কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৩

০২ মেঘ অদিতি

ক্যারমে করতোয়া রঙ
মেঘ অদিতি


ধুলোর পাশে ফুলের গুটি
তাই নিয়ে মন আঁটাআঁটি

গাইতে গাইতে বাউল চলে যায় দূরে। হিজলতলা ছাড়িয়ে, মেঠো পথ ধরে করতোয়ার দিকে সে বাউল শূন্যে মিলায়। গান আর শোনা যায় না, কেবল তার রেশ থেকে যায় বহু সময় ধরে বাতাসে, মনে। আবিরের ভাষা ভাষা চোখ ভাষাহীন চেয়ে থাকে ওই দিকে। তার মনে হয়, এ কোনো সাধারণ বাউল নয়। সে নিজেকে যেমন ছড়িয়ে দিয়েছে প্রকৃতির মাঝে, তেমন ডাকও দিয়ে গেছে আবিরকে। হিজলতলে পড়ে থাকে তার গল্প লেখার খাতা, হাতের কলম পড়ে থাকে ধুলোয়। খেললি খেলা খেলার ঘরে... বাউলের কন্ঠ আবিরকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে আর নয়, আর কোনো খেলা নয়। এবার এসে গেছে সেই ডাক। আচ্ছন্ন আবির উঠে দাঁড়ায় হিজলতলা থেকে, গোধূলিবেলায় পায়ে পায়ে এগোতে থাকে করতোয়ার দিকে।

হঠাৎ আবিরের চোখ খুলে যায়। চটকা ভেঙে অবাক চোখে সে তাকিয়ে দেখে, গোধূলি তো নয়, সবে ভোরের আলো ফোটার আভাস চারদিকে! আর হিজলতলা কোথায়, এ তো মেলবোর্ণের রিজার্ভেয়রে তার স্টাডিরুম! রাত মুছে আলো হয়ে আসা নতুন দিনের শুরু। অথচ তার কী হলো! সে কি ঘুমিয়ে পড়েছিল? তাই বা কী করে হয়, ওই গান তো সে এর আগে কখনো শোনেনি! এ কোন্‌ সুদূরের ডাক!

টেবিলে পড়ে থাকা জন লিন্ডসের বইটা সে বন্ধ করে, হাইলাইটারটা পেন হোল্ডারে রাখতে রাখতে খেয়াল করে, স্লিপ মোডে চলে গেছে তার ট্যাবলেট পিসি। দ্রুত তাকে জাগিয়ে কাউকে মেইল পাঠায় সে। এ সময়টা টুকটাক পড়ার পাশাপাশি সে পার্সোনাল মেইল চেক করে। কখনো অন্যের জানালা থেকে ডাক এলে সাড়াও দেয়। আজ সেদিকে আর নজর নেই। উল্টোদিকের জানালা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক বালিকাদের বাড়িয়ে দেওয়া রিনিঝিনি হাতগুলো তাকে বিন্দুমাত্র টানছে না। পিসি বন্ধ করে সে তার শোবার ঘরে যায়। রোজিকে দেখে, আবিরের মাথার বালিশটাকে পাশবালিশের মতো করে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমন্ত সমৃদ্ধর মুখটা দেখতে সে তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। টিন-এজ ছেলে, ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ঘুমিয়েছে। বড় ছেলে সম্বুদ্ধ স্টাডি ট্যুরে দূরের এক শহরে আছে। সমৃদ্ধর ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আবির আপন মনে হাসে। কিচেনে গিয়ে এক মগ ব্ল্যাক কফি বানায়। টোস্টারে কড়া করে দুটো টোস্ট করে কফি নিয়ে জানালার ধারে বসে। খেললি খেলা খেলার ঘরে... এই এক ঘোরের ভেতর দিয়ে কফি শেষ করে সে প্রতিটি ঘর হেঁটে বেড়ায়। গিজার চালিয়ে শাওয়ার নেবার বদলে শীতল জলে স্নান সারে অন্যমনস্কতায়। কাজে বেরোবার ব্যাগটা গুছিয়ে সদর দরজা লক করে বেরিয়ে আসে।

ক্লোভিস রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে রিজার্ভেয়র স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। ট্রেন ধরে ফ্লিন্ড্রারস স্ট্রিটে নামে। উদ্দেশ্যহীনভাবে সোয়ারসন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন নিজেকে রিচমন্ড স্টেশনের সামনে আবিষ্কার করে হতভম্ব মুখে। চেপে বসে এবার সে আরেক ট্রেনে, অজানার দিকে। কতটা সময়, আবির জানে না, হঠাৎ ট্রেনে বসেই সে দেখতে পায় একটা নদী। দেখা মাত্রই ভীষণ উত্তেজনা। নদীটা তাকে টানছে। ঠিক তখন ট্রেন স্টেশনে থেমে যায়। আবির নামে। এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে নদীর খোঁজ করে। একটা ছোট রাস্তা পেরোতে সে পেয়েও যায় নদীর দেখা। ক্যারম নদী। আবিরের সমস্ত শরীরে আবার ঝাঁকুনি। ক্যারম না করতোয়া? তার শৈশবের নদীটার নাম তো করতোয়া! বর্ষায় আকাশ ভরা মেঘ, মেঘের পায়ে বর্ষার নূপুর আর করতোয়া আবিরকে কী রকম পাগল করে দিত। বৃষ্টিতে ভিজে ছোট্ট আবির গামছা পেতে মাছ ধরত। ছোট ছোট পুঁটির মাঝে উঁকি দিত বৌ-মাছ। তার গা ভর্তি ডোরা ডোরা গয়না। মাছগুলো এনে মা-কে লজ্জা লজ্জা মুখে বলত, মা... বৌ-মাছগুলো কড়া করে ভেজে দিও তো! মা-র দুই ভ্রূ-র মাঝে তখন আলোর মতো জ্বলে উঠত স্নেহ। মা... আহ... মা গো...

চুপচাপ সে দাঁড়িয়ে থাকে ক্যারম নদীর তীরে। হঠাৎ পকেট হাতড়ে বের করে আনে ঘরে ফেরার চাবিটা।

টুপ করে ফেলে দেয় নদীতে। তারপর একে একে ওয়ালেট, হাতঘড়ি, সেলফোন। ক্যারমের তীর ঘেঁষে সে হেঁটে চলে।

তার ঠোঁট দুটো বিড়বিড় করে --আই হ্যাড টু টেক আ ব্রেক ফ্রম এভরিথিং, এভরিথিং...

করতোয়ার তীর ঘেঁষে বাতাসে ঢেউ তুলে বাউলও কি গায়, ডুবে দেখ মন ভবকূপে

*********

পুনশ্চ: গল্পে নদী ঘিরে এক শহরের খোঁজে অপরাহ্ণ সুসমিতোর মন্ট্রিয়ল শহরে গিয়েছিলাম। তারপর লুনা মেলবোর্ণে ক্যারম নদীর খোঁজ দিল আবিরকে। শুভম লুনা রুশদী!

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন