কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮

সুবীর সরকার




উত্তরকথা




(৪৯)


ঘনঘোর বরিষণের দিনগুলির ভেতর দিয়ে কেমনধারা হেঁটে চলেছেন অন্তেশ্বরী বুড়ি।দশ কুড়ি গাঁগঞ্জে যিনি সকলের অন্তে আবো।তিনি টাড়িতে টাড়িতে ঘুরবেন,নদীর পাড়ে পাড়ে একা একাই বিড়বিড় করতে করতে হাঁটবেন।আকাশের হাড়িয়া মেঘের দিকে উদাসীন তাকিয়ে থাকবেন।আর দেখবেন কেমন হিড়িক হিড়িক শব্দে পাড় ভাঙছে তোরসা কালজানি রায়ডাক মুজনাই এমন সব নদীগুলি।অন্তে আবোর চোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে কত কত পুরনো সব দিঙ্কাল।তখন রাজার আমল।চারপাশে সব বড় বড় জোতদারের ঘর।আর আষাঢ় শ্রাবণ জুড়ে একটানা কেবল বৃষ্টি আর বৃষ্টিগাঁ ঘরের গাভরু চেংরার ঘর ভরা নদীতে মাছ ধরতো আর তাদের গলায় কেবল গান আর গান।সমবেতভাবেই-

‘সাঁতাও আসিল রে
কালজানির ওরে কাছাড়ে
ঘর গেরস্থী মাইয়া ছাওয়া
ধরিয়া পলান রে’




(৫০)


সুরবালার সাথে যখন ভানমতির দেখা হল গদাধরের চর ভাসানো জলস্রোতের উপর,ব্যাপারীর নাওয়ে তখন কি বরষার বা বারিপতনের কোনো গান বাজছিলো কোথাও-

‘ও রে ঘাঁত ঘোঁত ঘাঁত ঘোঁত ট্যারট ট্যারট
আসিলো রে বরিষার কাল
ও হো বরিষাকাল আসিবে
জলে সুন্দি হোলা ভাসিবে’

এইভাবেই ইতিহাস-ভূগোলপরিধির ভাঁজে ভাঁজে খাঁজে খাঁজে বর্ষাকাল তার প্লাবন চেনাতে চেনাতে লোকমানুষের বাসভূমির দিকে ভয়াবহ ও সুন্দর এক বিশালাকার বন্য মহিষের মতোন ঢুকে পড়তে থাকে।বর্ষাকাল তখন অগণন স্রোত নিয়ে,লোককথার যাদুবিদ্যার মতোন মেঘনদীবাজনার গান শোনাতে থাকে-

‘আজি তোরসা নদীর উথালপাথাল
কার বা চলে নাও
সোনা বন্ধুর বাদে রে মোর
কেমন করে গাও’




(৫১)


যত কিছুই ঘটুক,ঘটে যেতে থাকুক, অন্তে বুড়ি বর্ষাকালের আন্ধারের রহস্যের মধ্যে প্রবেশ করবার পরে আর কিছুই করবার থাকে না!তখন চারপাশে জিকিরের মতন ধ্বনিত হতে থাকে কেবল গান আর গান-

‘দোলার জল থই থই
আছে মাগুর সিঙ্গি কই’

বরিষণ মুখরিত বারিসের দিন ও রাত জুড়ে জুড়ে গঞ্জহাটের কোরাসে কেমনতর এক বৈচিত্র্য এসে পড়ে।এসে যায়।ভরা নদীতে তখন বাইচের নৌকোবাইচের গানে গানে জমে ওঠা বর্ষাকাল-

‘ও রে হাউসের মেলা জোড়া খেলা
কালজানির কাছাড়ে
ও হই,মিজান ভাইএর নৌকা ফাইনালে’

খুব খুব ঘুম জড়িয়ে বর্ষায় ভিজতে ভিজতে আদুরে হয়ে ওঠে চরাচর।ঝাপসা বারিপাতের ভেতর রহস্য জেগে থাকে!টিনের চালের ঘড়বাড়িতে বৃষ্টির শব্দ মেদুরতা জাগায়।আকাশের মেঘে মেঘে গানের সহজতায় বর্ষা তার নিজস্বী তুলে ফেললেও,কিছুতেই চূড়ান্ত প্রাপ্তির কথা ভাবা যায় না!আর,অন্তেশ্বরী বর্মণী তার সাড়ে চার কুড়ি বয়সের ভার নিয়েই ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এসে আবার কিন্তু বর্ষার সিক্ত ও ব্যাঙদলের হাহাকারের এক মহাপ্রলয়েই গিয়ে ঢুকে পড়েন শেষাবধি।আর,এতকিছু মহাসত্যের ফোঁকরে ফোঁকরে অন্তে আবারও হেঁটে যাওয়ার
দৃশ্যের গায়ে আর কিছুই না,কেবলই লেপটে থাকে আস্ত এক বর্ষাকাল।আর নাচগুলি।আর গানগুলি।আর চাঁদের আলোর নিচে চিরকালীন সব গান বাজাতে থাকে বরিষণঘেরা এক মায়াভুবন-

‘বৈঠাতে জল ঘুঙ্গুরা বাজে রে
নাউ কেনে তোর টুলুং ভুলুং করে
ও বাইচার ভাইয়া’

এভাবেই শেষ না হতে চাওয়া গল্পগুলির হয়তো নতুন করে শুরু হয়!











0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন