কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

মলয় রায়চৌধুরী

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৮


মহর্ষি কৃষ্ণ জাগুয়ার


লোকটার জীবনের মতনই ওর নামকরণ। মহর্ষি যোগ হয়েছিল সব শেষে, যখন কুঁজো হাড্ডিসার হয়ে গেটের বাইরে বেরিয়ে দুপুরের রোদে বাঁ-হাত তুলে রোদকে আড়াল করছিল। তার আগে যোগ হয় কৃষ্ণ, কেননা লোকটার গায়ের রঙ জন্মের সময়ে এতো কালো ছিল যে নাড়িকাটার গায়নাক অকুস্হল স্পষ্ট দেখতে না পেয়ে বুঝতে পারছিল না ছেলে  না মেয়ে। হাত বুলিয়ে লোমে ঘেরা লেংটু পেয়ে আতংকিত উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠেছিল ছেলে হয়েছে ছেলে হয়েছে ছেলে হয়েছে, ঠিক তিনবার, অ্যাগবারে সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ, ড্যাবড্যাবে চোখ দুটো যেন পুরীর জগন্নাথ। গায়নাক অবাক হয়েছিল যে বাচ্চাটা তো কুচকুচে কালো তার ওপর শুধু যে মাথা ভর্তি কালো চুল তা-ই নয়, সারা গায়ে বয়স্ক পুরুষের মতন কালো লোম। লোকটা একই সঙ্গে দুটো নাম পেল, শ্রীকৃষ্ণ আর জগন্নাথ বা জগা। মায়ের আদরের কৃষ্ণ, বাপের আদরের, না জগা নয়, জাগুয়ার, কালো জাগুয়ার। 

শ্রীকৃষ্ণ’র বাপের পদবি তালুকদার, এখনও যথেষ্ট জমিজমা আছে, তিনফসলি জমি, তালুকদারত্বের জমি, পার্টি-করিয়ে এক নেতার ছোঁড়া-ছোকরারা তিনবিঘে জমি দখল করার পরেও। তালুকদাররা বাঙালিদের পরিচিত একটা বংশ পদবী। জমিদারির পরই তালুক ছিল ভূ-সম্পত্তির  বিভাগ। মোগল আর বৃটিশ আমলে রাজস্ব আর জমিজমা  সংক্রান্ত বিষয় থেকে এই পদবির শুঁড় বেরিয়েছিল আর তা আজও বজায় আছে। ‘তালুক’ থেকেই এই পদবীর গোমর টের পাওয়া যায়। ইসলামি প্রভাব থেকে গেছে মহর্ষি শ্রীকৃষ্ণ জাগুয়ারের পরিবারে, কেননা তালুক এসেছে আরবি শব্দ  তা’আল্লুক’ থেকে, যার মানে জমিজমার মালিকানা আর তালুকের সঙ্গে ফারসি ‘দার’ জুড়ে গিয়ে তালুকদার’। বলতে গেলে পরিবারটায় এরকম নানা বিটকেল জোড়াজুড়ি আছে। যারা তালুকদার ছিল তারা জমি আর ছোটোখাটো ভূ-সম্পত্তির বন্দোবস্ত নিতো, সরকারের কাছ থেকে যেমন, তেমনি জমিদারের কাছে থেকেও, মানে ডবল জোড়াজুড়ি। তালুকদাররা হয়ে উঠতো উপজমিদার। যারা সম্পত্তি নয়ছয় করেনি, মহর্ষি শ্রীকৃষ্ণ জাগুয়ারের বাপের বাপের বাপের বাপ ছিল তাদের একজন। আরও আরও আরও আরও লোভের কলে পড়ে কালো মেয়েকে বিয়ে করেছিল শ্রীকৃষ্ণের বাপের বাপের বাপের বাপ, সেই বউয়ের নাম ছিল রাজনন্দিনী, ডাক নাম দনু – তাকে মনে রাখার জন্য রক্তের ঝাড় থেকে বেরিয়ে এলো শ্রীকৃষ্ণ তালুকদার। সেই বাপের বাপের বাপের বাপকে তার শাশুড়ি বলেছিল, ঘোমটার ভেতর থেকে, দেখো জামাই, লোকে যেন না বলে, কালো মানে শয়তান। জামাই উত্তরে শাশুড়িকে বলেছিল, ‘মা-ঠাকরুণ, জানি, কালো যা আলো নয়, যেমন হীরে পেতে হলে কয়লার খনিতে নামতে হয়’। আর নিজেকে বলেছিল, কালো মানেই মৃত্যুর, বিশ্বাসঘাতকতার আর ভয়ের প্রতীক, ওগুলো আছে বলে জমিজমা করতে পেরেছি। এই পারিবারিক কিম্বদন্তি মহর্ষি শ্রীকৃষ্ণ জাগুয়ার অনেকবার ঠাকুমার মুখে, মায়ের মুখে, পিসিমার মুখে, বাপের মুখে শুনেছে। তাছাড়া ও জানে যে দানবরা জন্মেছিল দনুর পেট থেকে। জানে বলে নিজেকে আরও বেশি শক্তিমান মনে করে।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন