কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮

সুমনা পাল ভট্টাচার্য




কিছু আদর আর ...



(১)


আমার ঘুম পেলেই তুমি বুক পেতে দিতে, আর অমনি ঘুম বুড়ির বলিরেখা যেত মুছে।
কিশোরীর মত উচ্ছ্বল ফেনার শরীর তার জরাজীর্ণ হাড়-পাঁজর ছাপিয়ে বুনে দিত ঝলমলে নিটোল চাঁদোয়া
আমি তখন ভো-কাট্টা ঘুড়ি, তোমার মনের ছাদে এলোমেলো উড়ছি,
আকাশের হাত ছাড়িয়ে এক নির্ভয় মৃত্যুর পণ নিয়ে শুধু তোমার হব বলে কী  অসম্ভব জেদ
এখন তোমার ছাদে মরশুমি ফুলের চাষ, জাল দিয়ে ঢাকা চতুষ্কোণ জীবন
আমি কার্ণিশে দাঁড়িয়ে দেখেছি বিবর্তনের আঙুলে একটা সমগ্র উপন্যাস কেমন করে ছেঁড়াখোঁড়া ধূসর অতীত হয়ে ওঠে...
আকাশের দিকে চেয়ে থাকি নিরলস, কে জানে আবার যদি ঘুম পেয়ে যায়!


(২)


তোমার ঘরে ছড়িয়ে এসেছি আমার পুতুলের ঝাঁপি
একটা দুটোর বড় হা-ঘরে খিদে, কোনোটা আবার জন্মকানা, কোনোটার হাত-পা ভাঙা
তবু ওরা মিলেমিশে থাকতো তোমার কোণের ঘরের ওই দেওয়াল আলমারির নীচের তাকে, একপাশে
ওরা  চেনে না তোমায়, তুমিও চেনো না ওদের,
শুধু তোমার বাসি জামাগুলোর গন্ধ আমার শরীরের পাতায় রোজ পেতে পেতে তোমায় প্রভু বলে চিনেছিল ওরা।
শুনেছি আজকাল, তুমি আর রাজা সাজো না, কেমন নড়বড়ে হয়ে গেছ
রোজ রাতে তোমার বুকের ওই অনুর্বর পাহাড়টা অবধি হেঁটে যাও নাকি খালি পায়ে
ওখানে নিপুণ সিঁড়ি কেটে কেটে কী ভীষণ পরিশ্রমে একটু একটু করে সবুজ বুনেছিলাম আমি, মনে আছে?
ওখানে দু-দণ্ড জিরিয়ে নিও তুমি, বুঝি তুমি বড় ক্লান্ত
তারপর ক্ষুধার্ত পুতুলগুলোর হাত থেকে একটুকরো খাবার কুড়িয়ে নিও, জন্মকানা চোখ দুটোতে চেখে নিও জল, হাত-পা ভাঙা পুতুলের ঠোঁটে বুলিয়ে দিও তোমার নোনতা ঠোঁট
তোমার মুকুটে দেবতার আহ্নিক সারা হবে।


(৩)


সংসারের চাবিটা রিমোটের পাশে রাখা আছে,
তোমার জন্য আটপৌরে ঝোলভাত রাঁধতে রাঁধতেই ট্রেন এসে গেল
বড় ব্যস্ততায় ফেলে এসেছি অগোছালো সংসার
তেলচিটে হলুদের দাগটা হয়ত লেগেই আছে এখনও চাবির গায়ে
ভাতটা হাঁড়ির বন্ধ ভাপে পচে গেছে নিশ্চয়ই,
জানি, তোমার পাড়ায় অনেক খাবারের দোকান, তবু চিন্তা হয় বড়,
এতো জিভের নেশায় মত্ত হলে অবশেষে যে অম্ল-বমি বরাদ্দই থাকে।
তোমার ঘরনির তালুতে ডেটল ঢেলে দিও, আবার যদি অসময়ে ট্রেন চলে আসে,
অন্তত চাবির গায়ে বেড়ে ওঠা ছোঁয়াচে জীবাণুটুকু তো রোধ করা যাবে, কী বলো!


(৪)


কমলার কোয়ার পাঁচ আঁকা বুকে নখ ফুটিয়ে টক মিষ্টি নদী দিয়েছি বইয়ে, ঠিক যেমন করে আমার নরম স্তনে ঠোঁট চেপে ধরে তুমি আস্তে আস্তে দাঁতের ভার এলিয়ে দিয়েছিলে...
কালশিটেটা আর নেই, তবে শিরশিরে ব্যথাটা আজও অবিকল ঝনঝন করে ওঠে শীত কাঁপা আলজিভে
আজকাল ঠোঁট ফাটে বড় বেশি, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি কত কত কত কামড়ের ইতিহাস লেখা ওই দেওয়াল জুড়ে, কেমন পুরু, বলিষ্ঠ, শক্ত হয়ে ফুটে উঠছে প্রতিটি অক্ষর।
অন্ধকারে ঝুপ করে গিলে ফেলে ওরা আমার সোহাগ-ঘর।
বুকের উপর দিয়ে হেঁটে চলে তোমার প্রেমিকাদের রমণীয় উষ্ণ চুম্বন...
অচেনা এমন অনেক ঠোঁটের গন্ধে ধর্ষিত হয় আমার আদর-চিবুক প্রতিদিন তিল তিল...
দেবতার আসন ছুঁতে গিয়ে জানু বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নিষিদ্ধ রক্ত, চেয়ে দেখি...  
যে প্রদীপটা তোমার পায়ের কাছে জ্বালিয়ে এসেছিলাম সেদিন,  আজও তা জ্বলছে অবিকল, ঈশ্বরীয় অহঙ্কারে।


(৫)


আমার সংসারে প্রাচুর্য না থাক, দুরন্ত অভাব ছিল না কখনো। আধপেটা জল ভাত মুঠোতেও
পাখিদের ডানা দেখার চোখ ছিল
চিবুকের চাঁদে ছিল একফালি ভেজা জোছনা...
দাওয়ায় বসে সেদিনও দুমুঠো ভাত মেখেছি,
এমন সময়, করুণ শুকনো মুখে ভিক্ষের ঝুলি হাতে
তুমি এসে দাঁড়ালে
কীই বা দিতাম তোমায়! কীই বা ছিল আমা র!
তবু নিজের ওই জলঢালা ভাতটুকু তোমার ঝুলিতে উপুড় করে দিলাম।
তুমি আবার এলে পরদিন, তার পরদিন, তারও পরদিন...
প্রতিদিন ভিক্ষা দিতে দিতে আমি কেমন ঈশ্বরী হয়ে উঠেছিলাম নিজেরই অজান্তে
ক্ষুধাতুর দু:খ রইলো না আর, বরং তোমার নতজানু অঙ্গীকারে ছেয়ে যেতে লাগল দেবত্বের সুখ তৃপ্তির আকাশে।
একদিন, এমনই অপেক্ষা করছি জলভাতের পসরা সাজিয়ে
পেটের শিরার টান ছাপিয়ে উঠছে বুকের তীব্র রক্তনাচন
দেখি,তুমি আমার আঙিনা পেরিয়ে হেঁটে গেলে, নির্বিকার
আমি চিৎকার করে ডাকি, তোমায় ভিক্ষা দিয়ে দেবত্বের তেষ্টা মেটানোর কী অসীম আকুলতা আমার সেই কাতর ডাকে
তুমি ঘুরে তাকালে না, কেবল উল্টোপায়ে ছুঁড়ে দিলে
অহংকারের আগুনে ঝলসে যাওয়া এক মড়মড়ে শুকনো ভিক্ষের ঝুলি...
শ্লথ শরীর টেনে ফিরে আসি দাওয়ায়
 সে আগুনে এখন রোজ সেঁকে নিই পাঁজরের পিঠ
আমার খাওয়া হয় না আজও, কেবল দেবী হওয়ার অভ্যাসে নুন পোড়াভাত মেখে ভিক্ষুক সাজি রোজ রোজ রোজ...
ছদ্মবেশী হই বাঁচার অভ্যেসে।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন