কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

নিবেদিতা আইচ

 

সমকালীন ছোটগল্প


থার্মোমিটার


ফ্লোরে গড়াগড়ি দেয়া স্যাঁতসেঁতে আলোটার ওপর চোখ রাখতেই ওর মনে পড়ল আজকে কোথাও যাবার তাড়া নেই।

ঘুমের মধ্যে কাঁদছিল সে, নিঃশব্দে। পাশের বিল্ডিংয়ে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে। সেই শব্দে সম্বিত ফিরতেই প্রচন্ড বিতৃষ্ণায় বিছানায় পাশ ফিরলো। কোথাও যাবার না হলেও এই অশ্লীল শব্দ দূষণের মাঝে বসে থাকা যাবে কিনা সে ব্যাপারে ওর যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে।

মনে মনে তারিখ গুণে একবার মনে হল বাড়ি চলে যাওয়া যায় আজ। পরীক্ষা শেষের দিন থেকেই হস্টেল ফাঁকা হতে শুরু করেছিল। শুধু ওর মতো হাতে গোনা কয়েকজন হয়ত মাসের শেষ অব্দি হাজিরা দিয়ে টিউশনির বেতনটুকু হাতে পাবার অপেক্ষায় রয়ে গেছে।

খালার ছুটি আজ। এর মানেই হল প্রচুর সময় নষ্ট হবে আজকে। অবশ্য নষ্ট করার জন্য সময় এখন অঢেল৷ আলসেমি ঝেড়ে উঠে বসতে বসতে গলার ব্যথাটা ভালো করে আরেকবার নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে গেল ওকে। ঢোক গিলতে গেলেই মনে হচ্ছে কেউ গলা চেপে ধরছে। করিডোরের দু'মাথায় দুটো করে গ্যাসের চুলা। আজ দুদিকেই ফ্রি। অন্যসময় ফাঁকা পাওয়া যায় না সহজে। ওদের রুম এদিকের শেষ মাথা থেকে দু'নম্বর। রুমমেট গত সপ্তাহেই বাড়ি গেছে। কদিন তাই হাত পা ছড়িয়ে থাকা হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাড়ি ফিরেই বা কী হবে! পুরো ছুটি বিশ্রীরকমের একঘেয়েমিতে কেটে যায়, সেই সঙ্গে কাজের কাজ কিছু হয় না ওর। বাড়ি যাওয়া মনে মনে ক্যান্সেল করে দিয়ে ঢাউস মগ আর চা পাতার বয়াম নিয়ে বাইরে থেকে ঘরের দরজা চাপায় ঝুমি।

পাতলা কার্ডিগানের ভেতরে ওর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এই শীত আর বসন্তের মাঝামাঝি সময়টা বড় অদ্ভুত। তার ওপর শহরের এই প্রান্তটা গাছগাছালির ছায়ায় মোড়া, একপাশে মিউনিসিপলিটির খোলা মাঠ, আরেকপাশে লেক। তাই শীতবোধও বেশি হয়। তবে যে হারে নতুন সব বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে ঝুমির মনে হয় না বেশিদিন আর এমন নিরিবিলি থাকবে জায়গাটা।

সোনালি রঙের লিকারে চুমুক দিতেই এবার গলায় আরামবোধ হয় একটু। সামান্য একটু আদা কুচির অভাব কেবল। ক্যাম্পাসের শেষ মাথায় রতন কাকুর স্টলের চায়ের কথা মনে পড়ে। কীসের সঙ্গে কী! হাসি পায় ওর৷

ঘরে ফেরে ঝুমি। চেয়ারে স্তুপ করে রাখা কাপড়গুলো যত কাজই থাকুক আজ ভাঁজ করবে বলে বিছানায় ছুঁড়ে রেখে  গেছে গতকাল। ফিরে এসে সেসবের উপরেই গড়াগড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছে রাতে। সেদিকে চোখ পড়তেই আবার ভ্রুজোড়া কুঁচকায় ওর। লেপের গভীরে শরীর ডুবিয়ে দিতে দিতে ফোনটা হাতে নেয়, ফেসবুক, ইন্সটা, মেসেজবক্সে আলসে ভংগিতে হামাগুড়ি খেতে শুরু করে।

মৌনম গতকাল রাতে ওকে কিছু একটা লিখেছে। সে এখনো পড়ে দেখেনি। শুধু নিজের অজান্তে কয়েকবার হিসেব করে নিশ্চিত হয়েছে ওদের শেষ দেখার সপ্তা তিনেক পেরিয়েছে। শেষ কথারও। এ ক'দিনে ঝুমির কিছু বলতে ইচ্ছে করেনি। করেনি মৌনমেরও। ওদের ব্যাপারগুলো বরাবরই এমন নিঃসাড়ে, ধীরলয়ে ঘটেছে। শুরুর দিকের কিংবা এই শেষের খবরটুকুও তেমন করে কেউ জানতে পারেনি। শেষ বলে কিছু আছে কিনা এ নিয়ে ঝুমির মনে অবশ্য যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

যে জলবিন্দু শেষ পর্যন্ত নদীতে গিয়ে মেশেনি সে মাটির বুকে থেকে যায় - গালিবের কবিতার অনুবাদ। ছোট্ট নোটবুকটায় গোটা গোটা হরফে লিখে রেখেছিল মৌনম। ওর নিজের অনুবাদ নয়, কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছিল নিশ্চয়ই। নিজের হলে অবশ্যই ঝুমিকে ইনবক্সে পড়তে দিত।

বালিশের তলায় হাত যেতেই ঝুমির মনে হয় কতকাল হল ডায়েরিতে কিছু লেখে না সে। 'ক্লদ মনে'র লোগো দেয়া ডায়েরিটা মৌনম গিফট করেছিল ওকে। চমৎকার প্যাস্টেল রঙ্গের পাতাগুলোর বাঁদিকে লতানো ফুলেল নকশা। খুব যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছে ঝুমি। ফাঁকা পাতার কোণ ছুঁয়ে দিতে দিতে মনে মনে আওড়ায় -শুরু হলেই তো শেষ হয়ে যাবে!

আজকাল যে কোন কিছু শেষ হয়ে যাবার কথা ভাবতে গেলে মৌনমের প্রসঙ্গ এসে যায়। এসাইনমেন্ট জমা দেয়া শেষ, লিড পেন্সিলের রিফিল শেষ, নেসক্যাফের স্যাশে শেষ, প্রতিবেশী বাবলা গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোটা শেষ - সব শেষ মানেই গম্ভীর ছেলেটার কথা মনে পড়ে যাওয়া। ঝুমি নিয়ম করে নিজেকে দুবেলা চোখ রাঙায়। চোখের ওপর দু'হাত রেখে ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা উত্তাপটুকু নেভাতে চায় সে। বাথরুমে অবিশ্রাম ঝর্ণাধারার নিচে দাঁড়িয়ে লম্বা সময় ধরে শরীর ভেজায়। কাজের কাজ হয় না কিছুতেই।

ঠিক কি কারণে এমন হল জানতে চাইলে ঝুমি ঠিক স্পষ্ট করে বলতে পারবে না। ওদের বয়সী আর দশটা ছেলের মতো সরব, উদ্দাম স্বভাবের নয় মৌনম, বরং ওর মধ্যে একটা শান্ত সুবোধ, কিশোরসুলভ সারল্য আছে। কখনো কিছু নিয়ে দৃঢ়ভাবে নিজের মতামত দিতে সংকোচ বোধ করে তা সে মনে মনে যত শক্তভাবেই মানুক না কেন। শুরুর দিকে ওর এমন স্বভাব নিয়ে মাথা ঘামায়নি ঝুমি। ঠাট্টাচ্ছলে 'আমার দেয়া তোমার মৌনম নামকরণটা সার্থক হল দেখছি' বললেও ঝুমির নিজের কানেই ক্রমশ এই একই কথা উপহাসের মতো শোনাতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে যে প্রায় সব সম্পর্ক নিঃশর্ততার খোলা আকাশ ছেড়ে বদ্ধঘরের আগলবন্দী হতে শুরু করে একথা ঝুমি অল্পবিস্তর জানতো। কিন্তু ওদের বেলাতেও যে তাই হবে এটুকু মানতে ওর বেগ পেতে হয়েছে। বন্ধুদের আড্ডায়, ক্লাসে, চ্যাটবক্সে রাজনীতি, সমাজ, সমসাময়িক যেকোন কিছু নিয়ে আলাপে মৌনমের নিজস্ব মতামত প্রকাশের ভঙ্গি ঝুমিকে প্রতিনিয়ত হতাশ করতে থাকে।

মৌনম বলত- আমার বিশ্বাস যদি সত্য হয়, তবে তা সত্যই থাকবে, সে আমি যত চিৎকার করেই বলি না কেন আর সমস্ত মন দিয়ে বিশ্বাস করি না কেন, একচুল এদিক ওদিক এর হবে না। সত্যের তীব্রতা একই রকম থাকবে। বরং প্রতিবারই যদি সত্যকে সত্য বলে প্রমাণ দেখাতে হয়, তবে তা গুরুত্ব আর মাধুর্য দুটোই হারায়।

ঝুমির মনে হতে থাকে এসব একেবারে গা বাঁচানো পন্থা ছাড়া আর কিছু নয়। অন্যমতের মানুষটিকে ভুল ধারণা নিয়ে তর্কে জয়ী হতে দেয়া মানেই যে নিজের হেরে যাওয়া এমন শিশুসুলভ ভাবনা যদিও ওর মাঝে নেই। কিন্তু বারবার মিথ্যেটা সজোরে প্রচারিত হলে তা তো একসময় সত্যের বর্ম পরে নেয়, আর এতেই আপত্তি ঝুমির। আড্ডা শেষে ওদের নিজস্ব কথোপকথনগুলো তাই ক্রমশ শীতল হতে শুরু করে। ঝুমি দিনের পর দিন চেপে রাখা আক্ষেপ নিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।

প্রতিদিন একচিলতে করে মিথ্যে রকমের দুপুর নামে হিম হিম দিনে। আজকের মিথ্যে দুপুরেও চোখ লেগে এসেছিল ওর। তাতেই ভোরবেলার সেই স্বপ্নটা আরো একবার এসে ধরা দিয়ে গেল। ঝুমি তখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। মৌনম তখন স্টেশনে দাঁড়িয়ে কারো সংগে গভীর আলাপে মগ্ন। ট্রেনটা দুলতে শুরু করতেই ঝুমির রাগটা পড়ে গেল। মৌনমকে ডাকবে বলে হাত বাড়াতে গিয়েও পারল না সে, গলা দিয়ে শব্দ বেরুলো না ওর। মৌনম তখন ঘনঘন এদিক ওদিক তাকিয়ে ওকে খুঁজতে শুরু করেছে। সবুজ রঙের ট্রেনটা হুইসেল দিতে দিতে স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছিল তখন।

মনে হলো কেউ ডাকছে ঝুমিকে। ঘুমের রেশটা কাটতেই চোখমুখের জ্বলুনিটা সে টের পেল। ঠোঁটটা শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে। ঘরজুড়ে এনার্জি লাইটের ম্যাড়ম্যাড়ে আলো। মাথার দুপাশে ব্যথায় টনটন করছে ওর। বিছানায় উঠে বসে ঝুমি। ওর কি জ্বর এলো? মাপা হয়নি একবারও। সকাল থেকে পড়ার টেবিলে, পার্সে, কলমদানিতে কোথাও খুঁজতে বাদ রাখেনি কিন্তু থার্মোমিটারটা খুঁজে পায়নি। এ নিয়ে বোধ হয় পরপর দুটো থার্মোমিটার হারিয়েছে ঝুমি।

মুনিম অপেক্ষা করছে। পাশের রুমের নতুন মেয়েটা, ফার্স্ট ইয়ারের, নিচতলা থেকে আসার পথে এইমাত্র ঝুমির রুমের দরজায় টোকা দিয়ে গেছে। ওর মুখে নামটা শুনেও ঝুমির কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে যায় ব্যাপারটা বুঝতে। না, স্বপ্ন নয়, মুনিম অর্থাৎ মৌনম অপেক্ষা করছে! ওর জন্য! ফোন করেও সাড়া পায়নি ঝুমির। তাই এতদূর চলে এলো?

সিঁড়ির ধাপ বেয়ে পাখির পালকের মতো হাওয়ায় উড়ছিল ওর শরীর। মৌনম অপেক্ষা করছে। কী আশ্চর্য, স্বপ্নে যেমন স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মৌনম। পরনে ফরেস্ট গ্রিন পোলো শার্ট। একটু কি রোগা লাগছে ওকে? চোখ দুটো রক্তজবা। ঝুমি ইশারায় ওকে বসতে বলে দুটো আদা চায়ের অর্ডার দেয়।

তারপর একটা দুটো করে কথা শুরু হয়।

-হঠাৎ এদিকে? সব ঠিকঠাক?

-চলে যাচ্ছে।

-তোমার জ্বর?

-বুঝতে পারছি না ঠিক।

-তাহলে? বুঝতে এসেছো এখানে?

-বলতে পারো তা-ই।

হেঁয়ালির মতো শোনালেও কথা বলতে ভালো লাগছে ঝুমির।

-মেসেজগুলো পড়োনি?

মৌনমের চোখেমুখে আরো অনেক অনেক প্রশ্ন। ঝুমির মনে হয় সত্যিই তো কেন পড়ে দেখল না সে! এখন আর সে সুযোগ নেইও, ফোনটা রুমে ফেলে এসেছে।

ঝুমি এবার ওর কপালে হাত রাখে। ওকে নিশ্চুপ দেখে মৌনম বসে যাওয়া গলায় বলে-

-তোমার কাছে থার্মোমিটারটা হবে, ঝুমঝুমি?

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন