কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮

শ্যামশ্রী চাকী




খেজুরকাঁটা

উলুক ঝুলুক বৃষ্টিতে মুলিবাঁশের বেড়াটা একদিকে হেলে গিয়ে সে এক বিচ্ছিরি কান্ড। ভাদ্র না এলে বেড়াবাঁধার লোক পাওয়া মুশকিল। একা ঘরের কোণে বাতাস আসে  যায়, জল টুপটুপায়। জল কলমীর বনে দুটো চ্যাং মাছ পেয়েছিল রাঁধু। কলমীভাজা  আর চ্যাং মাছের ঝাল দিয়ে দু’গ্রাস ভাত মুখে তুলে বারান্দার কোণের ফাঁকে পথের  দিকে তাকায় রাঁধু। পথ আর কই! জলের উছলান আর কাঁপা ঠেউ। ঘোলা জলে কী যেন পাক দিয়ে ওঠে। আজ শনিবার, তিন হপ্তা হল মানুষটা আসে না। এক থাবড়া শাকভাজা আর লাল লংকা কষা মাছের টুকরো সানকিতে ঢেকে হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় বসে রাঁধু। লোকটা বড় ভালোবাসে শাকভাজা। পুকুরের ধারে খেজুরগাছটা  বেশ মাথা ছাড়িয়েছে। গত বর্ষায় এই খেজুরকাঁটা ফুটে রাঁধু সাতদিন বিছানায়, পা  ফুলে ঢোল, ব্যথার তাড়সে সে কী জ্বর! ওই মানুষটা রাতদিন সেবা করে সুস্থ  করেছিল রাঁধুকে। তারপর ভাদ্র মাসে পাকা তাল কুড়িয়ে গরম তালের বড়া ভেজে  মানুষটাকে কলাই করা থালে তুলে দিতে দিতে বলেছিল। মা বাপ তো জন্ম দিয়েই খালাস! তুই আমায় চেনালি ঘরবসতের পিরিতের যতন। দু’ফোঁটা জল গালে গড়িয়ে পরে রাঁধুর।

তারপর দুগগা পুজো মানুষটা হাট থেকে লাল ডুরেশাড়ি, আলতা, সিঁদুর, কাচের চুড়ি, পুঁতির মালা এনে দিয়েছিল। পৌষ পাবনে ধান মন্দ ওঠেনি গতবার। রুপোর  মল বানিয়ে দিয়েছিল রাঁধুকে। তারপর একদিন মোতিখুড়োর ছেলে এসে কী   গুজুরগুজুর করলো দিনভর, সেই যে মাথায় মন্তর ঢুকলো, মানুষটা গেল শহরে কাজ করতে। সেখানে অনেক টাকা।

রাঁধুকে আর খেজুরপাতা, সুপুরিপাতা কুড়িয়ে রাঁধতে হবে না। বাড়ির উঠোনে  কলতলা, আর পাকা দেওয়াল তুলে দালানবাড়ি হবে রাঁধুর। বন্ধকী জমিটাও ছাড়ান  হবে। ঠাকুর করলে পুজোয় একটা সোনার হার ওই বামুনপাড়ার গিন্নিমায়ের মতমনসা থানে পুজো দিয়ে এসেছিল রাঁধু মানুষটার জন্য।  প্রথম প্রথম মানুষটা প্রতি  হপ্তায় এলেও কেমন বদলে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে আসা কমলো, তবুও রাঁধু  শনিবার হলেই চুলে ক্ষার দেয়, ধোয়া ডুরে শাড়িটা পড়ে, পায়ে আলতা পরে, গোল করে সিঁদুরের টিপ দিয়ে ওই বারান্দার কোণে বসে।

জল নেমেছে আজ তেরোদিন। মানুষটা আর আসেনি মুলিবাঁশের বেড়া আরো হেলে পড়েছে আজও শনিবার, রাঁধু বারান্দায় বসে, রাঁধু কিছু রাঁধেনি। খড়ের ছাউনি সরে ঘরে জল পরে ভেসে যেত, বৃষ্টি কমতেই দুটো সুপুরির খোল আর খেজুরপাতা চাপা দিতে দিয়ে এত্তখানি খেজুরকাঁটা ফুটেছে রাঁধুর হাতে। রাঁধুর জ্বর এসেছে খুব  বারান্দার কোণে ভীড় জমাচ্ছে ভাঙা কাচের চুড়ির মত স্মৃতিগুলো। ওই দূরে কে যেন হেঁটে আসছে খুব চেনা মানুষ! পড়ন্তবেলায়  একফালি রোদ এসে পরে খেজুরগাছে।  রাঁধু ঘোলাটে চোখে দেখে রোদে স্নান করে গোছা গোছা সোনালী ফল ধরে খেজুর গাছটা ভর ভরন্ত পোয়াতি।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন