কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

সুষমা ভট্টাচাৰ্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


ইন্টারনেটের কানাগলি

 

-সত্যি বলতে কী, আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না যে, আপনি আমাকে  পছন্দ করেন।

-কেন? না বিশ্বাস করার কি আছে? তুমি এতো মিষ্টি যে তোমাকে যে কোনো  ছেলেই পছন্দ করবে।

-এ আপনার বদান্যতা। যাক আমাকে আপনি কি যেন বলবেন বলছিলেন গতকাল?

-ও হ্যাঁ বলছি তোমার কয়েকটা ছবি পাঠাবে গো?

-ছবি? পাঠানোর কী আছে! আমার প্রোফাইল থেকে দেখে নিন না! না, ওই ছবি, নাকি অন্য কোনো অন্তরঙ্গ ছবি?

এতক্ষণ খুব মন দিয়ে পিয়ালীর হোয়াটস্যাপ চ্যাটগুলো পড়ছিল অন্তরা। অন্তরা আর পিয়ালী ছোটবেলার বন্ধু সেই স্কুল থেকে। তারপর কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতেও ওরা একসাথে পড়াশোনা করেছে। দুজনের বেশ নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। কিন্তু মাস দুয়েক হল, পিয়ালী আর অন্তরার কথা হয় না। পিয়ালী যেন খুব ব্যস্ত। অন্তরাকে বিষয়টা ভাবিয়েছে ঠিকই কিন্তু অন্তরা বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। এখন সব দেখে শুনে অন্তরা বলল, বুঝলাম। তা তোর এই অর্ধেক ব্রিটিশ ও অর্ধের্ক ইন্ডিয়ান ডাক্তারের ছবিটা দেখি। পিয়ালী একটু ইতঃস্তত করে। ডাক্তারবাবু খুব সুপুরুষ, অন্তরা যদি ওর ছবি দেখে...

-কি রে, সাত পাঁচ কী ভাবছিস? ছবিটা দেখি একবার। পিয়ালী সাহস দেখিয়ে বলে, কেন ছবি দেখে কী হবে? অন্তরা হেসে বলে, মনে কিছু সন্দেহ আছে, সেগুলো দূর করতাম।

পিয়ালী চোখ পাকায়। - ওই আবার তুই শুরু করলি? সব সময় ভালো লাগে না। এতো সন্দেহ কিসের তোর? অন্তরা গম্ভীর হয়ে বলে, কারণ আছে রে! গতকাল  রাত্রে তুই যখন আমাকে এই ডাক্তারের প্রোফাইলের লিঙ্ক দিলি, তখন থেকে আমি তদন্ত করছিলাম। যা পেলাম সেটা শুনলে তোর মাথায় ঘুরে যাবে।  সে  কথায় পরে আসছি। আগে কয়েকটা কাজ কর। এই কথা বলে অন্তরা পিয়ালীর ফোন পিয়ালীর দিকে এগিয়ে দিল।

আদেশের সুরে বলল, ও যে হাসপাতাল এ কাজ করে বলছ্‌ তার নামটা গুগলে  টাইপ কর। পিয়ালী কিছু বলতে যাচ্ছিল, অন্তরা বাধা দিয়ে বলল, আহ! যা বলছি কর!

পিয়ালী বিনা বাক্যব্যয়ে বন্ধুর কথা মেনে নামটি গুগলে টাইপ করল, আর টাইপ করা মাত্রই অবাক হল, এই নামে কোনো হাসপাতাল নেই ইংল্যান্ডে। পৃথিবীর কোথাও নেই এই হাসপাতাল, এটি একটি শিপিং কোম্পানির নাম।

পিয়ালীর মুখ হাঁ হয়ে গেছে দেখে অন্তরা মৃদু হাসল, তুই যখন কাল আমাকে বলেছিলি যে তুই মাইগ্রেনের ব্যথার কথা বলায় ও জিজ্ঞাসা চিহ্ন পাঠিয়েছিল তোকে। তখনই আমার খটকা লেগেছিল। এ কেমন ডাক্তার যে মাইগ্রে্নের নাম শোনেনি। তারপর যখন বললি যে তার নাকি ফেসবুক ছাড়া আর কোনো সোশ্যাল মিডিয়া আইডি নেই, এমনকি ইনস্টাগ্রামেও তার আইডি পাওয়া যাচ্ছে না ওই নামে, তখন ভাবলাম না ব্যাপারটা কাল্টিভেট করতে হচ্ছে। তা আমার পরামর্শে যখন তুই বললি যে ইন্সটা আইডির লিঙ্ক দাও তখন কি জানি  বলেছিল?

পিয়ালী বোকার মতো মুখ করে বলল, ও বলেছিল, ও দেশে ডাক্তারদের নাকি সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট থাকতে নেই। তা তোর কথা মেনে যখন জানতে চাইলাম, তাহলে ফেসবুক একাউন্ট আছে কী করে? রেগে গেল, জানিস!  তারপর কিছুক্ষণ পরে বলল, ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট আছে কিন্তু ব্যবহার করে না আর পাসওয়ার্ডও ভুলে গেছ। এটাও বলল, আমি ওকে অযথা সন্দেহ করছি এবং এভাবে নাকি ভালোবাসা টেকে না। পিয়ালীর গলা ধরে এল। অন্তরার মায়া হচ্ছিল পিয়ালীর জন্য। বলল, ওই ডাক্তার তোকে বলেছে ওর নাম কৃষ খুরানা,  আর ও খুব ছোট থাকতে ওর বাবা মারা যান। যখন তার বয়স চার বছর তখন সে ভারতে এসেছিল, এরপর আর আসেনি। ওর বাবাও লন্ডনে ডাক্তার ছিলেন।  কিন্তু ওর বয়স যখন এগারো তখন ওর বাবা ক্যান্সারে মারা যান, তাই তো?  পিয়ালী এবারে বিরক্ত হল। -এ তো আমি তোকে বলেছিলাম। আবার এক কথা আমাকে বলছিস কেন? অন্তরা একটা বিজ্ঞের হাসি দিল। বলছি কারণ আমি এই ডাক্তারের ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট খুঁজে পেয়েছি। পিয়ালী প্রায় খাট থেকে লাফিয়ে উঠল, সে কী! কীভাবে পেলি?

অন্তরা ওর পড়ার টেবিলে রাখার পেপার ওয়েটটা হাতে তুলে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করি ঠিক্‌ কিন্তু গুগল-এর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফিচার বেমালুম ভুলে যাই। এরকমই একটা ফীচার হল ইমেজ সার্চ, অন্তরা একটু থামল ও বুঝতে পারল পিয়ালী উদগ্রীব হয়ে আছে। একটু সময় নিয়ে অন্তরা বলল, এই ইমেজ সার্চ বড় মজার জিনিস বুঝলি। তুই একটা ছবি গুগলে দিলি সার্চ করতে আর ব্যস গুগল ওই ছবির নাড়ি নক্ষত্র বলে দেবে। তা কাল যখন ডাক্তারবাবুর বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে তখনই এই ফিচারটার কথা মাথায় এল। কিন্তু মুশকিল হল যে তোর ডাক্তারবাবুর একটাই ছবি প্রোফাইলে, তাও লক করা, তাই ডাউনলোড হয় না। তাই তোর কাছে তোর কাছে সকালে ছবি চাইলাম।

পিয়ালী এবার বিজ্ঞের মতো বলল, আসলে ওকে সবাই অনুরোধ করায় ও ফেসবুক এ একাউন্ট খুলেছে। মেয়েরা ওকে খুব জ্বালায় তাই...

অন্তরা এতক্ষণে পিয়ালীর ফোন হাতে তুলে নিয়েছে। তা ঠিক পুরো ফিল্ম-এর হিরো মার্কা দেখতে। তা একে দেখ তো চিনতে পারিস কিনা?

অন্তরা পিয়ালীর দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিল। পিয়ালীর চোখ মোবাইলের স্ক্রিনে আটকে গেল। অন্তরা বলে চলল, ভদ্রলোকের আসল নাম রবার্ট কিং।  ইনি একজন আমেরিকা নিবাসী ডাক্তার। এনার মা রাশিয়ান বাবা ব্রিটিশ। ইনি একজন ফ্যামিলি মেডিসিনের ডাক্তার। পিপলস ম্যাগাজিন তাকে ‘সেক্সিয়েস্ট ডক্টর এলাইভ’-এর সম্মানে ভূষিত করেছে। আরও অনেক পালক আছে তার মুকুটে, সেটা উইকিপিডিয়া ঘাঁটলে পেয়ে যাবি।

পিয়ালীর চোখ জলে ভরে উঠছে দেখে অন্তরা বুঝল ওকে তাড়াতাড়ি করতে হবে। অন্তরা পায়চারি শুরু করল ঘরের মধ্যে। বলল, ডাক্তারবাবু একজন ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সর। ওনার কোটির বেশি ফলোয়ার ইউটিউব চ্যানেলে আছে। তবে সে কথা থাক, আসি কাজের কথায়।

-তোর এই ছদ্মবেশী ডাক্তার বেশ চালাক। গল্পটা ভালোই ঘুরিয়েছ। উইকিপিডিয়া বলছে, ডাক্তারবাবু যখন মেডিকেল স্কুলে তখন ওনার মা ক্যান্সারে মারা যান।  নিজের মাকে বাঁচাতে না পারার দুঃখ ডাক্তারবাবুর আজও আছে। পিয়ালী ফোনটা খাটের ওপর রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করেছে। অন্তরা বলল, এই লোকটার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না। লোকটা কোনো চিত্র তারকার ছবি ব্যবহার করেনি, করেছে ডাক্তারের ছবি, তারপর তার জীবনের গল্পটা একটু বদলে বুনে  গেছে মিথ্যের বেড়াজাল।

অন্তরা পিয়ালীর পাশে এসে বসে জানতে চাইল, আচ্ছা সত্যি কথা বল তো, ওকে কোনো ছবি পাঠাসনি তো? মানে অন্য রকম ছবি বা সেক্স চ্যাট করিসনি তো?

পিয়ালী কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, না না, আমি ওসব করিনি। কিন্তু ও জোর করতো জানিস! আমার মন সায় দিতো না তাই...

পিয়ালী আর কথা বলতে পারল না নিজের বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। অন্তরা পিয়ালীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, বোকার মতো  কাঁদিস না। ওর একাউন্টটা রিপোর্ট কর। আর পারলে সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে জানাস।

পিয়ালী কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওর গলা বুজে এলো। ও অন্তরাকে জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদতে লাগল। অন্তরা কিছু বলল না, শুধু ওর মাথায় হাত বোলালো মাত্র। অন্তরা জানে, এখন উপদেশ ্নয়, বরং নীরবতাই পারবে পিয়ালীকে সান্ত্বনা দিতে। 



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন