কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

রাহুল দাশগুপ্ত

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাস


একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(২৮)             

সেদিন দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসল ওরা। যৎসামান্য আয়োজন। ভাত, পাতলা মুসুরি ডাল আর ডিন্মের অমলেট। হৃদয় যে খুব অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে সেটা অতলান্তের মা জানেন। বিনয়ে গদগদ হয়ে বললেন, এর বেশী পারলাম না বাবা। তোমার খুব কষ্ট হবে খেতে। কত শুনেছি তোমাদের বাড়ির কথা। রোজ কত পদ হয়, এলাহী খাওয়া দাওয়া। এদিকে আমার একার রোজগারে সব কিছু। উনি সেই কবে থেকে বসেই আছেন। কোনও মতে চলে যাচ্ছে আমাদের।

তিনি নিজে খুব নামী পরিবারের মেয়ে। সেটাও বারবার মনে করিয়ে দিলেন। এখন তাদের অবস্থা খারাপ ঠিকই। কিন্তু বংশগৌরবে কারো চেয়ে খাটো নন বরং সেটা তার একটু বেশীই আছে। এরপরও শ্রোতার মনে করুণা না জেগে পারে কী! ইতিমধ্যেই এই পরিবারটির প্রতি হৃদয়ের মন সহানুভূতিতে ভরে উঠেছে। মনে মনে সে ঠিক করে রেখেছে নিজের সাধ্যমতো অতলান্তের পাশে দাঁড়াবে। ঠিক এই রকম অনুভূতি অনির্বেদের ব্যাপারে কখনও তার হয়নি। অনির্বেদ কখনও অভাবের কথা বলে না। সহানুভূতি চায় না। কিন্তু হৃদয়ের মন সহানুভূতিতে পরিপূর্ণ। অনির্বেদ এটা বোঝে না। হৃদয় যা দিতে চায়, অনির্বেদ তা নিতে চায় না, বরং প্রত্যাখ্যান করে। দু-জনের ঠোক্কর লাগে তাই। অতলান্তের ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। নিজেদের অভাবের কথা বলে তারা নিঃসঙ্কোচে। তারা বুঝে গেছে এই ধনী যুবকটির মন উদার, সহানুভূতিতে পরিপূর্ণ। তাকে অভাবের কথা বললে তার মন গলে যাবে। আর সত্যিই হৃদয়ের মন গলে গেছিল। অতলান্ত ও তার পরিবার বুঝিয়ে দিয়েছিল, হৃদয় যা দিতে চায় তা নিতে তারা প্রস্তুত।

ফুলের বাগানেও অতলান্ত সবার মন জয় করে নিয়েছিল। ভূরি ভূরি প্রশংসা বিলাতে ওর কোনও জুড়ি ছিল না। বিনিময়ে ওর প্রতি বাকিদের মনে ছিল মিশ্র অনুভূতি। একদিকে ওর কাজ দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে অতলান্তের প্রতি ছিল তাদের গভীর সহানুভূতি। যে সহানুভূতি অনির্বেদ কোনওদিন চায় নি, পায়ও নি অতলান্ত সেটাই আদায় করে ছেড়েছিল সবার কাছ থেকে। শুধু ওর অভাব নয়, অসুস্থতাও ছিল এর একটা বড়ো কারণ। অতলান্ত সবাইকে বুঝিয়ে ছেড়েছিল ও খুব অসুস্থ। ফুলের বাগান নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ও হঠাৎ হয়ত নাকে ড্রপ দিতে শুরু করত। সবাই গল্পগুজব করছে, তেলেভাজা নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে, অতলান্তকে দেখা যেত এক কোণে বসে ষুধু শুকনো মুড়ি চিবোচ্ছে। আর কিছু নাকি ওর পেটে সহ্য হয়না। সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, ও অসুস্থ। তার ওপরে অভাবে পড়েছে। অথচ ওর প্রতিভা আছে, বন্ধু হিসাবেও চমৎকার। এরপর বাকিরা আর সহানুভূতি না দেখিয়ে কোথায় যাবে?

আরও একটা ব্যাপার ছিল। অতলান্ত কখনও কারো সমালোচনা করত না। ব্যমানুষেরও নয়, তার কাজেরও নয়। অথচ এটাই ওদের মধ্যে রেওয়াজ ছিল সবাই সবার কাজের বিশ্লেষণ করবে। ভালো হলে প্রশংসা জুটবে, না হলে নিন্দা। যাই জুটুক পরস্পরের কাছে তারা অকপট থাকবে।

হৃদয় একবার একটু অবাক হয়েই বলেছিল, ও কোনও মতামত দেয় না কেন?

নির্মাল্য বলেছিল এটাই ওর স্বভাব।

যেন কারো স্বভাব নিয়ে কোনও কথাই চলেনা। স্বভাববিরুদ্ধ কিছু কারও কাছ থেকে আশা করাও উচিত নয়। তাছাড়া নির্মাল্য এমনভাবে কথাটা বলেছিল যেন এটা খুব গৌরবের ব্যাপার। প্রশংসা ছাড়া এর জন্য আর কিছুই অতলান্তের প্রাপ্য নয়। নির্মাল্য নিজেই ঘোরে ছিল আর হৃদয় বিভ্রান্ত হয়েছিল। ভেবেছিল নরম কোমল কাব্যময় স্বভাব অতলান্তের। কখনও তার মনে হয়নি এটা কারও গা বাঁচিয়ে চলার কৌশলও হতে পারে। অথবা নিজের স্বরূপকে গোপন রাখার চাতুরি। কেউ সন্দেহ করেনি অতলান্তকে।

সাঁঝ পরে শ্রমণকে বলেছিল, অতলান্ত ছিল খুব বড়ো খেলোয়াড়। ফুলের বাগানটাকে ও খেলার ময়দান বানিয়ে তুলেছিল। বাকি সবাই ওর কাছে ছিল চুনোপুঁটি। বাইরে থেকে দেখলে ওকে নিতান্ত নিষ্পাপ আর নিরীহ বলেই মনে হত। নিজের কাজটা ও খুব মন দিয়েই করত। সেইসব কাজ যা করলে ওর নিজের যশ খ্যাতি হবে। ফুলের বাগান নিয়ে ওর কোনও মাথাব্যথা ছিল না। লোকে ভাবত ও ফুলের বাগানের গৌরব বৃদ্ধি করছে। আসলে ও নিজের গৌরব বৃদ্ধি করে চলেছিল। লোকে ওকে নিয়ে আগ্রহী ও কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল। হৃদয়কে ও চমৎকার চমৎকার কথা বলে মুগ্ধ করে রাখত। তুচ্ছ তুচ্ছ ব্যাপারে প্রশংসায় ভরিয়ে দিত। ওর ব্যাপারে হৃদয় যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। অতলান্ত এমন ভাব দেখাত যেন ওর প্রতি হৃদয়ের আনুগত্য নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারবে না। হৃদয় এই আনুগত্য দেখেই বিভ্রান্ত হয়েছিল। ভেবেছিল ওর কথামতোই অতলান্ত চলবে। এটা যে আনুগত্য নয়, সাময়িক এক কৌশলমাত্র সেটা বোঝার মতো জীবনের অভিজ্ঞতা তার ছিল না। বিশ্রুত যেন অতলান্তকে ঠিক বিশ্বাস করত না। বলত, ও খুব বেশী বিনয়ী, আমার খটকা লাগে। অতলান্ত সেটা বুঝত। বিশ্রুতকে সে মিষ্টি কথায় তুষ্ট রেখে চলত, কিন্তু সেটা একটা দূরত্ব বজায় রেখে। বিশ্রুত ছিল স্পষ্ট ও অকপট, ওর ধূর্ত ও মেকী স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। দূরত্বটা তাই স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু বিশ্রুতকে খুশি রাখাও জরুরী ছিল, নইলে হৃদয় সন্দেহ করত। অনির্বেদ ছিল ওর গুণমুগ্ধ, অনুগত, ওর ব্যক্তিত্বে বশীভূত। অতলান্তের সান্নিধ্য ওর ভালো লাগত। নানাভাবে অতলান্তের কাছে পরামর্শ চাইত। কিন্তু হৃদয় আর বিশ্রুত যখন ফুলের বাগান নিয়ে নানা পরিকল্পনা ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত থাকত, তখন অন্যমনস্কও থাকতে পারত না। অতলান্ত ও আগ্নেয় সেই মুহূর্তগুলোয় বেছে নিত পরস্পরকে, নানা তুচ্ছ তুচ্ছ কথায় ওরা নিজেদের ব্যস্ত রাখত এবং এইভাবেই নিজেদের মূল আলোচনা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চাইত। অতলান্ত আর আগ্নেয়র দরকার ছিল পরস্পরকে, মেধার দিক থেকে ওরা অনির্বেদকে নিজেদের সমকক্ষ মনে করত না। কিন্তু পরস্পরের মেধা সম্পর্কে ওদের সমীহ ছিল। ফুলের বাগান নিয়ে আলোচনায় ওদের দুজনের কিছু যায় আসে না, কিন্তু নিজেদের ব্যাপারে দুজনেরই মুগ্ধতা ছিল সীমাহীন এবং একে অপরের কাছ থেকে প্রশংসা পেতে ভালোবাসত। বলা যায়, ওদের দুজনের মধ্যে নিজেদের অজান্তেই হয়তো বা একধরণের পেশাদার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ফুলের বাগানের মূল আলোচনা থেকে দূরে থাকতে ওরা একে অপরকে ব্যবহার করত, আর সেই ব্যবহারের প্রয়োজনেই ওদের পরস্পরের মেধা ও বুদ্ধির প্রতি মুগ্ধতা দেখানো জরুরি ছিল। অনির্বেদকে দু-জনেই ভেতরে ভেতরে করুণা করত আর যখন তার প্রশংসা করত স্বতস্ফূর্তভাবেই করত। বাকিদেরও নিজের বিনীত ব্যবহার আর চমকপ্রদ কথাবার্তা দিয়ে জয় করে নিয়েছিল অতলান্ত। এদের কারও সঙ্গেই তার কোনও অন্তরঙ্গতা ছিল না। কিন্তু সকলেই তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করত। ক্রমেই অতলান্ত হয়ে উঠেছিল ফুলের বাগানের সবচেয়ে বড়ো ব্র্যাণদ, এক স্তম্ভবিশেষ। সে যে কতটা গভীর জলের মাছ এবং কী অসম্ভব ধূর্ততায় গোপনে খেলে চলেছে, কেউই তখন সেটা ধরতে পারেনি। নিজেকে সে নিখুঁতভাবে আড়াল করতে জানত।

উল্কার বেগে উত্থান ঘটছিল অতলান্তের। একদিন লোডশেডিং হয়ে গেছে, অন্ধকারে লণ্ঠনের আলোয় একটা স্কেচ করে চলেছে হৃদয়। হঠাৎ কে যেন ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ধন্য হে সাধনা!

হৃদয় মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল, অতলান্ত।

ঘরে আর কেউ নেই। এই সময় কাউকে আশাও করেনি হৃদয়। অতলান্তের সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে আছে। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল হৃদয়। অতলান্তের কাছে ও ধরা পড়ে গেছে। ওর সাধনা ধরা পড়ে গেছে। সেই মুহূর্তে এই বাক্যটি যেন মধুবর্ষণ করল ওর কানে। সত্যিই, ঠিক জায়গায় সংযতভাবে লাগসই শব্দের ব্যবহারে অতলান্তের কোনও তুলনা হয় না।

হৃদয় সাদর অভ্যর্থনা জানাল অতলান্তকে। তারপর বলল, এই স্কেচটা তোকেই আমি প্রথম দেখাতে চাই।

অতলান্ত মুখের হাসিটি বজায় রেখে বলল, শেষ হতে চলল দেখছি...

তুই দশ মিনিট সময় দে আমাকে।

অতলান্ত যেন খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠল। বলল, বেশ বেশ।

(ক্রমশঃ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন