কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

০২) রমিত দে

নিঃশব্দ নবীনে রয়েছে জেগে



“The Correct method of Philosophy would
Really be following: to say NOTHING”…      হিটগেনস্টাইন…


‘পূরবী’র কবিতাপর্বে রবীন্দ্রনাথের ডুডলস বা পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটিকে অনেকেই তাঁর নিজস্ব চিত্রভাষা খুঁজে পাওয়ার বা বইয়ের ঘর থেকে ছবির দরবারে পৌঁছে যাওয়ার প্রস্তুতি বলে অভিহিত করেন; সেক্ষেত্রে সান ইদ্রিসোর পরবাসে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মতো অনুগামিনী কেবল অনুঘটকের কাজ করেছিল একজন কবির শব্দতারিক্ত অনুকৃতির আধারটাকে চিনে নেওয়ার আর পুঁথিসাহিত্যের ফাঁকে ফাঁকে সেই দ্বিতীয় বিন্যাস, কথকের সেই picture poesis,
শব্দ থেকে ডিস্টরটেড আঁকিবুকি আবোল তাবোলই হয়ে উঠেছিল কবির ব্যক্তিগত ধ্যানের জগত, স্পেসের জগত, না ছুঁতে পারা এক বাড়তি দূরত্বের জগত। সে যেন এক না শব্দের জগত যে অবধি গিয়েও শব্দ তাকে বারবার সত্যাশ্রিত ঋতের ছন্দে ফিরিয়ে এনেছে আর সসীম শব্দ থেকে অসীম নির্মাণে যাওয়ার ছোট্ট একটা স্পেস বারবার ভীড়ের পথের মাঝে ভরাট শূন্যতা চেনাতে, শব্দের সাদা চেনাতে সেজেগুজে বসে আছে। হ্যাঁ, এ যেন শব্দের চামড়ার ওপর মহাযাত্রিকের আয়না বসানো একটা শূন্যবাদী নৈঃশব্দের জগত। শব্দের সীমাকে বিদীর্ণ করে শূন্যতা লিখে রাখার জন্য যেন এভাবেই রেখার সূক্ষ্মতা থেকে গড়িয়ে নামে স্রষ্টার ছবির গল্প বা গল্পের ছবি। তবে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর ললিতকলা এসব কিছুই এ পরিসরে আলোচ্য নয়, বরং স্পষ্টভাবে প্রবহমান উচ্চারণের বাইরে আবহমান অনুচ্চারণের প্রজনন গ্রন্থিটুকু খোঁজা, নির্লিপ্ত নিরপেক্ষ কিছুটা অতিরিক্ত খোঁজা, যেখানে দাঁড়িয়ে দ্রষ্টা যোজন যোজন অন্ধকার খোঁজেন, খোঁজেন নিঝুম অবধি পৌঁছে যাওয়ার ব্রহ্মগ্রন্থি। এখন প্রশ্ন, কবিকে কি ছবিতে পায়? আক্রান্ত হয় সরবতাকে নিশ্চুপ করার চক্রান্তে? নাকি একজন চিত্রকরের ন্যাচারাল সাইনেও লেগে থাকে শব্দের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়! সে শব্দের ইন্দ্রিয়জ উৎসব নেই, কিন্তু অপ্রাকৃত অবয়বেও সে যেন হাবুডুবু খাচ্ছে, চাইছে চৈতন্যকে গ্রাস করতে। যে শব্দ কোনো ভাষাকে চিহ্নিত করে না বরং ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় শব্দের আলোর শরীর, আর অন্ধকার ঘরে উঠে বসে নৈঃশব্দের প্রাণ ও প্রজ্ঞা। খুঁজে বের করে নিজেকে প্রশ্ন করার সেই জ্যামিতিক প্যার্টানটা, সেই ট্রান্সডেন্টাল পিপাসাটা, যেখানে কবি বা চিত্রকর সীমাবদ্ধতার বাইরে স্বস্তির নিঃশ্বাসের বাইরে কুড়িয়ে রাখছেন এক চিরস্থায়ী দূরত্ব, অদল বদলগুলোর মাঝে স্রষ্টা সেখানে এক অদ্ভুত আস্তাবল খুলে বসেছে অস্তিত্ব ও শূন্যতা বিষয়ক চোরাবালিগুলোকে বুঝে নিতে; সেখানে কবি ও শিল্পীর মাঝে লেগে আছে এক চিরন্তন মাইমেসিস, অনুধ্যানের কিছু লেট ডায়লগ; ইমপারশোনেট হতে হতে প্রতীকের বেড়াজাল পেরিয়ে অর্থের আন্দোলন পেরিয়ে রিলিজ অফ সোলে একীভূত হওয়া; ফর্ম নয় শিরোনাম নয়, কেবল প্রণালীর সৃজন, যা চিহ্ন ও চিত্রনের মগ্নচেতনা জারিত, যা কবিও পুঁতে চলেছেন তাঁর রঙহীন সাদা মাটিতে, আবার ছবিকারও অথবা ভাস্কর তাঁর বিরেখীয় টেক্সচারে লিপি থেকে তুলে আনতে চাইছেন শব্দের আর্বিটারি মোটিভসগুলো, অতলান্তের উঁচু নিচু জমিগুলো, যেখানে শব্দ ও দৃশ্যের মাঝে শিল্পের নিঃশব্দ তর্জনী উদ্ভাসিত হচ্ছে যোগাযোগ ছাড়াই।

একদিকে বোদল্যেয়ারের les phares কবিতা যেখানে দেলেক্রোয়া, লিওনার্দোর ছবির আলো নিয়েই নিভিয়ে দিচ্ছে শব্দের মধ্যেকার সবকটা অন্ধকার, তেমনি তুষার চৌধুরীর ‘গগ্যাঁর হলুদ যীশু’ও তো দালি, মাতিস বা গগ্যাঁর নির্বস্তুক জগতেরই ডেসক্রিপটিভ ভিস্যুয়াল; যেন ভাষা থেকে তার সেন্সেটিভ ইনস্ট্রুমেন্টকে গূঢ়সত্ত্বাকে চিহ্নিত করে একজন চিত্ররসিকের প্যারাফিনে তুলে দেওয়া, ইমোশনকে উস্কিত করে দেওয়া মোশনের আঙ্গিকে; আসলে কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে দৃশ্যের সেই বধির অথচ অনবহিত চলা, ঠিক যেমন তেলরং-এর পরতে পরতে তন্ত্রের মতো লেগে রয়েছে বর্ণের অ্যানাটমি; ম্যাথু কোয়ান যাকে বলছেন -“painting is dumb poesy, and a poesy is a speaking painting; and the actions which the painters set out with visible colours and figures the poets reckon with words, as though they had indeed been performed”. যুক্তিগ্রাহ্য পারস্পর্যের মাঝে চলা আসলে একটা চালু আত্মা, যে কিনা গোপনচারী কবি বা শিল্পীকে রাতের জার্গন শোনাতে নিয়ে চলে পোশাকের বিরুদ্ধে পরিচর্চার বিরুদ্ধে। ভাস্কর আর মূর্তির মাঝে, কবি আর কবিতার মাঝে উঠে বসে এক স্বতঃস্ফূর্ত দূরত্ব, এক বিরাজিত সুপ্ত আর সেখানেই শিল্পী আর শিল্পের মাঝে শুরু হয় প্রাণ নয়, প্রজ্ঞানের সাধনা। মাত্রাস্পর্শের বিপরীতে দূরত্বের সংজ্ঞা তৈরি করা। ওই দূরত্বই তো অনন্য দৃষ্টি আর দৃষ্টির নাড়ীপথ ধরে দর্শনের হেঁটে যাওয়া। এক অনন্ত সম্ভাবনার দিকে হাহাকার করে ওঠে শিল্পী; সঙ্গের প্রকৃত সংজ্ঞা খুঁজতে প্রতিটি পদক্ষেপে বেজে ওঠে নৈঃসঙ্গের স্বচ্ছ উচ্চারণ। শিল্পী ও তাঁর শূন্যতার সাধনাদর্শনে যখন আলোক সরকার লেখেন --

“চলেছি যে
এটাই কোনোদিন টের পাইনি
আজ চলার কথা
সব কটা উঁচুনিচুই বলে।
………
আর সেই যাওয়া
তা আলো জ্বালায়নি,
আলো নিভিয়েও দেয়নি।
আলো জ্বালা না জ্বালার ভিতর
যে ছবি হয়
তা দৃশ্য নয়, রেখা-রং নয়।… (আলোক সরকার)

তখন আসলে তাঁর প্রতিটি পংক্তিকে ছেড়ে রাখেন এক দ্বিতীয় অতিরিক্তের দিকে, জীবন ও জগতের মাঝে বঁড়শি দিয়ে তুলে নেওয়া সেই ঊর্মিহীন বিমূর্ত সংবেদের মাঝে; লাইফ থ্রু এ লেন্সে দাঁড়িয়ে কবি যখন চলা শব্দটি উচ্চারণ করেন অথচ টের পান না কোনো প্রোথিত পদক্ষেপ, টের পান না পায়ের নিঃশ্বাসকুচি, তখন আসলে কবি তৈরি করেন এক চুম্বকীয় শূন্যতা, এক বিপজ্জনক স্পেস, যে স্পেস অস্তিত্বের কেন্দ্র থেকে অপরিজ্ঞাতের দিকে চলেছে। অবয়বহীন এক জগতের দিকে চলেছে। আর সেখানেই কি কবি খুঁজে পেলেন তাঁর চিত্রভাষা! লিপি থেকে লিপিকা! মাটি মুছে মুছে দীর্ঘ অঙ্গের সূক্ষ্মতা! কবিতার কারুঘরের প্রথম দরজা খুলে অন্তর্জীবনের পিছল রাস্তাগুলোর ঠিকানা খোঁজে এক ইর্টারনাল ভাইব্রেশন। কবি এখানে একে একে এঁকে চলেছেন ভার্বাল পিকচার, আঠাকাঁচি নিয়ে বসেছেন ভিভিড ওর্য়াড ইলাস্ট্রেশনের ফ্যাকসিমিলি খুঁজতে; স্তুপাকার শব্দের ভরা সংসার থেকে দৃশ্যমান জগতে নেমে পড়ছেন কবি আবার; আসলে সেই স্পেস সেই একটা সাদা ফাঁকা জায়গা যার দিকে ছিটকে যাওয়া যায়, যার দিকে ছিটকে যাওয়া যাচ্ছে না, আর অথৈ থেকে টইটম্বুর থেকে উদোমের দিকে সিগনিফাইং নাথিং-এর দিকে এক স্বয়ং বধিরের দিকে বেড়াতে চলেছেন কবি। পুঁথিসাহিত্যের তরজমাকে অস্বীকার করে তিনি এগিয়ে চলেছেন লিংগুইস্টিক আইসোলশনের দিকে; ঠিক এখান থেকেই শব্দ প্রতিনিধি হয়ে উঠছে সেন্সেশনের, ফ্রি ভার্সের; কাব্যিক ঘোষণাকে মুক্ত করে আলস্য ভেঙে দিয়ে কবি চলেছেন এক সচকিত দৃশ্যের সন্ধ্যামালতী খুঁজতে; কুড়িয়ে নিয়ে চলেছেন শব্দের মাঝের ক্যামোফ্লেজিং শ্বাসটাকে। মঞ্চমায়ায় অনেক দূরের এক জগত এঁকে দিলেন কবি; কেবল দৃশ্য নয়, দৃশ্য মধ্যবর্তী অদৃশ্যকেও মুক্ত করে গেলেন দৃশ্যের আপাত অমরতা থেকে; একে কি অনুকৃতির শিল্প বলা যেতে পারে বা প্রতিকৃতির ভাষা? তো এমনই শব্দের পরের শব্দ, শব্দের পরের নৈঃশব্দ পরখ হয়ে গেলে, দ্রষ্টার কাছে চলা বলতে কেবল কিছু বর্ণে বোঝাই বাসনা থাকে না, বোধিও উঠে আসে; ভাষার হিমানী মার্জিনে রিফু হয়ে যায় কাব্যিক চিত্রলিপিও; দ্রষ্টার হাতে দৃশ্য থেকে দৃশ্যাতীত এই সেই ম্যাক্রোকসমিক পিপাসা, সেই উজ্জ্বল শব্দ যাকে তুমি না-শব্দ বলছ, যার দিকে তৃষ্ণা ছুঁড়ে দিচ্ছি আমি আর তাই যেন কবিতার ছাইগাদায় জন্মেও অস্থিত মীমাংসাহীন এক সত্যের রেখা ও রঙের গজমোতিমালা বুনে চলেছে। চাক্ষুষ চেতনা পেরিয়ে এই পরমোহৎসবে জন্ম নেই মৃত্যু নেই শুরু নেই শেষ নেই, কেবল এক আবহমান টেনশন, পারপেচ্যুয়াল পিলগ্রিমেজ। হয়তো বা পোয়েট্রি হতে হতেই এই সেই আলোকিত পোর্ট্রেট। হয়তো এই সেই পথ যা কেবল পরিধি বা পরিক্রমণে সীমাবদ্ধ নয় বরং অতিক্রম করার শেষেও তার মাঝে রয়ে গেছে আরও এক উদ্ধারহীন অনুভূতির জগৎ…

এরই ঠিক পাশাপাশি এই মহার্ঘ চলাকে সুইস ভাস্কর অ্যালবের্তো জিয়াকোমেত্তির ‘ম্যান ওয়াকিং ইন দ্য রেইন’ ভাস্কর্যটিকে ফুটিয়ে তুললেন পাথরের গহনাতে। সে কি কেবলই পাথর? নাকি জড় ও চৈতন্যের তফাত শিখতে শিখতে বিষয়ের বাইরেও ব্যস্ত হয়ে রইল আরও কিছু সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ! প্রসঙ্গে আসা যাক, অবয়ব বা আকার নয় বরং আকারের নিয়মতন্তুগুলো পেরিয়ে যে অবিরহ এক ধীর পায়ের নির্মাণ, দেখা যাক নির্ধারিতকে অস্বীকার করে সেই অর্ধস্ফুট বা প্রায় অশ্রুত সজীব উপস্থিতিটুকুকে। কেবল একটি ন্যুড লাইনড অবয়ব হেঁটে চলেছে। সরু সরু হাত তদবধি শীর্ণকায় তার পা, মেরুদণ্ডের ছায়ায় ধাক্কা খেয়ে এগিয়ে চলা লৌকিকের আদল; কেবল একটি মানুষ এবং তাকে ঘিরে অনুক্ত ইথার স্পেস! দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে, জিয়াকোমেত্তির এই ছবিতেই লক্ষ্য করেছেন, শব্দ ও দৃশ্যের আরোপিত যাপনের বাইরের সেই সূক্ষ্ম যোগাযোগ- “The line is the beginning of a negation, the passage from being to non being. Giacometti holds that reality is pure positivity, that there is being and then suddenly there no longer is any, but that there is no conceivable transition from being to nothingness. A vacuum is a distended plenum, a plenum an oriented vacuum”. মোটামুটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পরেই তৈরি এই ভাস্কর্য, আবহে অনিশ্চিয়তা আর নৈঃসঙ্গ আর পৌনঃপুনিকতা থেকে ক্লান্ত অবসন্ন মানুষের বারংবার আলোর সন্ধানে সূর্যকে অনুসরণ করা -- এই প্রেক্ষাপটে জিয়াকোমেত্তি কি শুধু মানুষ আঁকতে চাইলেন? আঁকতে চাইলেন কেবল একটি হেঁটে যাওয়া? ক্ষত থেকে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে অনর্থক এক হেঁটে যাওয়াকে চিহ্নিত করতে চাইলেন? শূন্যতাকেই কি আঁকতে চাইলেন জিয়াকোমেত্তি! দৃশ্য উদ্ভুত কেবল শূন্য হওয়ার খেলা? যে শূন্যতা আলোক সরকার বললেন, নাকি সেই ভাঙাগড়ার জাগতিক পর্যটনটুকুকে দেখলেন ভাষাহারা-ভারে ন্যুব্জ মানুষটির ট্রাইঅ্যাঙ্গুলার প্রতিলিপিতে! তবে চলা একটা আছে এবং সে চলা কাঠকয়লা অস্থি থেকে এক অন্বেষণের দিকে চলা। যে চলা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে আলোক সরকারের আত্মবৃত্ত পদক্ষেপে, যে চলা আলো জ্বালিয়ে যায়নি, আলো নিভিয়েও যায়নি, সেই নীরব চলাই হয়তো আছে নির্মাণের ভাষ্যে। আসলে সম্পূর্ণ ভাস্কর্যটিতে দুটি অসম দিকের এক অদ্ভুত পর্যবেক্ষণ রয়ে গেছে; একদিকে মানুষটির ক্ষুদ্র পরিসর, তার সারা গায়ে লেগে থাকা বস্তুজগতের আঁধার, প্রতিটি ছায়াতে লিখে রাখা নো একজিট এবং বেঁচে থাকার প্রক্ষোভ, পিগমেন্টেশন ব্যক্ত করছে আবার সাথে সাথে তার চারপাশে শিল্পীর হাতে গড়ে দেওয়া দিগন্তব্যাপী পরিসর আদতে অনবহিত হারাবার কথাই বলছে, যেন কপাট খুলে পেরোতে হবে চেনা চিরদিনের, আবার যেন এই আত্মঅস্তিত্ব থেকে কোনোদিনই বেরোতে পারবে না লম্বা ঢ্যাঙা মানুষটা। পাথরকে আঁকড়ে মূর্তিকে আঁকড়ে মূঢ় জীব থেকে মূর্চ্ছনার মনোরমা দান করেছেন জিয়াকোমেত্তি। এ ছবিতে নিরাময় নেই, আবার বধির নিষ্ক্রমণও নেই। তবে কি পরিসরের প্রশ্রয়ে সে কেবল একটি মানুষের কথাই বলছে? নাকি একটি মানুষ এবং তাকে অনুসরণ করে চলেছে আদতে সামগ্রিক প্রজাতি! ওই যে মানুষটা হেঁটে চলেছে, তার ভেতর কিন্তু কেবল শূন্যতার ম্যানুস্ক্রিপ্ট নেই বরং দৃশ্যমান জগতের মাটিতেই গড়া হয়ে গেছে বিমূর্তায়নের ভিত; ইলাস্ট্রেশনে জানা হয়ে গেছে জন্মান্তরীন চক্রবাল মন্ত্রটি, পাথরের মাঝে শূন্যতার যে স্কুল খুলেছেন জিয়াকোমেত্তি সেখানে যেন চলছে কোনো এক উদ্বাস্তু বোধের আবিষ্কার। কবিভাষার লিপি আবিষ্কার। শূন্যতা মুছে মুছে অতিজীবিত প্রভাগুলি ঠিক এখানেই বেরিয়ে আসছে শব্দোত্তর সাধনায়। জিয়াকোমেত্তির মূর্তিও কি বলছে না – “চলেছি যে / এটাই কোনোদিনও টের পাইনি”…! আসলে এলাকাগুলো স্পষ্টতর হচ্ছে না কিছুতেই, গন্তব্যের আদি নেই অন্ত নেই তীর্থযাত্রীর মতো চমৎকারটি চিনতে চিনতে যাওয়া শুধু, অথচ নিশ্চিত ও অনিবার্য বলতে কোনো ভাষা তৈরিই হলো না; ভাষা থেকে পাথর থেকে তৈরি হলো নির্মাণের ফাঁক, তৈরি হলো ছোট্ট একটা অন্তরিন্দ্রিয়ের জগৎ। সংলাপের কবি তার সামনে ঘুমের মতো একা, পাথরের শিল্পী তার সামনে পরম শূন্য। এই দর্শনই হয়ে উঠছে দ্রষ্টার দ্বন্দতত্ত্ব। চিত্রকলা সেখানে কেবল চোখের নয়, রঙের খেয়ালে সেও স্বরান্তরের, দৃশ্যকে বোধে তুলে আনার যে ললিতকলা, তাই কি শিল্পের ছাঁচ তুলে নিল না? এই ব্যবধান অনেক যোজন অথচ এই ব্যবধানেই শিল্পীর নিকট সান্নিধ্য। বাক সেখানে নির্বাক প্রেমিককে বসিয়ে রেখেছে চিরসখা করে, পাথর ধরেছে পথের পিটুইটারি।

আসলে একটি ছবি এবং ছবি বলতে যা বোঝায় তা সারাক্ষণ পা বাড়িয়ে আছে সৃষ্টিশীল কেন্দ্রহীনতার দিকে; পথ তো ছিলই কেবল শিল্পী বা কবির কাছে রয়ে গেছে পরমানন্দ হওয়ার মন্ত্রটুকু; ভাষার বিমূর্তকরনের মধ্য দিয়েই যেভাবে একজন কবির বা লেখকের লেখনীর ভরা সংসারের মাপজোক নিয়ে পালাতে পারে যে কোনো রং, সেভাবেই মূর্তির মাঝে একজন ভাস্কর খুঁজে ফেরেন সেই মৌলিক দূরত্ব যা পাথরকেও দেবে যাপনের অলৌকিক এক ভাষা, যেখানে লেগে রয়েছে প্রতিটা ব্যর্থতা প্রতিটা ক্লান্তি প্রতিটা অস্পষ্ট আত্মচিন্তা। আসলে শব্দও তো শূন্য, আর্বিট্রারি, একাকী সঞ্চারমান। অভিজ্ঞতা থেকে স্মৃতি থেকে আশ্রয় নেয় নির্মাণে -- সম্ভাবনায়, আশ্রয় নিতে হয় রেখার বিভ্রান্তিতে, সচেতনভাবে গ্রহণ করতে হয় ছবির আলোকতরঙ্গক। সব পথই পথিকের হয়ে উঠতে পারে কেবল তার প্রাণবায়ুকে পঞ্চানন করে। যিনি লেখেন তিনি যেমন তাঁর বিশাল খড়িতে কোথাও এঁকে রাখেন এক স্বয়ম্ভু ও স্বেচ্ছাচারী ক্যানভাস, তেমনি যিনি আঁকেন, মূর্তি গড়েন তিনিও কোথাও শব্দের দেবদারু কলোনিতে এসে খুঁজে বেড়ান নির্সগবেদ্য যাপনটুকু।

৩১ জুলাই ১৯৩৯এ রানী চন্দকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন -- “দেখ তো অন্ধের মতো বসে বসে এই ছবিখানি করলুম। শুধু লাইনেই রেখে দিলুম। এইতেই যখন ছবি একটা কথা বলছে তখন আর তাতে কিছু করা উচিত নয়; …আমার সব ছবি এইরকম। হাসিখুশি ভাব হয় না কেন, বলতে পারিস? অথচ আমি নিজে হাসতে ও হাসাতে ভালোবাসি, কিন্তু আমার সব ছবিরই ভাব কেমন যেন বিষাদমাখা। হয়তো ভিতরে আছে ওটা”। আসলে, একদিন ছবি হয়ে উঠবে এই আশা নিয়ে বাঁচে কবিতা, একদিন কবিতা হয়ে উঠবে এই সখ্যতা নিয়ে সংগীতময় হয়ে ওঠে পাথরের ঘাম। সবই রয়েছে এখানে অথচ প্রতিটি ক্ষণের সেই চিরন্তন দূরত্বকে খুঁজে চলেছে শিল্পী তারই স্ববিরোধিতায়; আর চিত্রকর? ভাস্কর? তার অবলোকনে তবে কি! --“ছবির জগতে সেথা কোনো ভাষা নেই / সেথায় তোমার স্থির দৃষ্টি / যে কাহিনী করিতেছে সৃষ্টি / ঘটনাবিহীন তার বোবা ইতিহাস”…!

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন