কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮

ফারহানা রহমান



আধুনিক কবিতায় শার্ল বোদলেয়ার 




“আধুনিকতা হচ্ছে অস্থায়ী, দ্রুতগামী অপ্রত্যাশিত একটি ব্যাপার; এটা শিল্পের অর্ধেক এবং অন্যঅর্ধেক হচ্ছে শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়।” -শার্লবোদলেয়ার

ইউরোপের সাহিত্যজগতে যখন একদিকে রোমান্টিকতার জয়জয়াকার আর অন্যদিকে নাগরিক জীবনের উপর দিয়ে বয়ে গেছে দুটি মহাযুদ্ধ, মহামারী প্লেগ। একদিকে যেমন বদলে যাচ্ছে নৈতিকতার সংজ্ঞা, সামাজিক বন্ধন, অন্যদিকে শুরু হয়ে গেছে মানুষের বোধের আর চেতনার অবক্ষয়। এ যেন এক নব্যপুঁজিপতিদের পেষণে দিশেহারা এক সমাজ । আর তাই বদলেয়ারের কবিতায় উঠে আসলো সেসময়ের প্রকৃত রূপ। মানবজীবন ও সমাজের অবক্ষয়, ঈশ্বরের নিন্দা ও প্রেমের প্রতি ঘৃণা ও প্রথাবিরোধিতা আর উন্নাসিকতাই হয়ে উঠলো তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ।

আধুনিক কবিতাজগতে যাদের কবিতাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়, ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার তাদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক কবিতা  বলতে মূলত আমরা যা কিছু বুঝি, তা কোনো না কো্নোভাবে বোদলেয়ারের কবিতার চিত্তনির্যাস ও তারই সংক্রাম। ফরাসি কবিতায় যেমন রয়েছে  বোদলেয়ারের কবিতার অনুরণন, তেমনি পশ্চিমি কবিতার প্রায় প্রত্যেকটি স্তরেই আমরা বোদলেয়ারের কবিতার প্রত্যক্ষ বা পরক্ষ প্রভাব দেখতে পাই। তিনি তাঁর কবিতায় রিয়েলিজম বা বাস্তবতাকে সেই সময়ের পরিপেক্ষিতে এতটাই স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন যা অন্যদের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। আর তাঁর ছিল কবিতার শব্দচয়নে অসামান্য দক্ষতা যা তাঁকে অন্যসব কবিদের কাছ থেকে অনন্য করে তোলে। তাঁর সময়ের ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকেই তিনি বর্ণমালার চিত্রলিপি দিয়ে বর্ণনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বোদলেয়ার মনে করতেন মানুষ হচ্ছে এমন এক দ্বৈতসত্ত্বার প্রাণী, যার চরিত্রের একদিকে রয়েছে ঈশ্বরের রূপ আর আরেকদিকে  রয়েছে শয়তানের রূপ। আর এই দুয়ের মিলনেই মানুষ হয়ে ওঠে প্রকৃত মানুষ। 

বোদলেয়ার গদ্য কবিতায় এমন একটি স্বতন্ত্রধারার সূচনা করেন যা পরবর্তী কবিদের উপর সমূহ প্রভাব বিস্তার করে। তিনি ছন্দবদ্ধ কবিতাকে পরিবর্তন করে কবিতার স্তবককে ভেঙে দেন। এই গদ্য কবিতাগুলোও ছিল সেসময়ের গদ্য কবিতার  সবচেয়ে সফল এবং প্রাথমিকভাবে গবেষণাধর্মী গদ্য কবিতা। আধুনিক কবিতার  সৃষ্টি ও সৃজনে শার্ল বোদলেয়ারের নান্দনিক অর্জন ও প্রভাব অনস্বীকার্য, কবিতায় তার মনন, ভাবনা ও ভাষা সত্যি অনন্য। 

বোলেয়ারের বাবা আত্মভোলা, সৎ ও শিল্পীমনের অধিকারী জোসেফ-ফ্রাঙ্কোজ বোদলেয়ারের পেশা ছিল শিক্ষকতা। তাঁর মার নাম ছিল ক্যারোলিন আর্চবিউৎ দুফেস। তাদের একমাত্র সন্তান বোদলেয়ার প্যারিসে ১৮২১ সালের ৯ই এপ্রিল জন্মগ্রহণ  করেন। বোদলেয়ারের মাত্র ছয় বছর বয়সে তার বাবা মারা যান, যিনি  বোদলেয়ারের মা দুফেসের চেয়ে ৩৪ বছরের বড় ছিলেন। বোদলেয়ার চিরকাল তাঁর মাকে গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন ফলে বাবার মৃত্যুর পর মা দুফেস যখন মেজর অপিককে বিয়ে করলেন তখন সেই শিশু বয়সেই তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। ফলে পরবর্তীতে মাতা ও বিপিতার  সমূহ ভালোবাসা, মনোযোগ পাওয়া সত্ত্বেও বালক বোদলেয়ার কিশোর বয়স থেকেই বিষাদ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং সারাজীবনভর সেই বিষাদ তাঁকে ঘিরে ছিল। 

১৮৩৩ সালে মেজর অপিক তাঁর পরিবার নিয়ে লায়ান্সে স্নানান্তরিত হন। এবং যেখানে বোদলেয়ারকে একটি মিলিটারি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করানো হয়। স্নাতক  হওয়ার কিছুদিন পরই তাঁকে আইন অবাধ্য করার অভিযোগে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। এর পরের দু’বছর তিনি প্যারিসের ল্যাটিন কোয়ার্টারে একজন লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন এবং ভীষণভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। মনে করা হয় যে এই সময়টিতেই তিনি তাঁর আজীবন ধরে অসুস্থতার পিছনের কারণ সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হন। ছেলের উন্নত ভবিষ্যৎয়ের আশায় বোদলেয়ারের মা ও বিপিতা তাঁকে ভারত ভ্রমণের উদ্দেশে জাহাজে তুলে দিলেন, তাঁরা আশা করেছিলেন যে এই অভিজ্ঞতা বোদলেয়ারের বাউন্ডুলে জীবনকে বদলে  দেবে । ১৮৪১এর ৯ জুন তিনি বর্ডো থেকে ‘দক্ষিণ আকাশ’ নামক জাহাজে করে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হলেন। দুর্ভাগ্যবশত জাহাজটি উত্তমাশা অন্তরীপে এক  ভয়াবহ ঝড়ের মুখে পড়ে জখম হয়ে তিন সপ্তাহের জন্য মরিশাস দ্বীপে আটকে থাকে। এসময় বোদলেয়ার প্যারিসে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ফলে তিনি ভারত সমুদ্রের রেনুয়ার দ্বীপ থেকে অন্য জাহাজে করে প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।

প্যারিসে ফিরে আসার পর তিনি উত্তরাধিকার সুত্রে অগাধ সম্পত্তি লাভ করেন যা দিয়ে তিনি পরবর্তী কয়েকবছর রাজার হালে জীবন কাটান। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ ‘তেওদর দ্যা বাভিলরে’ ১৮৪২ সালে প্রকাশ পায়। এসময় তিনি পোশাকআশাকের  পিছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে থাকেন এবং প্যারিসের আর্ট গ্যালারীগুলোতে এবং ক্যাফেগুলোতে দিন কাঁটাতে থাকেন। তিনি হ্যাশিশ ও আফিমের নেশায় ডুবে থাকেন এবং জান দ্যুভালের প্রেমে পড়ে ‘ল্য ফ্ল্যর দ্যু মল’ সৃষ্টি করেন। জান  দ্যুভালকে তিনি 'ব্ল্যাক ভেনাস' নামে ডাকতেন। পরবর্তী দু’বছরের মধ্যেই  বোদলেয়ার উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া অর্থের প্রায় অর্ধেক টাকা খরচ করে ফেললেন। ফলে মাদাম অপিক তাঁকে মাসে মাসে  শুধুমাত্র প্রয়োজনীয়  হাত খরচ পাওয়ার জন্য একজন আইনজীবী নিযুক্ত করেন এবং তিনি বাকি জীবন সেখান থেকেই সামান্য কিছু ‘ভাতা’ পেতে থাকেন।

প্রতিমাসের আয় কমে যাওয়াতে বোদলেয়ারকে নানা শিল্প সমালোচনা, প্রবন্ধ এবং বিভিন্ন পত্রিকার জন্য জার্নাল লেখা শুরু করতে হয়। তাঁর প্রথম দিকের সমালোচনাগুলো ছিল ইউজিন ড্যালাক্রয়েক্স এবং গুস্টাভ কোরব্যেট মতো  সমসাময়িক ফরাসী  চিত্রশিল্পীদের নিয়ে যা তাঁকে পক্ষপাতমূলক শিল্পসমালোচক  হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৮৪৭ সালে তার প্রথম ছোট উপন্যাস বা নভেলা ‘লা ফাঁফার্লো’ প্রকাশিত হলো। এবং পরের বছর পো-র গল্প ‘মেসমেরীয় উন্মীলন’এর অনুবাদ করেন। এসময় ফ্রান্সে দ্বিতীয় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য ফেব্রুয়ারির বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে এবং বোদলেয়ার নিজেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে বিপ্লবের নেশায় মেতে উঠলেন। 
 
বোদলেয়ার ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ বইটি প্রিন্টিংয়ের গুণগত মানের ব্যাপারে এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে তিনি বইয়ের উৎপাদনের সময় তত্ত্বাবধানে সাহায্য করার জন্য প্রেসের কাছাকাছি একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। নির্ঘুম নিরলসভাবে পাঁচমাসব্যাপী একনাগাড়ে  প্রুফ দেখার পর মোট একশটি বাছাইকৃত কবিতা নিয়ে ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ ১৮৫৭ সালে বই আকারে প্রকাশিত হলো। প্রথমেই ১০০০ কপি প্রকাশ করা হলো, যার দাম ধরা হলো দু’ ফ্র্যা করে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করলেন তেফোয়েল গোতিয়ে-কে। এর মধ্যেকার ছয়টি কবিতা যাতে সমকামী প্রেম এবং ভ্যাম্পায়ারের বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলোকে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের পাবলিক সেফটি সেকশন কর্তৃক অশ্লীল হিসাবে নিন্দা করা হয়। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এই কবিতাগুলো ফ্রান্সের সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিল। ১৮৬১ সালে বোদলেয়ারের ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ এর দ্বিতীয় সংগ্রহটিতে আরো পঁয়ত্রিশটি কবিতা যোগ করা হয়।
তেফোয়েল গোতিয়ে-কে উৎসর্গপত্রে লিখলেন,
‘ফরাসী সাহিত্যের পরম জাদুকর
আমার অতি প্রিয়, অতি শ্রদ্ধেয়
গুরু ও বন্ধু
তেফোয়েল গোতিয়েকে
গভীরতম বিনয়ের অনুভূতিসমেত
এই দূষিত পুষ্পগুচ্ছ
উৎসর্গ করলাম।’

তবে উৎসর্গপ্রাপক গোতিয়ে থেকে শুরু করে সম্পাদক দ্যু কা, অন্যসব প্রতিভাশালী বন্ধুরা এমনকি বোদলেয়ারের খুড়ো স্যাঁৎ ব্যভ পর্যন্ত একজন কেউও মুখ ফুটে বা লিখিত আকারে বইটি সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না বা লিখলেন  না।

যদিও ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ ছিল ১৯ শতকের ইউরোপে প্রকাশিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  এবং প্রভাবশালী কবিতাগুচ্ছ যা বোদলেয়ারকে সাহিত্য জগতে অনন্য এক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। আর একইভাবে, ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ছোট গদ্য  কবিতাগুলোও ছিল সেসময়ের গদ্যের কবিতায় সবচেয়ে সফল এবং প্রাথমিকভাবে  গবেষণাধর্মী গদ্যকবিতা। বোদলেয়ারই প্রথম কবি যিনি ছন্দবদ্ধ কবিতাকে আমুল পরিবর্তন করে কবিতার স্তবককে ভেঙে দেন। গুস্তাভ, ফ্লাবার্ট এবং ভিক্টর হুগোর মতো বিখ্যাত সব লেখকরা এই কবিতাগুলোর প্রশংসা করেন। ফ্লবারট বোদলেয়ারকে লিখিতভাবে জানান যে, “আপনি রোম্যান্টিকটাকে একটি নতুন মাত্রায় খুঁজে পেতে অনুপ্রাণিত করেছেন। আপনি অন্যদের চেয়ে আলাদা (যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ)”। পূর্ববর্তী রোম্যান্টিকদের তুলনায় বোদলিয়ার প্যারিসের  শহুরে জীবনকেই রোম্যান্টিকটার প্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং দাবী করতেন যে সবচেয়ে অধোগামী ও অকাব্যিক অবস্থার ভিতর থেকেই শিল্পের সৌন্দর্য তৈরি করতে হবে।

‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল' এর বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট যৌন উদ্দীপক বিষয় এবং শহুরে সৌন্দর্যের  পাশাপাশি অবক্ষয়কে সম্বলিত করা লেখা হওয়া সত্ত্বেও সেসময় ইউরোপের সাহিত্য জগতে বোদলেয়ারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, যদিওবা সমসাময়িক কবিদের মধ্যে তিনি সমসময় ছিলেন একজন অগ্রহণযোগ্য এবং অনুল্লেখিত কবি। বোদলেয়ার প্রায়ই তাঁর বন্ধুদের মধ্যে এবং সমসাময়িক লেখকজগতে বিখ্যাত হওয়ার জন্যে নানা ধরনের ঔদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা এবং খামখেয়ালী ব্যবহার করতেন।  এরকমই এক পর্যায়ে কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ তিনি তাঁর এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি আমার সাথে স্নান করতে রাজি হবে না ?” এই সব কারণে সাহিত্য জগতে বোদলেয়ার সম্পর্কে এত ধরনের গল্প চালু ছিল যে, কোনটা সত্য  ঘটনা আর কোনটা কল্পনা সেটা খুঁজে বের করা ছিল মুশকিলের ব্যাপার।

বোদলেয়ারের জীবনে এডগার এলান পো’র অবদান অনস্বীকার্য। নিজের সাহিত্যিক  অসাফল্যে তিনি যখন চরম হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছিলেন ঠিক তখনই পো’র রচনা  তাকে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহী করে তোলে। সাহিত্যের মাধ্যমে সেসময় পো’র মধ্য দিয়ে তার নিজেকে প্রকাশ করার আবেগ ছিল অদম্য। তিনি নিজেকে  পো’র অনুবাদক হিসেবে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করতেন। ৫৬ ও ৫৭ সালে  বোদলেয়ার ‘যমজ আত্মা’ নামে দু’খণ্ডে এডগার অ্যালান পো’র গল্প ও প্রবন্ধের  অনুবাদ প্রকাশ করেন। এরপর আরও তিনখন্ড বের হয় ১৮৫৮, ৬৩ ও ৬৫ তে। এই পাঁচখণ্ড অনুবাদই বোদলেয়ারের সাহিত্যিক জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি বলে মনে করা হয়। সেসময় অনুবাদগুলো ভীষণ প্রশংসিত হয়েছিল। তবে এতসব অনুবাদের মধ্যে পো’র মাত্র ৪টি কবিতার অনুবাদ তিনি করেছিলেন।

বোদলেয়ারের জীবনে আরো দুজন দার্শনিকের প্রভাব বিশেষভাবে পড়েছিল। তাঁরা হলেন জসেফ দ্য মেস্তর এবং সোয়েডেনবর্গ। দ্য মেস্তর ছিলেন দার্শনিক ও কূটনীতিজ্ঞ। বোদলেয়ার তাঁর অন্তরঙ্গ ডাইরিতে বলেছিলেন, জসেফ মেস্তর ও পো  আমাকে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন। এদিকে এমানুয়েল সোয়েডেনবর্গ যিনি তাঁর  অর্ধেক জীবন বৈজ্ঞানিক হিসেবে কাটিয়ে পরবর্তীতে একটি নতুন ধর্মতত্ত্বের প্রবর্তন করেন, তাঁর সমূহ প্রভাব এসে পড়ে বোদলেয়ারের চিন্তা চেতনায়। এরমাঝে বালজাকারের মিস্টিক উপন্যাসত্রয়ের সাথে তাঁর পরিচয় হয় এবং একধরনের অলৌকিকতার দ্বারা প্রবাভিত হয়ে তিনি রচনা করেন তাঁর ‘প্রতিসাম্য’ ও ‘পুনর্জন্ম’ কবিতাগুলো।

১৮৬২ সাল থেকে তাঁর অনবরতভাবে স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে এবং দুঃস্বপ্নে ভুগতে থাকেন। ১৮৬৩ সালে প্যারিস ছেড়ে সাহিত্যের বক্তৃতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্রাসেলে রওনা হন। কিন্তু বারবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ৬৬ তে ব্রাসেলসেই প্রকাশ করলেন ‘বেওয়ারিশ মাল’ কাব্যগ্রন্থটি। তিনি এবছর মার্চে প্যারিসে একেবারে ফিরে যাওয়ার মনস্থির করলেন কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাঁকে ব্রাসেলসেই থাকতে হলো। অবস্থার যখন চরম অবনতি হলো, মার কাছে তাঁকে চিঠি পাঠাতে হলো। সেসময় মাদাম অপিক তাঁর দেখভাল করার জন্য  প্রৌঢ় আইনজীবী আঁসেলকে পাঠালেন। আঁসেল বোদলেয়ারকে নার্সিংহোমে ভর্তি করলেন। সেখানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে মাদাম অপিক এসে ছেলেকে নিয়ে একটি আবাসিক হোটেলে উঠলেন। ১৮৬৬ সালের জুলাই মাসের দু’ তারিখে  আবারো প্যারিসে ফিরিয়ে আনলেন। এখানে একটি নার্সিংহোমের নীচতলায় তাঁকে স্থায়ীভাবে চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। তাঁর প্রিয় বইগুলো দিয়ে ঘর সাজানো হলো, দেয়ালে টাঙানো হলো প্রিয় পেইন্টিংস। ঘরের সামনেই একটি ছোট বাগান। মাঝে মাঝে একমনে তিনি সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। বন্ধুরা এলে তাদের কথা শোনেন, কদাচিৎ হেঁটেও বেড়ান। চিকিৎসকরাও আশা করছেন তিনি আস্তে আস্তে সেরে উঠবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ৬৭ সালের মে মাসে তাঁর অবস্থার চরম  অবনতি হলো। জুনের প্রথম সপ্তাহে পুরোপুরি বিছানায় পড়ে গেলেন। এর পরের দু’মাস জ্ঞানহীন মুমূর্ষু অবস্থা কাটলো। ৩১ সে আগস্ট ১৮৬৭ সালের বেলা এগারোটায়, ছেচল্লিশ বছর চারমাস বয়সে তিনি তাঁর মায়ের কোলে মাথা রেখে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন।

যদিও সেসময় ডাক্তাররা নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি, তবুও মনে করা হয় যে,  সিফিলিসই বোদলেয়ারের মৃত্যুর প্রধান কারণ। মৃত্যুর সময়েই কবি হিসেবে বোদলিয়ারের খ্যাতি চারপাশে ছড়িয়ে গিয়েছিলো। কবি মহলে তিনি তখন একজন প্রতিষ্ঠিত কবি হিসেবে পরিচিত। বিখ্যাত কবি স্টেফান মালারমে, পল ভারলেন, আরতুর র‍্যাবোর মতো কবিরা তাঁকে নিজেদের পূর্বসূরি হিসেবে দাবি করেন।  বিংশ শতাব্দীতে এসে জ্য পল সাত্রে, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, রবার্ট লোয়েল এবং সিমাস হ্যানের মতো সব খ্যাতিমান লেখক ও দার্শনিকরা তাঁর লেখক ও শিল্পসত্তাকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে শুরু করলেন।

‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’এর তৃতীয় সংস্করণটি বের হওয়ার আগেই বোদলেয়ারের মৃত্যু হয়। এটিতে ভুমিকা হিসেবে লিখেছিলেন,  ‘কোনো কোনো বিখ্যাত কবি, বহুকাল  ধরে কাব্যজগতের পুস্পল প্রদেশগুলোতে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। আমি  কিন্তু পাপ থেকেই নিংড়ে বের করেছি সৌন্দর্য – তাতে কৌতুক বেশী, আর দুঃসাধ্য বলেই তা অধিক প্রীতিকর। পরম নিষ্পাপ এই গ্রন্থ কোনো কাজে আসবে না কখনো। আমি এটি রচনা করেছিলাম আর কোনো উদ্দেশে নয়, শুধু নিজের  বিনোদন জোগাতে, আর দুরূহের প্রতি আমার তীব্র অভিরুচির তৃপ্তির জন্য’...

সারাজীবন ধরে অপমানীত ও অবহেলিত বোদলেয়ার মৃত্যুর পরেও খুব বেশী সম্মানিত হলেন না। গির্জায় তাঁর পারলৌকিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণ করার সময়ও  মাত্র একশ লোকও হলো না। দোসরা সেপ্টেম্বর তাঁর সৎকারে বক্তৃতা করার জন্যও কাউকে পাওয়া গেলো না। এমনকি প্যারিসের সাহিত্য পরিষদ সংবাদ করার জন্য একজন প্রতিনিধি পর্যন্ত পাঠালেন না। ১৮৬৭ সালের নভেম্বর মাসেই বোদলেয়ারের গ্রন্থসমূহ নিলামে ওঠানো হলো। মিশেল লেভি পরবর্তী ৫০ বছরের জন্য মাত্র ১৭৫০ ফ্রাঁ দিয়ে সমগ্র রচনাবলী কিনে নিলেন।

আধুনিক নাগরিক জীবনের জটিলতাই ছিল ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের কবিতার প্রধান বিষয়। যা কিছু কবিতা নয়, তা থেকে তিনি কবিতাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তাই তিনি তাঁর কবিতাগুলোকে অবান্তরতা বর্জন করে কবিতাসর্বস্ব করে তোলেন। তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙক্তি ও শব্দ, মিল ও অনুপ্রাস থেকেই পাঠক  রস খুঁজে পান। আবেগের নিবিড়তম মুহূর্তেও উচ্ছ্বাসের হাতে ধরা না দিয়ে কবিতার গভীরতাকে মূল্যায়ন করাই ছিল বোদলেয়ারের মূল উদ্দেশ্য।

তাই বোদলেয়ারের সমগ্র কাব্যে যে বাণী নিরন্তর ধ্বনিত হয়েছে তা হচ্ছে, ‘সকলে জানবে না, জানতে পারবে না বা চাইবে না; কিন্তু কবিরা জানুন’।

গ্রন্থসূত্র

১. শার্ল বোদলেয়ার তাঁর কবিতা - বুদ্ধদেব বসু
২. শার্ল বোদলেয়ার অনন্যদৃষ্টি – সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. বোদল্যার, ও বোদল্যার - পলাশ দত্ত
৪. উইকিপিডিয়া










0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন