কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮

সুবীর সরকার




উত্তরকথা






(৩৪) 


সে তো ৫০/৭০ বছর আগেকার কোনো পৃথিবী কালখণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা  টুকরোগুলিকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করেই বুঝি গায়ত্রী সিং জলঢাকার চর পেরোতে পেরোতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে মধ্য শীতের রোদমায়ায় অসম্ভব এক পুলক জাগে মাথায় শোলার টুপি হাতে দোনলা বন্দুক গোঁসাইহাট ফরেস্ট থেকে শিকারফেরত গায়ত্রী, হীরা সিং-এর কাঁধে হাত রাখলেই বিশাল প্রান্তর যেন ডেকে নিতে থাকে গিলাডাঙ্গা এস্টেটের ভিতর গায়ত্রী তার অন্যমনস্কতাকেও অগ্রাহ্য করে; গভীর কোনো গান ভেসে আসতে থাকে-

হামার দেশত বড় বাঘের ভয় রে সোনা রায় 
ফান্দত পড়িয়া বুড়া বাঘা কান্দে রে রূপা রায় 

গানের ভিতর কেমন এক যাদু থাকে মায়া থাকে গান ছড়িয়ে পড়ে গানে গানে ভরে ওঠে টাড়িবাড়িখেতখামারবৃক্ষনদী অন্যমনস্কতা থেকে ফিরে আসবার মরীয়া প্রয়াস গায়ত্রীর পৃথিবীর ভিতর পুরাণসকল ঢুকে পড়তে থাকলে পুরাতন পৃথিবীর পটভূমির ভিতর এসে জড়ো হতে থাকে রাজার হাতি, শিকারজুলুস কিম্বা গায়ত্রী সিংএর জোতজমি

গায়ত্রীর চোখের তারায় তারায় আন্ধার আতির জোনাই জ্বলে ওঠে অতীতময়তায় দিন কাটে তার কোথাও চলে যাওয়া ঘোড়ার ক্ষুরধ্বনি আর ফিরিয়ে আনতে পারে না সে চলমানতা দিয়েই তো তার দীর্ঘ যাপন, যা তাকে স্মৃতিকাতরতার দিকে ঠেলে দিলে তার কিছুই করার থাকে না আর জলঢাকার তরমুজবাগিচায় কুয়াশাশিশিরের কুহকে শেয়ালেরা ডেকে ওঠে বিভ্রমে ঢুকে পড়তে পড়তে গায়ত্রী আবার বুঝি জাগিয়ে তোলে, পুনরুদ্ধার করে গিলাডাঙ্গা এস্টেট হেমন্তের ফসলবোঝাই মহিষের গাড়ি বিষাদু মইষালের বাওকুমটা বাতাসের গান কোথাও বুঝি চলে যেতে হয় মানুষকে! পুরাতন পৃথিবীর ভিতর দীর্ঘনিঃশ্বাসেরা ঘনবদ্ধ হয় জিপগাড়ির ভাঙা পাদানীতে দাঁড়িয়ে হেসে চলেছে হীরা সিং সময় অতিক্রম করতে গিয়ে বুঝি একপর্বে গায়ত্রী সময়াতীতের ধারাবাহিকতাতেই আটকে পড়ে! আর কুয়াশার ভেতর ছড়িয়ে যেতে থাকে গান-

আঞ্চলত মুছিনুং হয় তোর 
সোনা মুখের ঘাম’... 

নয়ারহাটের জমজমাটির ভিতর দাঁড়িয়ে আমাকে শুনতে হয়েছিল গায়ত্রী সিং-এর গল্প ২৫ বর্গমাইল বিস্তৃতির পূর্বতন গিলাডাঙ্গা এস্টেটের পুরনো নতুন সব মানুষের কাছেই যিনি মিথের মত মিথ ভেঙে দিয়ে তৈরী হওয়া নতুনতর মিথের জালকে আটকে গিয়েও নিজেকে স্মরণযোগ্য করে রাখবার প্রয়াসটুকু তাকে চলমানতা দিতে না পারলেও; সে কিন্তু মাথায় শোলার টুপি হাতে বন্দুক সহ আদ্যন্ত এক গায়ত্রী সিং হয়েই যেন উঠে আসছেন জলঢাকার পুরাতন চরের খুব খুব গভীর থেকেই 






(৩৫)


লোকপৃথিবীর  দিকে যেতে যেতে হাওড় মাঠ প্রান্তরে প্রান্তরে হাওয়া বাতাসের খুব নিবিড়ত্বে বেঁচে থাকতে থাকতে ধানমাঠে নেমে যাওয়া। ধান কাটার গানে মুখরিত ধানবাড়ি। ফসল কাটার গান। নবুদ্দিন ইয়াসিন কুদ্দুস আকালু খড়ম আলীরা জোটবদ্ধ এগিয়ে আসে। গল্পগাছা হয়। ধানের মণ চালের দর জঙ্গলবাড়ির বাঘের গল্পে হুঁকার আগুন সলাইবিড়ির সান্নিধ্যে আশ্চর্য সন্নিকর্ষ যেন। রোদপ্লাবনের চরাচরে জেগে ওঠে ভেসে ওঠে গানের পর গান-

         ‘বাপই হামার ভাল
         পিন্ধে ফাড়া জাল
         ঘরত ঘরত বিচরি বেড়ায়
        কোন বুড়িটা ভাল’

গান ধূমায়িত গোলকের জালে আটকে পড়লে বুঝি ফান্দে পড়িয়া বগাবগীর কান্দন। হাসির লহর ওঠে। নাচ এসে যায়। নৃত্যরত জীবনযাপন দিয়ে হর্ষবিষাদ আঁকা হতে থাকে-

         ‘মুই নাইয়র আর যাবার নং
         গাড়িয়াল তোমার গাড়িত চড়ি
         তোমার গাড়ির ধুরাত নাগি
         ছিঁড়িয়া গেইচে মোর বিয়র শাড়ি’

সুধারাণি ফুলেশ্বরী সুন্দরী জরিনারা নদীর পারে পারে নেচে যায়। নাচতে থাকে। গাইতে গাইতে গাননাচের এক মস্ত প্রেক্ষিত নিয়ে আসে জন্মমরণের দিন প্রতিদিনের ভিতর। চোখের পাতায় স্মৃতিকাতরতা থাকে বুঝি! দর্শন ও দার্শনিকতা নিয়ে জীবনভর নদী নৌকো গান ঘটমান বর্তমানের চারপাশে ক্রমেই জড়িয়ে যাওয়া।






(৩৬)


আবার ফুলমণী এক্কা জার্মান রাভা। চার্চগেট থেকে সিজিলমিছিল নিয়ে মাদলধামসায় অবধারিত মোরগলড়াই জুয়াতাসের আসর বসে যায়। টুপি পড়া সাহেব যদিও ঘোড়ার পিঠে; আর হাটের পর হাট ঘুরে বেড়াতে থাকা আবু বক্কর। জীবনের ভিতর হাট ঢুকে পড়ে। হাটের ঘোর কিংবা ঘোরের ভিতর হাটপর্বটাই যেন বড় হয়ে উঠতে থাকে। সমস্ত শিকারের গল্পে গুলির শব্দ। দোতারাবাঁশির সুর শুনে শুনে সচকিত গাড়িয়াল। তুষভান্ডার থেকে সারারাত কাত হাঁকাতে হাঁকাতে চিলমারীর দূরে সরে যাওয়া বন্দরের কাঁদোপন্থে পন্থে গাড়ির চাকায় চাকায় গানের ঘূর্ণন-

        ‘ভ্যানোয়ালা আসিয়া এল্যা কাড়িয়া
        নিছে হামার গাড়িয়ালী কামাই’

অথচ চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া কুড়ায় ডুবে যাওয়া কবেকার হাসেম আলি কথাকিংবদন্তির সূত্রে সূত্রে কীভাবে যেন জিন্দাপীর হয়ে ওঠে। ফকিরের পালায় পালায় বর্ণিত হয় হেমকুমারীর কথাকাহিনি, হেমকুমারীর মেলায় আদতে যা আবিষ্কার করা! অথবা গজেন সাহেবের জোতকাচারী ঘুরে শেষতক ফিরে আসা সাহেবের হাটে-

       ‘চাষার মুখত আর নাইরে সেই গান
       বড় সাধের বাপ কালানি আই মোর
       ভাওয়াইয়া ভাষা’ ...

জন্মমরণের ভিতর চুপিসারে জন্মমরণ। যেন কচু পাতের জল। অন্ধ গীদাল ও খোঁড়া ভিখিরির চিরপুরাতন কিসসা।








0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন