ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(১৭)
—তুই বাড়ি যাবি না?
শ্রুতি অর্জুনের কথার কোনো জবাব দিল না। নাক টানল,
হাতের চেটো দিয়ে ঘষে চোখের জল মুছল। গালের একটা পাশ ধ্যাবড়ানো কাজলে কালো হয়ে উঠল।
অনেকক্ষণ আগে তারা টিকিট কেটে ঢুকেছে নলবনে। দিঘির পাড়ে পাশাপাশি বসে আছে সেই থেকে।
মস্ত জলার ওপারে ঘন, কালো একদলা মেঘের টুকরো আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে দিগন্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
আকাশের একপাশ দিয়ে মেঘফাটা উজ্জ্বল আলো। একটু আগে দু-এক ফোঁটা মাথায় পড়লেও বৃষ্টি
হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পাশের গাছগাছালির ছায়া পড়ছে জলার তিরতিরে ঢেউয়ে। ভারী সুন্দর
একটা সন্ধ্যে।
অর্জুন ফুরিয়ে-আসা সিগেরেটে টান দিয়ে শ্রুতির দিকে
এগিয়ে হাতটা এগিয়ে বলে,
—নেঃ দুটো টান মার - মস্ত হয়ে যাবি।
শ্রুতি অন্যদিকে তাকিয়ে অভিব্যক্তিহীনভাবে ধাক্কা
মারল অর্জুনের হাতে। সিগারেটটুকু পড়ে গেল মাটিতে। অর্জুন চটি দিয়ে পিষে দিয়ে নাক দিয়ে
ঘোঁৎ করে বিরক্তি প্রকাশ করল,
—ফা-ক্!
মুখ ঘুরিয়ে চোখে রক্ত ফুটিয়ে তাকাল শ্রুতি। রাগী
খরখরে গলায় বলল,
—চোপ।
—হোয়াটস রং বে? কী হলো তোর? সেদিন তোর মাসির বাড়িতে
যাওয়ার পর থেকে আরো ক্ষেপে আছিস মাইরি! তোর জন্যেই তো গেছিলাম ইয়ার। তুই খাওয়া বন্ধ
করে-টরে…!
—বেশ করেছিলাম। তোর গায়ে লাগল কেন?
—আমার - গায়ে - কেন! যাশ্শালা এটা একটা কোয়েশ্চেন?
—বুকে এত্তো দরদ ছিল তো নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে
পারতিস। সেই সাহস নেই!
—কী বলতাম? গার্ল ফ্রেন্ড?
—মারব মুখে এক ঝাপ্পড়। হারামি মেয়ে আবার কারো…! গা-র্ল ফ্রেণ্ড!
—আবার ওসব আলফাল বলছিস!
—না তো কী বলব? যার জন্ম বাপের বিয়ের পাঁচমাস পরে…!
কথা শেষ না করে চুপ করে যায় শ্রুতি। গরম জল চোখে
উপচে ওঠে। এই চিন্তা মাথায় এলে তার সমস্ত শরীরে জ্বালা ছড়িয়ে পড়ে। কিছুতেই মানতে
পারে না, ঝেড়ে ফেলতেও পারে না। বস্তাচাপা জমে-থাকা আগুনে মাথা উত্তপ্ত হয়ে থাকে। দিদিমার
শান্ত নরম মুখখানা যখন মনে পড়ে, আগুন গলে জল হয়ে নামে।
দিদিমাকে জিজ্ঞেস করেছিল একবার - সে তখন বারো ক্লাসের শেষে। জানতে চেয়েছিল এরকম ঘটতে দিলেন কেন উনি? গায়ত্রী অনেকক্ষণ নীরব থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে নিজের মাথাটি রেখে অদ্ভুত কোমলভাবে বলেছিলেন,
—ভুল করছিল তর বাপ-মায়ে। আমি তয় কী করতাম? তরে আইতে
দিতাম না? মাইরা ফালাইতাম?
সেদিন শ্রুতি আকুল হয়ে কেঁদেছিল। বুঝেছিল দিদিমার
যন্ত্রণা। কিন্তু কী হতো সে না জন্মালে? পৃথিবীতে তার একমাত্র নরম আশ্রয় ছিল, চলে গেল।
কত রাতে ঘুম আসে না। দিদিমার কথা মনে পড়ে বুকের ভেতর ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। দিদিমা
চলে যাওয়ার পর দিন-দিন সে ক্রমশঃ অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে নিজেও বোঝে। ক্ষ্যাপা বাঘিনীর
মতো আঁচড়াতে ইচ্ছে করে মা-কে, বাবাকে। আর প্রচণ্ড বিজাতীয় রাগ হয় হর্ষের ওপরে — ভয়ানক
হিংসে করে সে বাবুলকে। এর কোনো সংগত ব্যাখ্যা নিজের কাছেও নেই। বাবুলের সঙ্গে বছরে
একবারও দেখা হয় না। কথাপ্রসঙ্গে তার জন্মের কথা একবার বলে ফেলেছিল অর্জুনকে। তার উগ্র
প্রতিক্রিয়া দেখে অর্জুন বিস্মিত হয়েছিল। সহজভাবে হেসেই বলেছিল,
—এটা নিয়ে তুই মাথা গরম করছিস? কী ক্যালানে মেয়ে!
এটা একটা ব্যাপার? বিদেশে আকছার হচ্ছে!
উত্তর না দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করেছিল শ্রুতি। অর্জুন
তার পেইন্টিং পার্টনার - একসাথে কয়েকবার কাজ করেছে। তাছাড়া ছেলেটা খুব স্ট্রেট - চেপে,
ঘুরিয়ে কথা বলেনা। শ্রুতির চেয়ে বছরদুই ছোটো হলেও চিন্তাভাবনা বেশ স্পষ্ট। অর্জুন ঠ্যালা
মারে,
—এ্যাই চল ওঠ। রাত হয়ে যাবে তোর পৌঁছাতে। ক্যাব
নিয়ে নে।
—এই ইন্টারভিউটাতেও ধ্যারালাম। আমার জন্যে কী কোনো
দরজাই খুলবে না? আর ফ্রাস্ট্রু নিতে পারছি না।
অর্জুন এবার পাত্তা দেয় না। ক্যাব বুক করার চেষ্টা
করে। সদ্য সে একটা স্টার্ট-আপ কম্পানি থেকে অফার লেটার পেয়েছে। পে-প্যাকেট মোটা না
হলেও চলনসই। এক্সপিরিয়েন্স করে নিয়ে পরের স্টেপ বুঝে নেওয়া যাবে। বাড়ি থেকে বিশেষ
চাপ নেই। মা-বাবা-দিদি তিনজনেই চাকরি করে। সে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে মন দিয়ে জরিপ করতে
লাগল। শ্রুতির সঙ্গে তার সম্পর্কের কোনো সংজ্ঞা নেই— সহপাঠী বা সহকর্মী
পর্যন্তই। একসাথে এম-বি-এ করতে ঢুকেছিল টেকনো-গ্রুপের কলেজে, সেই থেকে পরিচয়।
রোজ অশান্তি করছে দেবিকা, প্রত্যেকদিনই। বাড়ির গলিতে ঢোকার মুখে প্রবল অনিচ্ছা তৈরি হল শ্রুতির। সারাদিন গোমড়ামুখ করে থাকতে ভালো লাগে না। হাওয়া-বাতাস নেই আলো নেই অন্ধকার বাড়িটার কোনো কোণাতে। শ্রুতি ঢোকামাত্র দেবিকা ঝাঁঝিয়ে ওঠে,
--এত রাত্রে কোত্থেকে টহল দিয়ে আসলি? আসনের কী
দরকার ছিল? যেইখানে গেছিলা থাকতে দিল না?
দেবিকা একবার শুরু করলে বলতেই থাকে। কৌশিক বাড়িতে
থাকলে দু-একটা প্রতিবাদ করে, তবে জোরালো কিছু নয়। শ্রুতি দাঁত ঘষে স্বগতোক্তি করে ঘরে
ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। অর্জুনকে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করে। দেখে, ফোন বিজি। অর্জুন
কি দিনকয়েক ধরে এড়িয়ে যাচ্ছে! শ্রুতি ফোনটা ছুঁড়ে বিছানায় রাখে। দেওয়ালে টাঙানো গায়ত্রীর
ছবির দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। এতবড় পৃথিবীটাতে একটু নরম জায়গা নেই একেবারে
তার নিজের করে? একটা পার্মানেন্ট চাকরি পেলে এবাড়ি থেকে বেরিয়ে সে নিজের মতো থাকার
বন্দোবস্ত করে নিত। বুকের মধ্যে কী যেন ফুটতে থাকে। তিরিশ বছর বয়স পর্যন্ত পুরুষের
শরীর চেনা হয়নি— ওসব নিয়ে ক্ষোভ, আক্ষেপ কিছু নেই শ্রুতির। অর্জুনকে পুরোপুরি একটা
পুরুষ বলে মনে হয় না, হয়তো অর্জুনও তাকে ততটা মেয়ে বলে ভাবে না। এই বেশ, খোলামেলা।
জামাকাপড় না ছেড়ে বিছানায় কাত হয়েছিল, খেয়াল হল
পেট কুঁইকুঁই করছে। দরজায় টোকা দিয়ে গলা নামিয়ে তার বাবা তাকে খেতে ডাকছে। মামপি মুখচোখ
মুছে সাড়া দেয়।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন