কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


যমরাজ্যের পাশপোর্ট

 

মাঝ রাত্তির পেরিয়ে গেছে। পরিযায়ী মানুষদের একটা দল রেললাইনের উপরেই বিশ্রাম করছিলো। সারা দিনের ক্লান্তিতে সবাই ঘুমিয়েও পড়েছিলো। প্রচন্ড শব্দ। ওদের মধ্যে রঘুরামই ব্যাপারটা প্রথম টের পেয়েছিলো। লকডাউনে শুনশান রেললাইন। জোড়ালো হেডলাইট জ্বালিয়ে একটা মৃত্যুর গাড়ি ওদের দিকে তেড়ে আসছে। রঘুরাম একটা  আর্ত চিৎকার করে উঠলো। একদম সামনেই এসে পড়েছে ছুটন্ত ট্রেনের ভয়ঙ্কর শব্দটা। হাতে আর কিছু ভাববার সময় নেই। রঘুরাম ঝাঁপিয়ে পড়লো রেললাইনের পাশে, জল জমা একটা গর্তের মধ্যে। তারপরে কী হয়েছে সে জানে না! কারণ সে জ্ঞান হারিয়েছে।

এখানে বিরাট একটা ম্যাসাকার হয়ে গেছে। খবর পেয়ে খুব ভোরে কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্স আর উদ্ধারকারীদের দল সেখানে হাজির। কিছু রিপোর্টারও চলে এসেছিলো। বেশ কিছু লোক - ছেলেমেয়ে, বুড়ো, বাচ্চা – সবাই চলন্ত ট্রেনে কাটা পড়েছে। কয়েকজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিছু লাশ ওখানে এখনও রক্তাক্ত পড়ে আছে। এরা সবাই পরিযায়ী শ্রমিক।

উদ্ধারকারী দল দেখতে পেল একটা মানুষ গর্তে পড়ে আছে। ওরা লোকটাকে গর্ত থেকে তুলে রেললাইনের পাশের নিয়ে এলো। ততক্ষণে ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। রঘুরাম ফ্যাল ফ্যাল করে রেললাইনটার দিকে চেয়ে রইলো। যেখানে দল বেঁধে তারা সবাই গত রাতে একসাথে শুয়েছিলো। রঘুরামের শরীরে একটু আধটু চোট লেগেছিল। উপস্থিত লোকেরা তাকে ফার্স্টএইড দিল।

রঘুরাম খুঁজতে চেষ্টা করলো ভানুমতি ও ছেলে হরিশকে। কোথায় গেছে তার বুড়ো বাপটা, দলের আর সবাই? না, কেউ কোথাও নেই। শুধু লন্ডভন্ড জিনিষপত্র, জুতো চপ্পল, চাদরের টুকরো, এদিক ওদিক রক্তের ছোপ! রেললাইনের পাথরের খোয়া, কংক্রীটের স্লিপার, আশপাশের মাটি লাল লাল হয়ে আছে। রেললাইনের দুটো পটরির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোলগোল হাতরুটি! এলোমেলো পড়ে আছে কাপড়চোপড়, থালাবাসন, চটের ব্যাগ আর ঝোলাঝুলি। ওর বাপটাকেও বা নিজের পরিবারের কাউকে আশপাশের জীবন্ত মানুষদের ভীড়ে সে খুঁজে পেল না। তখনও রেললাইনের উপরে পড়ে ছিল তিনটে লাশ, যাদের রঘুরাম চেনে না!

একজনকে রঘুরাম জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার সাথে আমার পুরো পরিবার? তারা কোথায়?’

একজন রিপোর্টার পাল্টা তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ট্রেনলাইন ধরে হাঁটছিলে কেন? কোথা থেকে আসছিলে? লাইনের উপরেই কেন শুয়ে পড়েছিলে?’

-‘বোম্বেতে খাবার নেই, কাজ নেই। মহামারী আর লকডাউনের জন্যে সব ট্রেন বন্ধ। ফেরত আসার ট্রেন নেই। রাস্তা ধরে হাঁটলে পুলিশে প্যাঁদাচ্ছে! লাইন ধরে হাঁটবো না তো কী করবো, বাড়ি তো ফিরতে হবে!’

কথা বলতে বলতে রঘুরামের আরেকবার মনে পড়লো বউ, বাচ্চা আর বুড়ো বাপটার মুখ। সবাই তো রেললাইনেই শুয়েছিল। ওদের হাল কি? ওরা কি বেঁচে আছে? রঘুরাম তো কোনমতে ডোবার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের প্রাণটা বাঁচিয়েছে। অন্যরা কি তাহ’লে বেঁচে নেই?

রঘুরাম শুনলো, যারা রেললাইনে শুয়েছিল, তারা সকলেই কাটা পড়েছে। তড়িঘড়ি বডিগুলোকে তুলে নেয়া হয়ে গেছে। হাসপাতালে বা মর্গে।

সে কিছুক্ষণের জন্যে রেললাইনের পাশেই বসে রইলো। নিজের পরিজন বা পরিচিত কোন মুখ ধারেকাছেও সে খুঁজে পেল না। তাহলে ওরা কি সবাই ট্রেনের চাক্কার নীচে পিষে গেছে?

রিপোর্টার আর ট্রেন-অ্যাকসিডেন্টের উদ্ধারকারীর দল রঘুরামের নাম ধাম, সাথে কারা কারা ছিল এসব বৃত্তান্ত লিখে  নিলো। চারপাশে প্রচুর মানুষজনের ভীড়!

রঘুরামকে উদ্ধারকারীর দলের অফিসারটি জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি এখন কোথায় যেতে চাও?’

লোকটা ধরা গলায় উত্তর দিলো, ‘অন্য কোথাও গিয়ে কি হবে? কোথাও যেতে চাই না। এখন বড়ো দুর্দিন! করোনার  কাল! আমি যাব যমরাজার কাছে। মরণের দেশে! আমি জানি - আমার বউ বাচ্চারা সব্বাই - কিছুক্ষণ আগেই - সেখানে পৌঁছে গেছে!’

এই কথাটুকু বলে রঘুরাম হু হু করে তীক্ষ্ণ গলায় কেঁদে উঠলো!

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন