কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮

রোমেনা আফরোজ



ফিরোজা রঙের আকাশ...





ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ। দীর্ঘ তিনমাসের ছুটি। এই ফাঁকে বেড়াতে গিয়েছি  নানাবাড়ি। বাবার কয়েদখানা থেকে মুক্ত হয়ে বেশ ঝরঝরে লাগছে। এত ভালো লাগার কারণ মনের সাথে সাথে মানুষের শরীরও স্বাধীনতার অংশীদার হতে চায়। সেই স্বাধীনতার স্বাদ নিতে একবার খালাবাড়ি। আরেকবার বড়মামা। ছোটমামার বাড়ি তেমন একটা যাওয়া হয় না। তিনটি বাড়ি পাশাপাশি থাকাতে আমার পাখি হতে কোনো বাধা নেই। এমনকি মাঝে মাঝে খালার বাড়ি যাবার  নাম করে ছাদে যাই। বিড়াল পায়ে। কেউ কিচ্ছুটি টের পায় না। ওখানে মামাতো ভাই অপেক্ষা করে। তাকেও যে খুব একটা ধরা দেই তা নয়। মন বলে, শরীরকে অত প্রশ্রয় দিতে নেই।

একদিন লুকিয়ে নেমে যাই বিলের জলে।

সেই শীতল জলে রাঁজহাস হতে না পারলেও চলে জলকেলি। বার বার সীমাকে অনুরোধ করি, এসব কথা মামাকে বলিস না। কিন্তু গোপনীয়তা কেবল বৃক্ষদের পাঠশালায় শেখানো হয়। আজকাল মানুষকে চেনা বড্ড জটিলতার বিষয়। আমি চিনে রাখলাম, বসন্তদিনের ঝরাপাতা। নশ্বরতা। ওদের কুয়োর পাড়টা আমাকে টানে। একেবারে চুম্বকীয় টান। ইচ্ছে হয়, বালতি দিয়ে জল তুলে ধুয়ে দিই সব।  ভেতর বাহির। কুয়োর পাশের কাঠবাদাম গাছটা ভীষণ রকমের নিশ্চুপ। আমার মত চঞ্চল হরিণী নয়...

একদিন জুয়েল ভাইকে অনুরোধ করি, স্মৃতিসৌধে যাব। তিনিও বোধহয় লোভ সামলাতে পারলেন না। সম্ভবত মেয়ে বলে লালসার গনগনে আগুনে ঝাঁপ দেয় পুরুষ পানকৌড়ি। দু'দিন পর মধ্য দুপুরকে সাক্ষী রেখে আমরা তিনজন এগোতো থাকি। এই তিনজনের আরেকজন বড় মামাদের ভাড়াটিয়া। এখানে  আসার পর থেকে লক্ষ্য করেছি, ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে ওনাদের মাখামাখি একটু বেশিরকম। এসব স্নেহফল মন্দ নয়!

বাড়ির গণ্ডি পার হওয়ার পরেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।  সত্যি কি আমরা সাভারে যাচ্ছি! কেন যাচ্ছি? স্মৃতিসৌধ দেখতে? মহান মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন। সেই উদ্দেশ্য হয়তো বাহ্যিক, কিন্তু আমার ভেতরে গণ্ডি পার হওয়ার একটা আনন্দ টগবগ করে ফুটছে। যেন চৌকাঠ ডিঙোলেই আনন্দ। কী ফুরফুরে দিন! আমার ভেতরে আঙুর বাগান। পরনের ফিরোজা রঙের শাড়িটা বুঝি বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। একপ্রকার বড় বড় ভাব ঝাপটে ধরে আছে  আমার শাড়ির আঁচল।
ঐ যে একটা রিকশা।

আমরা তিনজন একই রিক্সায়। আমি একদিন আকাশের চেয়ে বড় হব। সেদিন মনের ধুকধুকানি নিশ্চিন্তে মেনে নেবে এসব মুক্তদিনের উজ্জ্বলতা। পরবশ্যতাকে ডিঙিয়ে আমরা স্বাধীনতা স্তম্ভের দিকে যাচ্ছি। রিক্সা থেকে নামতে ভীষণ রকম ব্যস্ত বাসস্টেশন। বাসে, আমার পাশে জুয়েলভাই। এটা কি ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত নদীস্রোত! আমি মাহমুদ ভাইকে আশা করছিলাম। কিন্তু কেন এই প্রত্যাশার বিচ্ছুরণ? জানা নেই। মুক্ত বাতাসে শরীর মন দু’ সত্ত্বাই ঝিমঝিম।  মনের এককোণ থেকে কে যেন আচ্ছন্ন ভাব তৈরি করছে। সবকিছু যেন বরফের মত গলতে চায়। অথচ আমি অখণ্ডতা আঁকড়ে বসে আছি। ওদিকে জুয়েলভাই তার সদ্য প্রেমিকার গল্প বলে ফেনা তুলছেন। আমার কি এসব প্রেম কাহিনী শোনার বয়স হয়েছে? নাকি বয়স এক অযাচিত ঠুনকো বিষয়। বয়স্কদের সমকক্ষ হওয়ার জন্য নিজেকেই তৈরি হতে হয়। এগিয়ে যেতে হয় রঙের কাছাকাছি।

আমরা পৌঁছলাম। আমাদের কারও হাতে ঘড়ি নেই। সূর্যঘড়ির আন্দাজে, তখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। অনেকক্ষণ, সূর্য মধ্যকাশ থেকে নেমে খাদের সিঁড়ি ধরে তরতর করে নামছে। যেন পাহাড়িকন্যা। এখানে সেখানে ছায়াদের উচ্চতা। আমরা এলোমেলো হাঁটছি। আমাদের চারপাশে অনেক প্রেমিক প্রেমিকা। দূর থেকে ভেসে আসছে বাঁশির সুর।

মাহমুদভাই একঠোঙা বাদাম কিনে আনলেন। উনি কি জানেন, বাদামের খোসা ছাড়াতে আমার একদম ভালো লাগে না? এভাবেই শেষ বিকেলটাতে কৃষ্ণের বাঁশি বাজে। আগামীকাল কি এমনি রঙিন হবে? ইচ্ছে করছে প্রেম করার। কিন্তু মাহমুদ ভাইয়ের মত বোকাসোকা মার্কা লোকটি কি প্রেমের জন্য উপযুক্ত হবে? জুয়েলভাই মাগরিবের নামাজের জন্য চলে গেলেন। এখন আমরা পাশাপাশি। মন চাইলে, মাহমুদ ভাইয়ের হাত ধরা যায় কিংবা নিষিদ্ধ কথার ফিসফাস। এই যে শরীরের ভেতর আরেকটা শরীর ভীষণ গোপন কথা বলে, সানাই বাজায়, এর  নামই কি ভালোবাসা? ক্রমশ অন্ধকার রাস্তা ধরে সবাই চলে যাচ্ছে। আমরা অপেক্ষা করছি মামাতো ভাইয়ের জন্য। অপরিচিত অন্ধকার আমার ভেতর সৃষ্টি করছে ভয়। ঠিক তখনি, একদল পুলিশের আগমন। তারা একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। সম্ভবত আমার কাতান শাড়ি, সাজসজ্জা দেখে ভেবেছে, আমরা পালিয়েছি। ইস! যদি এমন হতো।
মাহমুদভাই পুলিশদের নিয়ে গাছপালার আড়ালে গেলেন। তাদের কথাবার্তা চলছে। দরকষাকষিও। একা হতেই অন্ধকার বিঁধে যায়। মর্মমূলে পাগলাঘণ্টি বাজে। সেই শঙ্কা অতিক্রম করার বয়স তখনো হয়নি।

আমার থেকে অনেকটা দূরে পুলিশের জিপগাড়ি। তাতে কয়েক জোড়া প্রেমিক প্রেমিকা। আমাদেরকেও কি হা করে গিলে খাবে এই গাড়ি? এতক্ষণে জুয়েল ভাইয়ের চলে আসার কথা। কিন্তু তার টিকিটি দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর মাহমুদভাই মলিনভাবে ফিরে এলেন। আমরা সবাই দলবেঁধে চললাম থানার দিকে। এতক্ষণ কোনোমতে নিজেকে সামলে রেখেছিলাম। এখন আর চোখের  জল বাঁধ মানছে না। গাড়ি ছুটছে। আমার পাশে মাহমুদভাই। তার কাঁধে মাথা রেখে আশ্বস্ত হওয়ার ইচ্ছেটাকে তাড়িয়ে দিই জোর করে। দাদি বলতেন, মেয়েরা  হল আগুন। আর পুরুষরা মোম। আগুনের স্পর্শ পেলে নাকি মোমের পাখিরা গলে যায় নিমেষে!

মোম, তুমি আগুন থেকে দূরেই থাক।

কিন্তু আমার পায়ের আঙুল ভয়ানক জ্বলছে। অবশ করা ব্যথা। কখন কোন ফাঁকে কেটে কেটে গেছে জানি না! রক্ত গড়াচ্ছে। এতক্ষণ পুলিশের ভয় এই ব্যথাকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। মাহমুদভাই, আমার খুব ভয় করছে! তিনি একবার ব্যথার  জায়গাটা স্পর্শ করলেন। সেই স্পর্শে জেগে উঠল বুনোমোষ। রাতের অন্ধকার ভেদ করে ঝুমঝুম বৃষ্টি। এখন আর ব্যথা নেই। ভয় নেই। শুধু হাইভোল্টেজ শক। হুহু বাতাসে ছুটে আসছে অন্ধপাখির দল। ছিঁড়ে খাচ্ছে উইঘুরদের মত আমার বাড়িঘর।

এই যে থানা–পুলিশ হলো, এরপর কোন মুখে বাড়ি ফিরবো? আজ রাতে যদি বাড়ি না ফিরি তবে তো সবাই চিন্তা করবে। হয়তো বাবাকেও জানাবে। সে ক্ষেত্রে পুনরায় জেলখানা। তখন হয়ত যাবজ্জীবন। হায়, এই অসামান্য ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে কীভাবে আমার জীবন কাটবে?

সাভার থানা। একটি চেয়ার দখল করে বসে আছি। আমার ডানদিকে আরও দু’টি মেয়ে। কাঁদছে। আমি অবশ্য সামলে নিয়েছি। একজন পুলিশ নানার নাম, ঠিকানা জানতে চাইলেন। কিন্তু বেহুলাবাতাস সব ভুলিয়ে দিয়ে গেছে, নাকি দুঃশ্চিন্তায়  বেড়ে গেছে আমার বয়স, কে জানে! এই শাড়িটাই যত অলক্ষ্মী। মাহমুদভাই  একবারও এদিকে তাকালেন না। উনি পুলিশদের নিয়ে মহাব্যস্ত। এদিকে আমার পেটে ইঁদুর নয়, একটা হাতি নাচানাচি করছে। সেই দুপুরে একমুঠো ভাত খেয়েছি। তারপর থেকে তো ননস্টপ সিনেমা চলছে।


আমরা থানা থেকে ছাড়া পেলাম ন’টার দিকে। মফস্বলের জন্য এটা অনেক রাত। থানার গাড়িটা আমাদের বাস স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে গেল। সেখানে দাঁড়াতেই ধামরাইয়ের শেষ বাস। মাহমুদভাই হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন বাসের দিকে। একেবারে বাসের শেষ প্রান্তে দু’টি সিট ছিল বলে যা রক্ষা। বাস ছুটছে। রাতের বাসের গতি একেবারে তুঙ্গে। বাইরে নিঝুম রাত। গাড়িতেও কোনো শব্দ নেই।  শুনসান নীরবতা। সবাই যেন ক্লান্ত। অবসন্ন। ইস! জুয়েল ভাইটা যে কোথায়? ওকে ফেলে আমরা বাড়ি যাবো কেমন করে? একবার মনে হল, কেউ জান্নাত  বলে ডাকছে। কিন্তু এই বাসে পরিচিত কারও থাকার কথা নয়। তবে কি জুয়েলভাই?

তখনি হাতের স্পর্শ। সেই অতিলৌকিক ছোঁয়ায় ঝনাৎ করে ফিরে তাকাই। বুঝতে পারি, মাহমুদ ভাই ডাকছিলেন। কিন্তু দুঃশ্চিন্তা এবং ক্ষুধায় খেয়াল করিনি সেই ডাক। সাথে সাথে মনে পড়ে, আজ সারাদিন আমার দিকে উনি ফিরে তাকাননি। একটা দুর্বোধ্য অভিমান উথলে উঠছে। - জান্নাত, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে...

1 কমেন্টস্: