সমকালীন ছোটগল্প |
খাঁচার পাখি গেসল বনে
একবার গুজরাটের লিটল রনে গিয়েছিলাম। একটি ছোট নুনের মরুপ্রান্তর আর তাতে অনেক নাম না জানা পাখি৷ ‘মরুপাখি’ মরুর মধ্যে লুকিয়ে থাকলে সামান্য দূরে দাঁড়িয়েও টের পাবেন না এদের অস্তিত্ব। গাইড ঠাট্টা করে বললেন, মরুর মাঠের সাথে পাখির রঙ এমন ভাবে মিশে যায় যে এরা নাকি মাঝে মাঝে মাঠের মধ্যে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে নিজেদের পরখ করে নেয়, মানে নিজেরা যে আছে সেটা নিজেরাই নিশ্চিত নেয়। বর্ণধাঁধায় নিজেদের থাকাটা নিয়ে মাঝে মাঝে এমনই বিমূঢ় হয় মরুর পাখিরা। ক্রমাগত পাখিদের ঐ মরুর মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা এবং তাই নিয়ে ফটোগ্রাফারদের লাফালাফি দেখে কেমন বিরক্তি জন্মাচ্ছিল আমার। আমাকে মজা দিতেই বোধহয় মরুপাখি নিয়ে ওই আষাঢ়ে গপ্পোটি ফেঁদেছিলেন গাইড। সারাটা দিন কেটে গিয়েছিল আমার, প্রান্তরে মুখ লুকোনো পাখি খুঁজতে খুঁজতে। প্রশ্ন জাগছিল, আকাশে ওড়া এত পাখি কেন গুরুত্ব পাচ্ছে না এই মুহূর্তে। সেকি তারা সাধারণ বলে নাকি অগুনতি বলে! কখনো বা নুনের মাঠে ছুটে বেড়ানো বুনো গাধার পিঠে রোদ ঝলসানো দেখে দেখেও ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। আবার সেই প্রশ্ন, আজ ভ্রমণার্থী মানুষ কাকে দেখেছে? দুর্লভ বন্য পশু, নাকি পৃথিবী ভরে নিত্য ছিটকে পড়া রোদ?
বিকেলে ঠিক হল, উটের পিঠে গ্রাম ঘুরতে যাব। গাইড বারবার সতর্ক করলেন, গ্রামের মুসলমানরা নাকি ভীষণ সাম্প্রদায়িক আর ধর্মান্ধ। ওঁদের নাকি সবসময় খুশি করে কথা বলে যেতে হবে আমাদের। বিরাগ চেপে রাখতে হবে। কেন যে গাইড ধরে নিলেন বিরাগ থাকবে আমাদের ভেতরে, তা বলতে পারি না। তবে এইসব কথার জন্য গ্রামে ঢোকার মুখে মন খুব দমে ছিল। আপনা আপনিই বিরূপ হয়ে যাচ্ছিলাম গাঁয়ের লোকজনের প্রতি। গাঁ ঘুরছি, আমরা এবং গ্রামবাসী -- দুপক্ষেরই কেমন দূর দূর ভাব। বিশেষ করে মুসলমান বধূরা শত যোজন দূরে রইলেন আমাদের থেকে।
সন্ধ্যে মিশছে রাতে – ফিরছি। হঠাৎ মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলেন বুড়ো মৌলভী। উট থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন কেমন লেগেছে ওঁদের গ্রাম। হঠাৎ অনেকখানি আনন্দ হল আমার -- বোধহয় একধর্মের মানুষকে নিয়ে আরেক ধর্মের মানুষের ঔৎসুক্যে। ‘হ্যাপি ঈদ’ বলে উঠলাম। উদ্দেশ্য প্রাঞ্জল। হাপি ঈদ বললে যদি মৌলভী একটু বেশি খুশি হন আমার ওপর! একটু বেশি উদার আর আলাদা ভাবেন আমায়!
আমায় স্তব্ধ করে প্রবল রোষে বৃদ্ধ বললেন, ঈদের এখনো অনেক দেরি। মাত্র আর কদিন পরে আমার দেশ গুজরাটের নববর্ষ ৷ এদিন আমার দেশের সব মানুষের আনন্দের দিন। সে দিনটিকে ভুলে হঠাৎ দেড় মাস পরের ঈদকে নিয়ে পড়লে কেন? আগে আমার দেশের নববর্ষের জয় গাও ভাই। বলতে বলতেই ক্লিষ্ট হাসিতে মুচড়ে যাচ্ছিলেন মানববাদী পূজারী। বোধকরি আমার ওপরচালাকি দেখার বেদনায়।
দূরে তখন গাঁয়ের পাতকুয়োটিকে ঘিরে আড্ডায় মেতেছে যত মেয়ে বুড়ি বউ জায়া। আলাপ করছে তাদের সংসারে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে। হয়ত বিধানও দিচ্ছে পরস্পরের সমস্যায়। খানিক পরে বেঁধে যেতে পারে হয়ত কোনো বিশদ ঝগড়াঝাটি। কোনটা যে কবে হবে ভালোবাসার কালে কেই বা জানতে চায়? ওহ! নিশুতি রাতেও যে সমান উজ্জ্বল হয়েছে কুয়োপাড়ের মুখগুলো। সন্ধেচান শেষে যুবতীর শরীরে গ্রামীণ গন্ধদ্রব্যের সুবাস।
আমি যে কিছুতেই ঠাহর করতে পারি না তাদের জাত কুল। কূল মান। উটের পিঠে ফিরছে মরুপাখি। মুখ লুকিয়ে রাখি। নিজের রঙ নিজে খুঁজি। খুঁজি আর খুঁজি। খুঁজে মরি।
বড ভাল লাগল! যেন নিজের দেশের হৃদয়ের কথা শুনলাম! এই আমাদের আসল দেশ!
উত্তরমুছুনবুঝলাম.. নিজেদের দৃষ্টি স্বচ্ছ রাখতে হবে! মিথ্যা প্ররোচনায় যেন না ভুলি - তাতে ক্ষতি দেশের মানুষেরই!
সুচিত্রা সেন