সমকালীন ছোটগল্প |
মাখন কাটার ছুরি
সেদিন থেকে বাপ্পা ভেবেই চলেছে, ভেবেই চলেছে… উপায় একটা বের করতেই হবে, যে করেই হোক। আজ নয় কাল। এভাবে দিনের পর দিন ধারদেনা করে, চেয়েচিন্তে সংসার চালানো যায় না কিছুতেই! বাজার বেচার ধান্দায় একেবারে ভরাডুবি হয়েছে তার এবারের লকডাউনে। মাঝরাতে উঠে সবজি মণ্ডিতে গিয়ে পাইকারের থেকে মাল তুলতো ও। তারপর ভ্যানে করে সারাদিন সবজি বিক্রি করাই ছিল বাপ্পার গত দশ বছরের জীবিকা। সতি বলতে কী, ওর ধোপদুরস্ত চেহারা আর ব্যবহারে সে বাড়ির বউদিদের খুব প্রিয় হয়ে গেছিল এতদিনে। ওর একটা চায়নার মোবাইল রয়েছে। পাড়ার দোকান থেকে ইন্সটলমেন্টে কিনেছিল। সেই মোবাইল নম্বর নিয়ে নিত বউদিরা। সকাল হতেই একের পর এক বউদিদের ফোন আসতে থাকত ওর মোবাইলে। ‘কী রে বেরিয়েছিস?’ ‘কী রে আজ কী কী তুলেছিস?’ অথবা কেউ কেউ আগের দিন সন্ধে থেকেই স্পেশাল সবজির অর্ডার দিত ওকে। কারুর হয়ত বাটন মাশরুম চাই, কারুর বেবিকর্ন। কেউ মোচা আনতে বলত বা অসময়ের কিছু সবজি। সকলের বায়না মেটাতে গিয়ে একেক সময়ে ওকে বেশি টাকা লগ্নী করতে হয়েছিল, তার জন্যও ধার হয়েছিল পাইকারের কাছে। সেসব অবশ্য মিটে গেছে কোন যুগে! এক পাল্লা মাল নিলে যা দাম পড়ত, তার তিনগুণ দামে খুচরো বিক্রি হয় সাধারণত। বাপ্পা বুদ্ধি করে অন্য ভ্যানওলাদের থেকে প্রতি কেজিতে দুটাকা/একটাকা কম নিত সবসময়ে। তাতেই বউদিরা খুশি। এই লাইনে দিনে দিনে ভ্যানওলার সংখ্যা বাড়তেই থাকছে। ফলে বাপ্পাকে কম্পিটিশনে দাঁড়াতে হচ্ছিল ক্রমশ। লোকগুলোই বা কী করবে? সব কাজ বন্ধ। রিক্সা চাপার লোক নেই। মিল বন্ধ। জমিতে কাজ করার জোগাড়ে থেকে রাজমিস্ত্রী/ফুরনের কাজ করে যারা, মুটে, মজুর, কেউ বাদ পড়ল না একে একে। সকলেই সবজি কিনে ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দেখতে দেখতে। তারা তো নতুন লোক। এ লাইনের ঘাঁতঘোঁত অত জানে না। খদ্দের যা দাম বলত, দিয়ে দিত একেক জন। আবার একেক জন অতিরিক্ত লাভ করতে আগুব ছোঁয়া দাম হাঁকত। আর খদ্দেররাও তো লক ডাউনের বাইরে নয়। তাদেরও টাকায় টান পড়েছে। এক কেজি আলুর বদলে, পাঁচশো আলুতে কাজ চালাচ্ছে। দামী সবজির অর্ডার আর কেউ দিচ্ছে না। বাপ্পাও সাহস করে বাজার তুলতে পারছে না।
খুব অল্প দিনের মধ্যেই ব্যবসায় ভরাডুবি হয়ে গেল বাপ্পার। সে এ লাইনের পাকা লোক। তবুও সামলাতে পারল না। পাঁচ কেজি করে পটল, ঝিঙে, ভেন্ডি তুলে সেই মাল কাটাতে দু/তিনদিন লেগে যাচ্ছে। ভ্যানে ঘুরে ঘুরে সবজির চেহারা শুকিয়ে কালচে মেরে গেলে কাস্টমার মুখ বেঁকায়। কত আর জল মারবে সবজিতে ও? শাক তোলা ছেড়েই দিয়েছে এই ভয়ে। একবার তো পালং শাকের বস্তা ফেলে দিতে হয়েছিল ওকে। বৃষ্টিতে ভেতরে যে পচন ধরেছিল, কেনার সময় খেয়াল করেনি ও। একদিনের মধ্যেই সব মাল পচে গু হয়ে গেল! একবার এক বস্তা আলু পচে গেল তিন/চারদিনে। পাইকার তো আর বেছে আলু দেবে না! এদিকে পাব্লিকের আলু বাছার চোটে অর্ধেক আলু বাছাই পড়ে যায়। তখন সেগুলো আবার কম রেটে ছাড়তে হয়। এই করতে করতে বাপ্পার এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। একেক সময়ে তো ওর সুইসাইড করতে ইচ্ছে করে। ওদেরই পাড়ার পাশের পাড়ায় থাকে দিনুদা। একটা মুদি দোকান চালাত। কবেকার মুদি সে! সেও ধারকর্জের ঠেলা আর সামলাতে পারল না। রাতে গলায় দড়ি দিল। সেই থেকে ভাবনাটা চেপে বসেছে বাপ্পার মাথায়। বিয়েথা করেনি তো কী হয়েছে? একটা বোন স্কুলে পড়ে, এবার উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। আরেকটা ভাই এইটে পড়ে। ওর স্কুলে নাহয় খেতে দেয়, বইখাতার পয়সা দেয় বলে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বোনটার পড়াশুনো আর সে টানতে পারবে না। ওর মাথা আছে, পড়তেও চায়। কিন্তু ও আর পারবে না। এই সংসারের চাপেই তো ওর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসা হল না। বাপটা নর্থব্রুকে কাজ করত। একদিন মেশিনের ওপর হাত চলে গেল। কোমর শুদ্ধু ভেঙে দ হয়ে বাড়িতে বসে আছে সেই থেকে। মিল মালিক কিছু টাকা দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলেছে। বাপ্পা ইউনিয়নকে অনেক করে ধরেছিল নিজের কাজের জন্য। মালিকের কাছে দরখাস্ত জমা দিয়েছিল ওদের কথা মতো। কিন্তু মিল মালিক কমপেনসেশন বাবদ লাখ খানেক টাকা মঞ্জুর করা ছাড়া নতুন লোক কাজে রাখতে রাজি হয়নি। অনেকে বলেছিল ওকে, ইউনিয়নকে টাকা খাওয়াতে। কিন্তু ওই এক লাখ টাকাই তার সম্বল ছিল। মা রাজি হয়নি। বাবার চিকিৎসা অবশ্য মিলের ইএসআই থেকে করা হবে, সেদিক থেকে নিশ্চিন্ত করেছিল মালিক। কিন্তু ওই টাকা খরচা করে ফেললে নিজেরা খাবে কী আর ভাইবোনদের পড়াবে কী!
শেষ পর্যন্ত বাজার বেচার ধান্দায় নামিয়ে দিল ওদের পাড়ার রাকেশ। বাপ্পার মাও একসময়ে সাইকেল নিয়ে নিজেদের কলোনিপাড়া ও কাছেপিঠে ঘুরেফিরে বাজার ফেরি করত। বাপ্পার যা বিক্রি হত না, পরদিন সেগুলো নিয়ে কম দামে বিক্রি করত ওর মা। এছাড়া পুকুরধার থেকে নটে, কলমি তুলত, কচুশাক/লতি, থোড়, মোচা এসবও নিয়ে বেরত। পুঁজি ভেঙেছিল যেটুকু, সেটুকু পূরণ করে আস্তে আস্তে বাপ্পা টাকা জমাচ্ছিল। ডেলি স্কিমে একজনের কাছে পঞ্চাশ টাকা করে দিত। বন্ধনে টাকা রাখলে পরে ধার পাওয়া যাবে, সেই আশাতেই ও জমানো শুরু করেছিল। ব্যবসা বুদ্ধি থেকে বৈষয়িক বুদ্ধি কোনোটাই বাপ্পার কম ছিল না। কম বয়স হলেও ও মদ, গাঁজা কোনো নেশাই ধরেনি। বন্ধুদের সঙ্গে পুজোর সময় দারু খায় আর বছরে একবার দীঘা যায় ওরা বর্ষার সময়ে। তখন এমনিতেই সবজি বাজার মন্দা চলে। সেই সময়েও বাপ্পা আকণ্ঠ গেলে। এই কটা দিন বাদে হাজার চেষ্টা করলেও ওকে কেউ টলাতে পারেনি। এমনকি সন্ধে বেলা সুযোগ পেলেই বিয়েবাড়িতে ভ্যান খাটাত ও। বিয়েবাড়িগুলো ধরা ছিল। ওরাই বাপ্পাকে খবর দিত। মালপত্র নিয়ে আসা যাওয়া করে বাপ্পার ভালই রোজগার হত বিয়ের সিজনে। দোষের মধ্যে একটাই—বাপ্পা মাছ খেতে খুব ভালবাসত। তাই মাঝেমাঝেই দামী মাছ নিয়ে চলে আসত বাড়িতে। ভাইবোনদের মুখে হাসি দেখত। মা খুশি হলেও গজগজ করত ওপরে ওপরে। ‘এত দাম দিয়ে মাছ কিনে আনলি! এত টাকা নষ্ট করার কী দরকার…’ আর তারপরে রান্নার তোড়জোড় শুরু করত। সবই ঠিকঠাক চলছিল। বোনকে কলেজে পড়াবে ও, ঠিক করেই রেখেছিল। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, কলেজ তো দূর, খেতেপরতেও কুলোচ্ছে না। উপরন্তু গলা পর্যন্ত ধার।
যত নষ্টের গোড়া ওই লক্ষ্মীদা। লক্ষ্মীপ্রসাদ সাউ। বাজারের পাইকার। শোনা যায় ওর বাড়ির দেওয়ালে টাকা আর সোনা লুকিয়ে রাখা আছে। বিরাট মালদার পার্টি। কিন্তু মক্ষীচুষ একেবারে। পিঁপড়ের পোঁদ টিপে খায় হারামীর বাচ্চাটা! ধারে মাল দেয় বটে। কিন্তু একদিনের। আজ যদি ধারে মাল দেয়, পরের দিন আগে টাকা ফেললে তবে মাল। আর বাপ্পার মতো লোকেরা পালিয়েই বা যাবে কোথায়? সবজি বেচা ছাড়া কোনো উপায় নেই ওদের। অন্তত এই সময়ে। একদিন টাকা দিতে পারেনি বাপ্পা। লক্ষ্মীদাকে হাতেপায়ে ধরে মাল নিয়েছিল তবু। বলেছিল, ‘মা কসম! কাল তোমাকে দুদিনের টাকা পুরো মিটিয়ে দেব!’ কিন্তু পরদিনও ঘুরে ঘুরে বাজার ভ্যানে পড়ে থেকে শুকনো হয়ে গেল। খদ্দেররাও হাত গুটিয়ে নিয়েছে। বিক্রিবাটা একেবারে নেই। ওর চেনা বউদিরা ধারে মাল নিচ্ছে কদিন ধরে ওর কাছ থেকে। আজ নাহয় দুদিন বাদে ওদের টাকা পেয়ে যাবে, এই আশায় দিয়ে দিচ্ছে বাপ্পা। পচে যাওয়ার চেয়ে তো ভাল। এদিকে রাত তিনটের সময় লক্ষ্মীদার কাছে ভয়ে ভয়ে হাজির হল বাপ্পা। শুকনো গলায় বলল-
-আজকের
দিনটা মাল দিয়ে দাও, কাল একেবারে দুদিনের টাকা তোমায় মিটিয়ে দেব। শুনেই লক্ষ্মীদার
চোখ জ্বলে উঠল। কোনো কথাই শুনল না।
-আবে মাদারচোদ, টাকা কি তোর গাছে ফলবে ভেবেছিস? আগে কালকের টাকা মেটা, তারপর কথা! তোর মতো ভিখিরির বাচ্চাকে ধারে মাল দেওয়াই আমার ভুল হয়েছিল। তোর বাপও হয়ত এভাবে ধারকর্জ করে চলত! আগে টাকা দে এখনই…
একগাদা লোকের সামনে ছ্যারছ্যার করে খিস্তি করল লক্ষ্মীদা। লোকগুলো দাঁত কেলিয়ে হাসছিল ওকে দেখে। রাগে, দুঃখে, অপমানে চোখে জল এসে গেছিল বাপ্পার। কী করবে ও? এবার কোথায় যাবে? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভ্যান নিয়ে সোজা চলে গেল গঙ্গার ধারে। বাংলা দোকান থেকে একটা পাউচ কিনে খেয়ে নিল ঢকঢক করে। ওই ভোর রাতে খালি পেটে সেই জলীয় দ্রব্যের অ্যাকশান শুরু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মাথায় রক্ত চড়ে গেল বাপ্পার। বুড়ো অথর্ব বাপটার নাম তুলে খিস্তি করবে সাউয়ের বাচ্চা? আমার মা কি দোষ করেছে রে হারামির বাচ্চা? তোর মা নেই ঘরে? আগুনের জ্বলন্ত শিখা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকল বাপ্পার মাথায়। আর সেই ভোরের সময়ে, উদীয়মান সূর্যকে সাক্ষী রেখে, মা গঙ্গাকে সাক্ষী রেখে বাপ্পা প্রতিজ্ঞা করল—ওই সাউয়ের বাচ্চাকে সে খুন করবে।
আর সেই থেকে একভাবে বাপ্পা খুন করার একটা জবরদস্ত উপায় ভেবে চলেছে। কিন্তু কোনো প্ল্যানই দানা বাঁধছে না। আজ হয়ত ভাতে ভাত জুটে যাবে, কিন্তু কাল বোধহয় হাঁড়ি চড়বে না সংসারে। হতাশায় দাদুর কাছে গিয়ে বসল ও। দাদু একখানি তক্তার ওপর ঘরের এক কোণে সারাদিন শুয়েবসে থাকে। নব্বইয়ের ওপর বয়স। এমনিতে হাঁটাচলা করতে পারে, চান, পায়খানা নিজে নিজেই করে। দাদুকে নিয়ে সমস্যা একটাই—সারাদিন খাই খাই করে, কিন্তু খেতে পারে না বিশেষ। তবুও পেট একটা তার আছে তো বটে। দুমুঠো খেলেই সেও অনেক। বাপ্পার মনে হচ্ছে একেক করে পৃথিবীর বাড়তি বোঝাগুলোকে নিকেশ করে দেয়। দাদু না থাকলে সকলের শান্তি। দাদুরও। তার ঝুলে যাওয়া গলার চামড়ার দিকে তাকিয়ে বাপ্পা ভাবছিল, একটা পোচ মারলেই বুড়ো ফিনিশ হয়ে যাবে। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে দাদু উঠে বসল। তারপর বকতে শুরু করল আপন মনে। ‘আমায় তুই শ্রমজীবী হাসপাতালে আবার দিয়ে আয়। সেই যে পাইলস অপারেশন করাতে নিয়ে গেলি, তারপর তো আর নিয়ে গেলি না! আরেকবার ওখানে ভর্তি করে দিয়ে আয় আমায়, বাপ আমার! কী ভাল ভাল খাবার দিত! সকালে দুধ, পাঁউরুটি, কলা, ডিম সিদ্ধ, দুপুরের মাছের ঝোল দিয়ে ভাত আর রাতে মুরগির স্টু। আহা! কতদিন মুরগি খাইনি…’ আচমকা দাদুর মুখটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরল বাপ্পা। তারপর বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল। আর তখনই মনে পড়ল ওর কুমড়ো কাটার লম্বা লোহার চাকুটার কথা। আবার ঘরে ফিরে চাকু নিয়ে এলো ও। মা পিছন থেকে জিজ্ঞেস করছে, ‘কোথায় যাচ্ছিস রে চাকু নিয়ে এই ভরদুপুরে?’ উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করল না বাপ্পা। মা ভাবল বোধহয় কোনো মোচা বা থোড় কাটতে গেল ছেলে।
সোজা কালীবাড়ি চলে গেল বাপ্পা। কামারের কাছে চাকু ধার করাল। আঙুল দিয়ে অনেকক্ষণ পরখ করল ধার ঠিক মতো হয়েছে কিনা। দেখল আঙুল ছোঁয়ালেই চামড়া কেটে যাচ্ছে। মনের মতো ধারালো চাকু নিয়ে বাড়ি ফিরল সে। ওকে এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে। বাড়ি ফিরে ভাতে ভাত খেয়ে টেনে সন্ধে পর্যন্ত ঘুমলো ও। তারপর যেন কাজে যাচ্ছে এমন ভাবে ভ্যান নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। সোজা গঙ্গার ধারে মদের দোকানের সামনে গিয়ে বসে থাকল ও। দোকানের দিকে শকুনের মতো নজর রেখে বসে রইল চুপচাপ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা চেনা লোককে পেয়ে গেল। লোকটার সঙ্গে গল্প জুড়ে ওরই টাকায় এক পাউচ খেয়ে আবার ভ্যান নিয়ে বসল ও। খিদে খিদে পাচ্ছে এদিকে। রাত হয়ে এলো। অবশ্য পকেটে মদের দোকানের ঝাড়া ছোলা সিদ্ধ ছিল কিছুটা। তাই খেয়ে খিদে মেটাল ও। ঝিম ধরে গেল এরপর। তন্দ্রা এসে গেছিল প্রায় গঙ্গার হাওয়ায়। আচমকা জোরাল আলো এসে পড়ল চোখে। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল বাপ্পা। সামনে পুলিশের টহলদার ভ্যান দাঁড়িয়ে। চেনা কনস্টেবলকে সেলাম ঠুকে বাপ্পা বলল, ‘মাল আনতে যাব মণ্ডিতে। তার আগে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছি’। পুলিশ ভ্যানটা চলে যাওয়ার পরে এবার ও ভ্যান নিয়ে চলল মণ্ডির দিকে। দুটো বাজল প্রায়। ভ্যান ঠেলে ঠেলে লক্ষ্মীর গোলার সামনে এসে পৌঁছল ও। ল্যাম্পপোস্টের আলোর নিচে ভ্যান রেখে চাকুটা জামার ভেতরে চালান করে অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে রইল। মশার কামড় একটা সময় পরে আর টের পেল না। আধঘন্টার মধ্যেই লক্ষ্মী চলে এলো গোলায়। ধূপধুনো দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করছিল ও। ওর কাজের লোকেরা এসে পড়ার আগেই এক লাফে গোলার ভেতরে ঢুকে পড়ল বাপ্পা। ওকে এভাবে আচমকা আসতে দেখে প্রথমে চমকে গেছিল লক্ষ্মী। তারপর সামলে নিয়ে বলল, ‘আবার এসেছিস! টাকা এনেছিস? নইলে আজ তোকে উদোম ক্যালানি খাওয়াব, দেখিস’। হিসহিস করে চোখে আগুন জ্বেলে লক্ষ্মীর দিকে এগিয়ে এলো বাপ্পা। ওর প্রায় গায়ের ওপর এসে দাঁড়াল ও। ‘কিরে! গায়ের ওপর পড়ছিস কেন? ধেনো খেয়ে এসে রঙ নিবি নাকি?’ চাকুটা জামার ভেতর থেকে বের করে সোজা লক্ষ্মীর গলায় চেপে ধরল বাপ্পা। লক্ষ্মী ততক্ষণে ভয়ে দেওয়ালের দিকে পিছিয়ে গেছে। ওকে দেওয়ালে চেপে ধরে চাকুটা দিয়ে ওর গলায় একটু চাপ দিল বাপ্পা। আহা কী মোলায়েম ধার হয়েছে! মাখনের মতো বসে যাচ্ছে লক্ষ্মীর চর্বিওলা গলায়…কয়েক ফোঁটা রক্তও বেরিয়েছে। বাঁ হাতের আঙুলের ডগায় একফোঁটা রক্ত নিয়ে লক্ষ্মীর চোখের সামনে ধরল বাপ্পা। ‘দ্যাখ, দ্যাখ! রঙ কাকে বলে দ্যাখ! একেবারে টকটকে লাল রঙ। আমার মাবাপেরও এমনই লাল রঙের রক্ত ছিল একসময়ে, বুঝলি? এখন সব রক্ত সাদা জলের মতো হয়ে গেছে। আয় আজ তোর রক্তের রঙও সাদা বানিয়ে দিই’। এই বলে হিহি করে হেসে উঠল বাপ্পা। হাত আলগা হয়েছিল একটু ওর। সেই সুযোগে লক্ষ্মী বলল, ‘পাগলামো করিস না! রাগের মাথায় কী বলতে কী বলেছি আমি! মাফ করে দে এবারের মতো। তোর ধারও মাফ করে দিলাম। নে এবার ছাড়!’ কী মনে হওয়ায় লক্ষ্মীর গলা থেকে চাকুটা সরিয়ে নিল বাপ্পা। লক্ষ্মী ওর গদিতে বসে পড়ল ধপাস করে। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘জানিস তুই, আমার কত বড় ঘাটা হয়েছে! ভাবতেও পারবি না তোরা। দশ চাকার দু/তিন ট্রাক মাল আসে রোজ আমার। ব্যাঙ্গালোর থেকে টমেটো আর ক্যাপসিকাম আসছিল দু লরি। আসার পথে গরমে, বৃষ্টিতে ভেতরে ভেতরে মালে টাল ধরেছিল। অর্ধেক জলে গেল। কিন্তু ওরা পেমেন্ট ছাড়ল? ভিডিও কল করে হারামির বাচ্চাদের দেখালাম সব। তবু মানল না। আমার নামে চালান কাটা আছে, তাই আমাকে সব টাকাই দিতে হল পকেট থেকে। লাখ টাকার লস্, বুঝলি হতভাগা? আর তারপরই তুই এসে ঘ্যানঘ্যান শুরু করলি। মেজাজ খারাপ ছিলই, খিস্তি মেরে দিলাম…’। লক্ষ্মী উঠে জল খেল। বাপ্পা মাথা নাড়ল একটু। যেন দু বন্ধুর কথোপকথন হচ্ছে এমন হাবভাব ওদের। চাকুটা পড়েছিল ঘরের একধারে। আর সেই সময়ে দুচারজন মুটে এসে গেল ওই ঘরে। লক্ষ্মী যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে একজনকে বলল, ‘যা তো, এক বস্তা কুমড়ো দিয়ে দে বাপ্পাকে। আর আলুও দিবি হাফ বস্তা’।
বাজার ভর্তি ভ্যান নিয়ে ভোরবেলা বাড়ি ফিরল বাপ্পা। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছিল ওর। মাকে বলল, ‘আমি দুঘন্টা ঘুমবো। খবর্দার আমাকে ডাকবে না’। আর সত্যি সত্যিই ঘুম থেকে উঠে ভ্যান নিয়ে বাজার বেচতে বেরিয়ে পড়ল বাপ্পা। চাকুটার গায়ে তখনও দুএকফোঁটা শুকনো কালচে রক্তের ছাপ লেগে আছে। বাপ্পা জিটিরোডে উঠে হাইড্রেনে ছুড়ে ফেলে দিল চাকুটা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন