কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

বিমান মৈত্র

 

সমকালীন ছোটগল্প


হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া


ঢাল বেয়ে উতোরে হাপর কম। একটাই কাজ। পা দুটিকে নিজের হাতে রাখা। বেচাল হয়ে না যায়। সেটাই দস্তুর। একান্তে চলার সময় শান্তপথই অরুন্ধতীর একমাত্র সঙ্গী। এই বাসন্তী বিকেলে প্রতিদিনই সে অরুন্ধতীর জন্য ফুল আনে। আজ এনেছিল আকাশমল্লীর অর্পণ।

: আরে এ'তো রাতফোঁটা হিমঝুরি। এ ফুল তুমি কোথায় পেলে?

:: হিমঝুরি বাংলার ফুল। বিহার ইউপি-তে বলে আকাশমল্লিক।

: কিন্তু আমার ভেতরে তো শুধুই পত্রমোচী নষ্টকিংশুক। আমি সাজি ধূসর বাকলে। অরুন্ধতী একটা বাঁধ না ভাঙা হাসি হাসতে চায়। পারে না। আওয়াজ মাঝপথে এসে ঘষা খাওয়া টায়ারের মতো থমকে যায়।

ইতিমধ্যে টিলার ওপর থেকে নিভে আসা আলোয় মূমুর্ষূ বায়স ফুলের পাপড়িপাত শুরু হয়ে যায়। বসন্তের হাওয়ায় অরুর গায়ের পশম জেগে ওঠে। শান্তপথ থেমে যায়। বলে অরু, এবার  ঘরে ফিরে যাও।

: কোথায় ঘর! বড় ভীড় সেখানে। বরফকঠিন কালখন্ড অরুন্ধতীকে এখানে রেখে গেছে। আর সেই ঘরের চারটে দেয়াল, যেন‌ চারটে ফ্ল্যাট টিভি। ফেলে আসা সময়ের স্মৃতির বিরক্তিকর কলরোল। দেয়ালে দেয়ালে নানান রঙের দিনগুলি। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত তাকে অস্থির করে তোলে। একটি মাত্র রঙ তার। নষ্টকিংশুক। তার আসার কোন সময় অসময় নেই। তখন বড় অসহায় মনে হয় নিজেকে। গর্জনে বর্ষণে সারা স্যানিটোরিয়াম তোলপাড় হয়ে যায়।

বনতল থেকে ফিরবার পথে গোবিন্দর সাথে দেখা। দুদিন মাত্র এসেছে, এরই মধ্যে দিব্যি পরিচয় হয়ে গেছে।

:: অরুন্ধতীদি, চলুন স্যানিটোরিয়ামে ফিরে যাই, চা খাবার সময় হয়ে গেল।

: তুই কেমন আছিস গোবিন্দ?

: ভালো, ভালোই আছি। দিদি, আর এক সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরব। জানো দিদি, আজ সকালে  ডাক্তারবাবু মারা গিয়েছেন। আর আমারো আজ সকালের চা'টা খুব বিস্বাদ লাগলো। কেন বলো তো? ছেলেটির  মুখখানি বড় নিষ্পাপ। যে শক্তি অন্তর-মশালের বাহক সেই-ই মনের সমস্ত আবর্জনার দাহক। তাই গোবিন্দ নির্মল ও পবিত্র ।

অরুন্ধতীর হাসি মলিন। তার গায়ের রঙ খুব পরিষ্কার। ব্রেস্ট অ্যাম্পিউটেশনে পিঠটা সামনের দিকে ঝোঁকা, হিস্টেরেক্টোমির পর গায়ের রঙ অ্যানিমিক হোয়াইট। মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ের রং পরীক্ষা করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। যেন এর মধ্যে কোন এক অজ্ঞাত রহস্য লুকিয়ে আছে। গোবিন্দর মুখে বিস্বাদের কথা শুনে মনে হয়, এমন অনেক অন্তর্দহনে সে আজ চক্রব্যুহের অভিমন্যু।

গোবিন্দের পাশের ঘরে থাকতেন ওই ডাক্তার; মাঝরাতের পর থেকে এমন কাশতেন, ঘুম ভেঙ্গে যেত। শুধু তাই নয়, মনে হত যন্ত্রণা যেন ফাঁপা নলের ভেতর থেকে  হলুদ দলা পাকানো দমকা বাতাসের মতো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। এরই মধ্যে কখনো কখনো যখন তিনি ইজিচেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়তেন সমস্ত রুগীদের মুখে হাসি ফুটে উঠতো।

একদিন ভোরে ডাক্তারের দরজার বাইরে রক্তের স্রোত কিছুটা এসে থেমে থাকতে দেখা গেল। তারপর থেকে সব চুপচাপ। এধরনের ঘটনায় রুগীরা কিছুদিন একে অপরের দিকে বোবা দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর  নিচু স্বরের কথাবার্তা, ডাইনিং হলে কাঁটা চামচের টুং টাং। তারপর এভাবেই একদিন স্যানিটোরিয়াম আবার  স্বাভাবিক হয়ে যায়। অরুন্ধতীর মনে হয়  একটি পরিখা ঘেরা স্থানে মিউজিকাল চেয়ারের খেলা চলছে। গান থামার সাথে সাথে কে যে কোথায় ছিটকে যাবে কেউ জানে না।

ডাক্তারের মৃত্যুর খবরটা জানতেও পারেনি অরুন্ধতী। যাপনযুদ্ধের এই অন্তঃসলিলা স্রোতটির রং সত্যিই লাল। গোবিন্দকে আজ একাই উপরে উঠতে হল।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন