবো।

শেষ পর্যন্ত একাই গেল হৃদয়।

(ক্রমশঃ)  

 

 

 

 

 

 

 

 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন