কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়

 

ম্যানারিজিম - স্বল্প সময়ের নির্ভীক ভাষ্য




 

(৬)


ম্যানারিজমের প্রকৃত পুর্নমূল্যায়ণ শুরু হয়েছিলো এল গ্রেকোর কাজের অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে। স্পেনের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ম্যানারিস্ট এল গ্রেকো জন্ম গ্রহণ করেন বাইজানটাইন শিল্পের পীঠস্থান ভেনিসে। ১৫৭০ সালে রোমে আসার আগে পর্যন্ত গ্রেকোর ছবিতে বাইজানটাইন ও গ্রীক শৈলীর প্রভাব স্পষ্ট। রোমেই প্রথম তাঁর ছবিতে পরিপ্রেক্ষিত ও শরীরী বৈচিত্র্যতা ম্যানারিজমের জন্ম দেয়। এ ছাড়া বিলীয়মান বিন্দুর ব্যবহার নতুনত্ব ও আবেগের বহুল মাত্রায় প্রকাশ সাবজেকটিভিটির তুলনায় ছবিতে কল্পনা ও সহজাত প্রবণতাকে প্রাধাণ্য দিয়েছিলো। ১৫৯৭-১৬০৭ গ্রেকোর জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সময়। গ্রেকোর শেষ জীবনের কাজে দেখা যায় ফিগারগুলো নিজেদের আলো যেন নিজেরাই বহন করছে, ফলে আলোর উৎসটি থাকতো সবসময়ই অজানা। ছবিতে এক অতিরিক্ত রহস্যময়তা যুক্ত করা সম্ভব হয়েছিলো। এই রহস্যময়তা ও কমপ্ল্যাক্সিটির জন্যই গ্রেকোর খুব কম কাজকে পরবর্তী প্রজন্ম কপি করতে আগ্রহী ছিলো। যার জন্য ত খন ক্যানভাসগুলো ছিলো অজানা, উপেক্ষিত ও লোকচক্ষু্র অন্তরালে। তাঁর বিখ্যাত কাজগুলো হলো- ‘দ্য ডমিনেশন অব দ্য ভারজিন মেরী’, দ্য অ্যাসমপসন অব দ্য ভারজিন’, দ্য অ্যাডোরেশন অব দ্য ম্যাজাই প্রভৃতিএছাড়া দাবী রাখে গ্রেকোর স্থাপত্য ও ভাষ্কর্য্য। গ্রেকোর ‘দ্য হোলি ট্রিনিটি’ সর্বাপেক্ষা আলোচিত ছবির মধ্যে একটি যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রের লম্বাটে আকৃতি ও শরীরী মোচড়গুলোর পাশাপাশি আলো ছায়ার বন্টন ও পরিসরের ভারসাম্য এনেছে বৈচিত্রতা। গ্রেকোর কাজে নিও-প্ল্যাটোনিজমের সঞ্চার ঘটে যা পরবর্তীকালে ইউরোপীয় রোমান্টিসিজমের পথকে প্রশস্ত করে। শুধু তাই নয় গ্রেকোর কাজের মধ্যে ভবিষ্যতের দুই অন্যতম শিল্প শৈলীর বীজ লুকিয়ে ছিলো-এক্সপ্রেসেনিজম ও কিউবিজম। গ্রেকোর জীবন ও ছবি তাই নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলো রিলকে ও কান্দানস্কিকে যার প্রকাশ তাঁদের কবিতার নতুন প্রয়োগরীতি। আসলে ম্যানারিজম  ব্রীজের মতো দুটো যুগের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। সামাজিক একাধিক পটপরিবর্তন আঘাত আনে বিশ্বাসের গোড়ায়, রাজকীয় আভিজাত্য থেকে উচ্চকিত আবেগের প্রকাশের মধ্য দিয়ে অসংগতি ও বিভ্রমের পরিসর কল্পনা ও হৃদয়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করে। মায়া বিভ্রম এরপর থেকে অবজেকটিভিটিকে নতুন ভাবনায় খুঁজতে সাহায্য করে। যুক্ত হয় নাটকীয়তা, সময়ের মোচড়, ঘাত প্রতিঘাত রিদ্ধ করে শক্তির বহুমুখী সঞ্চরণ যাকে ভর করে নির্মাণশৈলী পাড়ি দিয়েছে গঠনাত্মক উদ্ভাসনের দিকে। যেখানে আপাত মায়াটান কিন্তু বেখেয়ালী, উচ্চকিত, বিদ্রুপাত্মক, ধ্বংসপন্থী, অতিরঞ্জিত, অভিব্যক্তিপ্রাচুর্য হওয়ার পাশাপাশি স্বীকৃতি দিয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতাকে নতুনত্বকে মননের বেহিসাবী আনন্দঘন স্বতস্ফূর্ততাকে। ফলে ম্যানারিজম লাভ করেছে এক আদ্যপ্রান্ত স্টাইল বা অনুভব উন্মোচনের ছন্দময় সুষমার আবহ।

ম্যানারিস্টদের প্রকাশ ও ট্রিটমেন্ট যে উৎকর্ষতায় পৌঁছায় সেখানে নিজেদের কাজের উল্লেখযোগ্য ছাপ রাখেন করেওজ্জিও (১৪৮৯-১৫৩৪) রস্সো ফিও রেনতিনো (১৪৯৪-১৫৪০), গিওরজিও ভাসারি (১৫১১-৭৪) ভাসারি নিজে একজন বিখ্যাত ও প্রতিভাবান শিল্পী হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন চিত্রসমালোচক। ম্যানারিজম ও উচ্চ রেনেসাঁর পরিবর্তন ও বৈশিষ্ট্যর শৈল্পিক ব্যাখ্যা তাঁর লেখার মাধ্যমে জানতে পারি। সমকালকে ধরে রাখতে ভাসারির বইয়ের অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়াও জ্যাকোপো বাস্সান্নো, পাওলো ভারোনেসি ছিলেন অন্য ধারার। তাঁরা ম্যানারিস্ট শৈলীর প্রয়োগে স্টিললাইফ ছবিতে নতুন বৈচিত্রতা ও বাগ্ময় আবহ তৈরী করে সৌন্দর্য্যের প্রসঙ্গে বস্তুগত জগতকে অভিনব গাঢ়তা ও গমক প্রদান করেন। মেডেসি রাজবংশের অবস্থানকালেও অবদান রেখে গিয়েছেন আন্দ্রিয়া দেন্সারতো, জ্যাকোপো পনর্টোমো, নর্দ্যান ম্যানারিস্টদের মধ্যে গল্টিনস ও ইয়েটেওয়াল, স্পেরনজেস প্রমুখ। পেন্টারদের পাশাপাশি স্থাপত্য ও ভাষ্কর্য্য  অবদান উল্লেখযোগ্য। স্থপতিদের মধ্যে গিয়াম্বোলোগনা, বেনভেনিউটো, জারম্যাইন, অ্যালেন্সি বিখ্যাত। ভাষ্কর্য্য ও স্থাপত্যেও ম্যানারিজমের সকল বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্টভাবে  ধরা পড়ে। গতানুগতিকতার বিপরীতে মনস্তাত্ত্বিক সঞ্চার, দ্বন্দ্ব প্রকাশ, বাস্তবতার থেকে শিল্পশৈলীকে নিয়ে যায় চূড়ান্ত মানবীয় প্রবণতাগুলোকে উন্মোচনের পথে।


পোস্ট ম্যানারিজম

প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে এসে যায় ম্যানারিজমের বিংশ শতকের দোড়গোড়ায় নতুনভাবে পর্যালচিত হওয়ার বিষয়টি। এল গ্রেকোর কাজের ওপর বিংশ শতাব্দীর সমালোচকেরা গুরুত্ব আরোপ করতে শুরু করলে ম্যানারিজমের বিভ্রান্তিগুলোর ধোঁয়াশা কাটিয়ে সম্ভাবনাময় ইঙ্গিতগুলো আস্তে আস্তে সামনে উঠে আসতে শুরু করে এবং স্পষ্ট হতে থাকে যুগ পরিবর্তনের বাগ্ময়তা নিউইয়র্কের জিউস মিউজিয়ামের সংগ্রাহক নরম্যান ক্লিব্লার্ট মন্তব্য করেন যে পঞ্চদশ শতকে ঘটে যাওয়া ম্যানারিজম ছবিতে যে ইমোশনালিজমের সূচণা করে তার ইতিবাচক প্রভাব পরবর্তীকালে শিল্পভাবনাকে প্রভাবিত করেছিলো এবং কন্টেম্পোরারি আর্টের ক্ষেত্রেও গভীর মনোভাব এখনো বর্তমান। একথার সত্যতা আরো বেশী করে প্রমাণিত হয় যখন ১৯৮০-তে মাইকি কেলীই ম্যানারিজমের এক অন্যদিক সামনে নিয়ে আসেন ছবির ইতিহাসে। পপ আর্ট আঙ্গিকের দিক হতে অভিনবত্বের সঞ্চার করেছে বিংশ শতকে, ম্যানারিজম পপ আর্ট ধারার সঙ্গে মিলিত হয়ে এক নতুন ঘরাণা সৃষ্টির পাশাপাশি একে উৎকর্ষতাও প্রদান করেছে। ফলে সৃষ্টি হয় পোস্ট পপ ম্যানারিজমের যাত্রা, যার অন্যতম পথিকৃত হলেন পিরিনিন ও পোষ্টমর্ডান ম্যানারিস্টদের মধ্যে কিকি স্মিথ। কিম সিমোনসন আবার ভাষ্কর্য্যের মধ্য দিয়ে ম্যানারিজমকে দেখলেন একটু অন্যভাবে ফলে একে অভিহিত করা হলো- “Peculiar delights of mannerist art” বলে।

পোস্ট ম্যানারিজমের বৈশিষ্ট্য হলো ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যতীত এমন এক জগতের সৃষ্টি যেখানে করুণ রসের সঞ্চার ঘটেছে বেশী। কি অদ্ভুতভাবে হাস্যরসাত্মক, ব্যাঙ্গাত্মক রসের সঞ্চারকারী ক্যানভাসগুলো সময়ের অভিঘাতে পরিনত হয়েছে করুণ রসে। ফলে ছবিতে একই সঙ্গে করুণ ও সৌন্দর্য্যের দ্বন্দ্ব ঘনীভূত হয়েছে। অস্থির চিত্তের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে সেন্টিমেন্টাল, নস্টালজিক এক আদ্যপ্রান্ত মননশীল জগতের স্টাইলিশ বিভ্রান্তি।

ম্যনারিজমের প্রভাব যে শুধু বিংশ শতাব্দী থেকেই নতুনভাবে উঠে আসে তা কিন্তু নয়, উনবিংশ শতাব্দীতেও নানান স মালোচকদের আলোচনায় ম্যানারিস্টরা সমালোচিত। ফরাসী লেখক গ্যাটোর লেখায় এল গ্রেকোর কাজের যে রোমান্টিক মুভমেন্টের উপাদানগুলো ছিলো তা আলোচিত হয়েছে। অন্যদিকে গ্রেকোর কাজের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন পাবলো পিকাসো। পিকাসোর ১৯০৭ সালে আঁকা বিখ্যাত ছবি ‘ লেস ডিময়স্যালেস ডি অ্যাভিগন’-এ এল গ্রেকোর ১৬০৮-১৪ সালের মধ্যে আঁকা ‘দ্য ওপেনিং অব দ্য ফিফথ সীল’ ছবির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।



ম্যানারিস্টদের উজ্জ্বল রঙের প্রয়োগ পরবর্তীতে মোনেটকেও প্রভাবিত করেছিলো এবং গঠনগত দিক থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পল সেজান। ব্লু পিরিয়ডে পিকাসোর ম্যানারিজমের প্রতি অনুরাগ সর্বজনবিদিত। কিউবিজমের সূত্রপাতও কিন্তু ক্ল্যাসিকাল ম্যানারিজমের সময়েই।

ম্যানারিজম এক্সপ্রেসনিজমকেও নতুন পথের সন্ধান দিতে পেরেছিলো। যা বিমূর্ত ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে সুরিয়ালিজমের দিকে। এক্সপ্রেসনিস্ট জ্যাকসন পোলকও একে ব্যবহার করেছেন ভাবনায়। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ফ্রিড ল্যান্ডারের রচনায় ম্যানারিজমকে ‘tedious and unbearable’ বলে উল্লেখ করলেও ফ্রয়েডের তত্ত্বের পরবর্তীতে আধুনিক বিশ্বে ম্যানারিজম মনস্তত্বের লুকোনো অবয়বগুলোকে অতল থেকে তুলে আ নতে শুরু করে। ম্যানারিজমের তৎকালীন বাস্তবতা বিরোধী আঙ্গিকগুলো মনের গভীরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আশঙ্খা, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তারই যে প্রকাশ তা বিজ্ঞানী ও চিত্র সমালোচকদের কাছে পরিষ্কার। জেমস মিরোল্লো এই পরিবর্তিত ম্যানারিজমকে ‘Angst Mannerism’ বলে চিহ্নিত করেন। এইভাবে ম্যানারিজম মনের একান্ত আশা আকাঙ্খার প্রকাশের মধ্য দিয়ে একটা সময় পর মিশে যেতে শুরু করে নার্সিসিজমের সঙ্গে, ফলে শিল্পের ভাষা দাবী করে তখন থেকে বীরোচিত দক্ষতা অথবা বৈপ্লবিক চিন্তাশৈলীর শক্তিশালী দাপুটে মেজাজ.

ইতিহাস তার আপন খেয়ালে বয়ে চলে। এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনার সৃষ্টি, এক ভাবনাকে অস্বীকার করে অপর ভাবনায় সঞ্চার, গুহাচিত্র থেকে রেনেসাঁ হয়ে আধুনিক তথা উত্তর আধুনিক শৈলী অগনিত টানাপোড়েন ও ভাঙ্গাগড়ার সাক্ষ্য বহন করে। ম্যানারিজমও ঠিক এই রকমই এক অধ্যায় যার শৈলী নিজের প্রাণের কথা বলে গিয়েছে অনেক গভীর যন্ত্রণাবোধে মথিত হয়ে, অপরিসীম রস বোধের আবেশে। আবেগ তাড়িত এই অধ্যায় তাই নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছে মস্তিষ্কের ধূসর জগত উন্মুক্ত করে মুক্তি খুঁজে নিতে পারদর্শী। আধুনিক শিল্প ও তার শৈলী তাই ম্যানারিজমের সময় কালকে সংরক্ষিত করে রাখবে আগামীতেও তার প্রভাবশালী মায়াবিভ্রমের স্বীকৃতিরূপে।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন