ভয়
ভয়
করে না এখন আঁধার। ওই
পাকুড়গাছের কাছে কেউ ঘেঁষে না। জোড়া নাগিন, উল্টো ঝোলা বাদুড়,
দপ করে জ্বলে ওঠা পাশের এঁদো থেকে শাঁকচুন্নি আলেয়া। ওসব তো তার খেলার সাথী। ওসবে ভয় কেন থাকবে!
ওরা পবিত্র প্রকৃতি পুজোর অঙ্গ। রামুর মহাশ্মশানেও
ভয় নেই। তার
ভয় তো জন্ম থেকেই ছিল না। এখন হয়েছে মানুষকে ভয়। যখনি
ডাক্তারের চেম্বারের সামনে প্রতিক্ষারত পেশেন্টদের কাছে বসে তখন কারো গা থেকে একটা
বিদঘুটে ভয়ের গন্ধ টের পায়। জিজ্ঞেস করতেই জানতে
পারে ও একটা বাঁধা খদ্দের। চেম্বারের ভিতরে ঢুকে
টের পায় ডাক্তার তাকে ভয় মাখিয়ে বাঁধতে চাইছে। তারপর তাকে ধরে ভুল ওষুধের
ভয়। বাড়ি
ফিরতেই আত্মীয়েরা ধরায় মৃত্যুভয়।
তেমনি
ভিটে জমিটার দখল নিয়ে উকিলের কাছে গেলেই ওই গন্ধটা পায় রামু। শুনানি হওয়ার
সময় কোর্টে চারদিক থেকে পৌনোপৌনিক ভয়ের গন্ধ আভাস পায়। আর তারপর ডেটের পর ডেট। কখনো কখনো যদি ভয়ের উত্কট
গন্ধ রামুকে মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে ফেলে! পাছে থানা থেকে ডাক পড়ে! আবার
থানায় গেলে ওই গন্ধটা খুব পায় রামু। ওটাও আবার একরকম পাছেফাঁসানো
গন্ধ। সেই
দম আটকানো গন্ধ থেকে পরিত্রাণ পেতে ছুটে যায় দলীয় পার্টিঅফিস। সেখানে
কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে ভুলে যায় নিজেরই নাম কাজ ইত্যাদি। সমর্পিত হয়ে বসে থেকে
তারপর চলে আসে। ওদের
মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া গন্ধ আরো ভয়ানক। তারচেয়ে ওই পাকুড়গাছের
অন্ধকার ঢের বেশি নিরাপদ। এখন সেখানে একটা চট্টান
পাথরের উপর বসে রামুর হাতজোড় করে কাতর প্রার্থনা।
কিছুক্ষণ
করজোড়ে বসে থেকে চোখ বন্ধ করে খুঁজতে লাগলো ভয় থেকে পরিত্রাণকারী দেবতার মুখ। একের পর এক
দেবদেবীর মুখ তার বন্ধ চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যেতে লাগলো। কাউকে প্রাণ চাইলো
না। এরপর তার মৃত বাবা মা’র ভীত
অসহায় করুণ ক্লিষ্ট মুখ ভেসে উঠতেই মাথা ঝেড়ে সরিয়ে ফেলল সেই প্রতিচ্ছবি। চোখ
খুলে যেতেই রাশি রাশি অন্ধকার ঝেঁপে এলো তার দু’চোখের উপর। আঁধারে তার ভয় নেই কিন্তু এই অন্ধকার যেন অসহ নিরাশার
ভয়। চেপে বসছে তার বুকে। একটা ক্ষীণ লাল আলো
অন্ধকারেই দপ করে জ্বলে উঠলো। এটা কি উজ্জ্বল
উদ্ধার? আশার আলো? উপরে তাকাতেই দেখল গাছের ডালে বসে আছে
প্যাঁচা। তার চোখ অন্ধকারে জ্বলছে। ওখান থেকে ঝুলে পড়তে
বলছে তার নিয়তি? তবে কি আত্মহত্যাই একমাত্র পথ? একটা নির্মম
আত্মহননের ইচ্ছে তার বুক ভরে এলো। তখুনি অন্ধকারেই
ভেসে উঠলো তার রুগ্না স্ত্রী ও ছয় মাসের বাচ্চার মুখ। ওরা যে তারই উপর
নির্ভর করে বাঁচে! ওদের প্রাণ ভোমরার যে তারই হৃদয়ে বাস!
আবার
চোখবন্ধ করল রামু। স্বার্থপর
মানুষ ভয়ই তাকে সমস্যার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। ভয় দড়ি খুলতে কে
তার দিকে হাত বাড়বে? কে তাকে সাহস দেবে রুখে দাঁড়াতে? চোখ খুলতে আরো ভয়
বাড়ছে। চোখ বন্ধ করেই বসে রইলো রামু। একটুক্ষণ বসে
থাকতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা মুখ। ক্লিষ্ট মুখ কিন্তু
দৃষ্টি এমন তীক্ষ্ণ যে চোখে চোখ রাখলে যে কেউ নিমেষে সম্মোহিত হয়ে যেতে পারে। সেই দৃষ্টি স্বার্থপর লোলুপ নয়, সেই দৃষ্টিতে আদেশ আছে। আদেশ কেবল আঁধার দূর করা, পরহিতের
জন্য। সেই দৃষ্টিতে প্রতিবাদের ভাষা। আছে অন্য শোষিত হেয়
মানুষদের প্রাণ উজ্জীবিত করার শক্তি। এই মুখ তার
অতিপরিচিত। কিন্তু চোখের দৃষ্টি সম্পুর্ণ ভিন্ন। এই মুখ রামুর। তার নিজের।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন