কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস 


একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


 

(৮)

 

একটা বহুতল বাড়ি। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে সাততলায় পৌঁছল সে। এখানে প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততা। সে আশা করেছিল, অন্তত আগ্নেয়র বন্ধুটি থাকবে। কিন্তু সে-ও ছিল না সেখানে। কারও যেন কোনও দায়িত্ব নেই। সবাই হাত ধুয়ে ফেলেছে। আর সে একটা গোলকধাঁধার মধ্যে এসে পড়েছে। এখানে সে কাউকে চেনে না। তাকেও কারও চেনার দায় নেই। সবাই ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। একটার পর একটা ছায়া, ছায়া, অন্ধকারময় গুদামঘর। সেখানে ভারি ভারি মাল নিয়ে কারবার। লোকে সেইসব মাল মাথায়, ঘাড়ে, কাঁধে, হাতে নিয়ে  দৌড়াদৌড়ি করছে। হৃদয় বারবার সেই প্রকাশক বন্ধুটিকে ফোন করে অনেক চেষ্টায় তবে শেষপর্যন্ত নিজের গন্তব্যে পৌঁছতে পারল।

ওর বইগুলো স্যাঁতস্যাতে দেওয়ালের গায়ে ডাঁই হয়ে পড়েছিল। প্রায় দুশো বই। দেখতেও অতি মামুলি। বোঝাই যায়, বইয়ের ব্যাপারে কেউ কোনও মনোযোগ দেয় নি। অত্যন্ত  দায়সারাভাবে করা। তাছাড়া একার পক্ষে দুশো বই বহন করে সাততলা ভেঙে নিচে নেমে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি পৌঁছনো খুবই পরিশ্রমসাধ্য কাজ। কিন্তু উপায় নেই। সঙ্গেও কেউ নেই। বইগুলোকে বেঁধে দু-হাতে দুটো বাণ্ডিল নিয়ে ময়লা অন্ধকারময় সিঁড়ি দিয়ে একটার পর একটা ধাপ পেরিয়ে নামতে শুরু করল হৃদয়। হাত দুটো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যে কোনও মুহূর্তে বইয়ের বাণ্ডিল দুটো হাত থেকে খসে পড়বে। অথবা ঐ বাণ্ডিল দুটোর সঙ্গে হাত দুটোই খসে পড়বে। হৃদয়ের চোখের সামনে সিঁড়ির ধাপে গড়াতে থাকবে ওরা। আর তারপর হারিয়ে যাবে নিচের অন্ধকারে। শুধু যন্ত্রণা, তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা ছাড়া নিজের প্রথম বই বেরোনোর মুহূর্তে আর কিছুই অনুভব করছিল না হৃদয়।

ট্যাক্সিতে উঠে শারীরিক কষ্টটা কমল। কিন্তু প্রবল একটা একাকিত্ব টের পেল হৃদয়। যে দুজনের ওপরে ও সবচেয়ে বেশি নির্ভর করেছিল, তারা কেউ ঠিক বই বেরোনোর মুহূর্তে ওর পাশে নেই। ওকে ওর বইয়ের সঙ্গে একা ছেড়ে দিয়েছে। আর নিজেরা নিঃশব্দে সরে পড়েছে। এমনকি বইটির ব্যাপারে কোনও যত্নই ওরা নেয় নি। নিতান্ত হেলাফেলা করে বইটি করা হয়েছে। যদিও বইটির শুরুতে হৃদয় নিজের অনুপ্রেরণা হিসাবে আগ্নেয়র একটি কার্টুনকে ব্যবহার করেছে। এইভাবেই আগ্নেয়র ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে সে।

কিন্তু আগ্নেয় তার বদলে কী দিল তাকে? একাকিত্ব! নিজের কাছে নিজেই স্বীকারোক্তি করার মতো করে উচ্চারণ করে হৃদয়। কিন্তু শুধু একাকিত্ব নয়। ও যেন ঠকে গেছে। তাই একটা গ্লানি হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। সেটাই ওর অস্বস্তির কারণ। কেবলই মনে হচ্ছে আগ্নেয় ওর ওই প্রকাশক বন্ধুর সঙ্গে যোগসাজশ করে ওকে ঠকিয়েছে। আগ্নেয়র কার্টুন নিয়ে ওর মনে উৎসাহের কোনও সীমা ছিল না। কতভাবেই না আগ্নেয়র কার্টুনগুলো ও বাঁচাতে চেয়েছে! আগ্নেয় এভাবে ওকে না ঠকালেই পারত। কিন্তু সত্যিই কী আগ্নেয় ওকে ঠকিয়েছে? হৃদয় উত্তর খুঁজতে থাকে। আর ঠিক তখনই একটা তীব্র একাকিত্ববোধ যেন কামড়ে ধরে তাকে। তার মনের মধ্যে বিষাদ বাড়তেই থাকে।

বন্ধুদের প্রায়ই নিজের বাড়িতে ডেকে এনে খাওয়াতো হৃদয়। সমিধা ওদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ওদের বাড়িতেও মাঝেমধ্যেই খাওয়াদাওয়া শুরু হল। মেহুলী সমিধাকে নিয়ে  এসেছিল। সমিধা অতি ধনী পরিবারের মেয়ে। মনের দিক থেকেও খুব স্বাধীনচেতা। বন্ধুদের নিয়ে হৈচৈ করতে ভালোবাসে। আসলে সকলেই ওর অর্থ আর উদারতার সুযোগ নিত। ঠিক যেমন সুযোগ নিত হৃদয়ের কাছ থেকে। সুযোগ নিত ঠিকই, কিন্তু তারপরেই ভুলে যেত। কারও মধ্যে কোনও কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল না। একমাত্র হৃদয়, সমিধার এই  উদারতার জন্য, মনে মনে তার প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞবোধ করত। আর হয়ত করত বিশ্রুত। ওরা দুজনেই সমিধাকে আগলে রাখত, উৎসাহ আর প্রশ্রয় দিত। বিশেষ করে হৃদয় সমিধার কাছে প্রেরণা হয়েই উঠেছিল।

এই প্রেরণা থেকে একদিন জন্ম নিল প্রেম। হৃদয় তার কিছুই জানত না। যখন জানল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সমিধা যে ওদের বাড়িতে ডেকে ডেকে বন্ধুদের খাওয়াত, তার পিছনে গভীর কারণ ছিল। প্রথমে মনে হয়েছিল, নিছক ফুর্তি আর মজা করতেই চায় সে। পরে হৃদয় ভেবেছিল, প্রেরণার তাগিদেই সে ওসবের আয়োজন করে। কিন্তু আসল কারণটা জানা গেল পরে। সমিধা হৃদয়ের প্রেমে পড়েছে। এইজন্যেই সে খাওয়াবে বলে  বন্ধুদের বারবার নিজের বাড়িতে ডেকে আনে। নিজের করে হৃদয়কে পেতে চায়। দূর থেকে শুধু হৃদয়কেই লক্ষ করে যায়। তার প্রতিটি শব্দ, আচরণ, ভঙ্গী, নীরবতা নিজের মনে গেঁথে নেয়। হৃদয় একদিন তার প্রিয় দুই বন্ধুকে ডাকল। বিশ্রুত আর আগ্নেয়। তারপর বলল। তোদের একটা কথা বলতে চাই...

ওরা দুজনে চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল। হৃদয় বলল, সমিধা আমাকে ভালোবাসে...

দুজনেই চমকে উঠল। বিশ্রুত জানতে চাইল, তুই এখন কী করবি?

আমি ওকে ভালোবাসি না। কিন্ত ওর মনে আঘাত দিতেও চাই না। ও আমার খুব ভালো বন্ধু। আমার মতে...

দুজনেই অপেক্ষা করতে লাগল। হৃদয় বলল, ওকে যদি এখনই না বলে দিই, ও মনে খুব আঘাত পাবে। ওকে একটু একটু করে বুঝিয়ে দিলেই চলবে। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোরা ওকে এখন কিছু বলিস না। আমরা চুপচাপ থাকি। ওর বন্ধুত্বটা আমাদের সকলেরই ভীষণ প্রয়োজন...

আগ্নেয় হঠাৎ জানতে চাইল, কিন্তু কেন তুই চাস না?

হৃদয় হাসতে হাসতে বলল, ও ঠিক আমার মনের মতো নয়। ওর হৃদয়টা খুব বড়ো। কিন্তু মাথাটা ঠিক পরিষ্কার নয়। ধার নেই ওতে। তারপর বলল, যে মেয়ের ঠোঁট দেখে আমার চুমু খেতে ইচ্ছে করে না, তার সঙ্গে সারাজীবন থাকব কী করে?

অকপটে নিজের মনের ভাব জানিয়েছিল হৃদয়। হয়তো কিছুটা ঠাট্টা মিশিয়ে। কিন্তু ঠাট্টাটাই বড়ো হয়ে উঠল। অকপটতাকে চেপে দেওয়া হল। এইভাবে ব্যাপারটা পরদিনই পৌঁছল সমিধার কানে। কথাটা সমিধাই ফোন করে হৃদয়কে জানাল। খুব শান্তভাবেই সে ব্যাপারটাকে মেনে নিয়েছে। সমিধা বলল, তোর মনের কথাটা জানতে পারলাম...

হৃদয় বুঝতে পারল, ওর দুই বন্ধুর মধ্যে কেউ একজন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেটাও সে অনুমান করে নিল। তবু জানতে চাইল, কে বলেছে তোকে? 

সেটা তোকে বলব না।

কেন? হৃদয় জানতে চাইল।

সে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী।

হৃদয় আর কিছু জানতে চাইল না। যে ওর কাছে বিশ্বাসঘাতক, সমিধার সে শুভাকাঙ্ক্ষী?  অথচ ওরা সবাই বন্ধু। ফুলের সমঝদার। জীবন একটা ধাঁধা।

 

(ক্রমশঃ)

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন