কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

পায়েল চ্যাটার্জি

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৮



অ-সুখ


লরি থেকে ঝপাং করে লাফ দিলে অভ্যুদ্যয়। ধাপার মাঠ। নিজের শরীরটা খুঁজতে হবে। 'আছে' থেকে 'নেই'। দু'দিনের মধ্যে। ওর শরীরটাকে যখন কোনোমতে অচ্ছ্যূতের মত গাদাগাদি করে লরিতে তোলা হলো, হাওয়ায় ভাসছিলো অভ্যুদ্যয়। প্রথমে বুঝতেই পারেনি যে মরে গেছে ও। 8 নম্বর বেডের রোগীটার অক্সিজেন লেভেল চেক করার উদ্দেশে পা বাড়াতেই দুম করে একটা ধাক্কা খেলো লেট ডক্টর অভ্যুদ্যয় মিত্র। ওর বডি তখন স্ট্রেচারে চেপে লরির দিকে যাচ্ছে। 'পূর্ণা হাসপাতাল'-এর কোভিড ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র ডাক্তার। আপাতত কোভিড-যোদ্ধা থেকে শহীদ। যুদ্ধে এমন 'টুকটাক' আত্মত্যাগ চলে। গত দেড় বছরে প্রায় দেড় হাজার ডাক্তার। কোভিড-যুদ্ধের অলিখিত 'কোল্যাটারাল ড্যামেজ'।

নিজের কোভিড আক্রান্ত হওয়ার দিনলিপি মনে আছে অভ্যুদ্যয়ের। টানা ৪৮ ঘণ্টা। কোভিড 'ডিউটি'। ইউরিন ইনফেকশন, জ্বর। সঙ্গে কোভিড পজিটিভ। প্রাণবায়ু বিপদসীমায়। অবশেষে প্রাণপাখি উড়ে গেল। ডাক্তার অভ্যুদ্যয় মিত্র এখন 'বডি'। লরিতে লাশের ভীড়। মা আর অনন্যার সঙ্গে দেখা হলো না। গত দেড় বছরেও দেখা হতো কি? বাড়ির দরজার বাইরে হাওয়ার মতো ভেসে এলো কোভিড-শহীদ ডাক্তারের আত্মা। মা ঘুমোচ্ছে। অনন্যা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। চোখে কিছু হারাবার যন্ত্রণা আছে? জোর করে খুঁজছে অভ্যুদ্যয়! অনন্যার বলা-না-বলা কথাগুলো ভাসছে চারিদিকে।

-'তোর আমার সম্পর্কটাতে একটা বড়োসড়ো হাইফেন, নাম-কোভিড।

-আসলে আমার কাজ...

-কোভিড পর্বের পর কেউ মনে রাখবে তোকে?

যুতসই উত্তর খুঁজে পায়নি সেদিন অভ্যুদ্যয়। অনন্যার চায়ের কাপ দেখা যাচ্ছে। দেড় বছরে অভ্যুদয়ের কাপ পাশে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। ৭২ ঘন্টা টানা 'ডিউটি'। লাঞ্চ, ডিনার, চা। সব একা। একা এবং একা। অবসন্ন শরীর ও মন। বাড়ি ফেরা মানে কিছু শব্দের আনাগোনা। পাতা ওল্টানো, চায়ের কাপের, ঘর পরিষ্কারের। এখন সব শূন্য। বাড়ি, সম্পর্ক। কতদিন ধরে? আর হিসেব হয় না। এখন সব হিসেবের বাইরে লেট ডাক্তার অভ্যুদয় মিত্র। ফিরে যাচ্ছে ও। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতেই গাড়িতে উঠলো। অবশেষে ধাপার মাঠে নামলো। মৃতদেহের ভিড়। নিজের শরীরটা খুঁজে পেল। বেশ হালকা লাগছে ওর। আত্মত্যাগ করলে আত্মা কি তবে সহজেই ভারহীন হয়ে যায়? কিসের যেন ধুকপুক আওয়াজ! ওর হৃদস্পন্দন কি থামেনি? স্টেথোস্কোপটা কই? থাকলে মেপে নিত! বাকি যন্ত্রপাতিগুলো? মৃতদেহের অক্সিজেন লেভেল তো আর...! অভ্যুদ্যয় কি মৃতদেহ? নাকি পেশাকে অন্তর দিয়ে ভালবাসলে মৃত্যুর পরেও এমন স্পন্দন অনুভব করা যায়! তবুও একবার যদি হাসপাতাল যাওয়া যেত! ডাক্তার অভ্যুদ্যয় মৃতদেহ ছেড়ে এগিয়ে চলল।


2 কমেন্টস্: