কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৩

১৩ অর্ক চট্টোপাধ্যায়

রবিবারের রোমাঞ্চ
অর্ক চট্টোপাধ্যায়


আমার রোজ রোজ রোববার আর রোজকার রহস্য রোমাঞ্চ! এখনকার একলা ঘরে। এখানকার ঘরে একলা। রোজ রাতে ঘুমের ওষুধের মতো রাতভর চলে 'Sunday suspense'এর you tube এপিসোডগুলো। একটা স্ট্রীমে ৮৪টা ভিডিও পরপর। ভিডিও, কিন্তু আসলে তো অডিও! রেডিও থেকে আমদানি! একেকটা মিনিট পনেরো করে! হেমেন্দ্রকুমার রায় থেকে শরদিন্দু, সত্যজিৎ -- কে নেই সেখানে? auto play অন করে দিয়ে ঘুমের তোড়জোড় করি। ঘুমে চোখ যতটা বুজে যায়, কানও কি ততটাই বোজে? ঘুম আর মৃত্যুর মধ্যে বরাবরই একটা মিল লক্ষ্য করা গ্যাছে! আমি কিন্তু মজা পাই কানের কথা ভেবে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি শোনা যায়? যায় কি? জানি না; কিন্তু কেন জানি না আমি নিশ্চিত যে, মরা মানুষের কান দিয়েও কথা ঢুকে তার মরমে পশে! দাহ করা বা কবর দেবার আগে অব্দি মানুষের কান তার কাজ করে যায় বলেই আমার বিশ্বাস। শোনা কথায়, তার তত্ত্বতল্লাশ এত সহজে ফুরোবার নয়! ডাবল বেডে শুয়ে শুয়ে একা কান তার যাবৎ শুশ্রুষা নিয়ে লড়ে যায়।

আমাদের পাড়ায় অনেকগুলো আমগাছ ছিল বলে লোকে তাকে আমবাগান বলতো। এখনও বলে। কিন্তু আমরা আর সেখানে থাকি না। সেইসব গাছে গুছিয়ে আমও হতো। কিন্তু সে আম এতো টক হতো যে, চিনি কিনতে গিয়ে বুড়ো হয়ে যেত লোকে। আমগাছগুলো ছিলো এক জমিদার বাড়ির সম্পত্তি। তাদের হয়ে এক বুড়ো গাছগুলোর দেখাশোনা করত। আম ঠিকমতো পেকে গেলে সেগুলো পেড়ে বিক্কিরি করে আসতো বাজারে। তাকে সবাই ডালিয়া বলে ডাকতো। বয়েসের গাছ বা পাথর কোনোটাই ছিলো না তার। গালগুলো একেবারে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল; চোখ দিন দিন আরো ছোট হয়ে এসেছিল; বয়েসের ভারে কোমর থেকে শরীরটাও ঝুঁকে পড়েছিলো সামনের দিকে। সে যেমনই হোক, ডানপিটে ছেলেরা আম পাড়তে আসলেই শূন্য থেকে উদয় হতো সে। হাতে থাকতো ইয়া বড় একটা লাঠি। আমার তো ছোটবেলায় কখনো কখনো মনে হতো, ডালিয়া লোকটা আসলে একটা ভূত, যে কিনা যক্ষের মতো পাহারা দিচ্ছে গাছগুলোকে! আমি একদিন দোতলার বারান্দা থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলাম ওকে! আমাদের বাড়ির সামনের আমগাছে উঠেছে আম পাড়বে বলে। ডালে ডালে দিব্ব্যি লটকে বেড়াচ্ছে! আমি নিঃশব্দে ওর আম পাড়া দেখছিলাম থামের কোণ্‌ থেকে; ওমা, হঠাৎ পুরো ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে আমার দিকে তাকালো ডালিয়া। অথচ আমি একটুও শব্দ করিনি! কী ভয়ঙ্কর সে চাহনি, যাকে বলে একেবারে রক্ত জল করা! আমার কেমন জানি মনে হলো, ওর চোখজোড়া উড়ে এসে আমার কানে সেধিয়ে গেলো! ডালিয়ার সেই মরা চোখজোড়া আমার কানে ঢুকে যাবার পর থেকেই আমার এহেন বিশ্বাস যে, মানুষ এবং মানব উভয়েই পটল তুললেও কর্ণ নামক এই কুহর আর পটহ থেকেই যায়!

গল্প শোনায় কি ছোটবেলা ফিরে আসে? কান মানেই তো গল্পের কুহর আর পটহ! ছোটবেলায় বাবা-মা দাদু-ঠাকুমার ঝুড়ি ঝুড়ি ঘুমপাড়ানি গল্প। এমন সব গল্প যা আদৌ কখনো লেখা হয়নি; যে সব গল্পের প্রায় প্রতিটা বাক্যই মুখ দিয়ে বেরোনোর সেকেন্ড খানেক আগে মগজে গজিয়েছে! যে সব গল্প শেষ করতে না পারলে বা ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসলেই গুহার ভেতর landslide আর গল্পের সম্ভাবনাময় অকাল মৃত্যু হতো! সারারাত জুড়ে আধা ঘুমে আধা জেগে ক্ষীণ কান পেতে এইসব রবিবারের রোমাঞ্চ গল্প শুনি আমি। রাতভর এরা মিলমিশ করে। হেমেন্দ্রকুমারের আগার সাথে কিরীটির পাছা কিম্বা ব্যোমকেশের অন্তরার সঙ্গে শঙ্কুর সঞ্চারী! আমার ঘুমো কান কোনো গল্পই পুরোটা শোনে না; আধো আধা রেখে যায় সবাইকে আর এক গল্পের সঙ্গে অন্য গল্প জুড়ে একাকার হয়ে মাথাটা কেমন গুলিয়ে দেয়। এইসব গুলোনো গল্পেরা আমার তুমি, আমার ইউ আর টিউব; এদের সাথেই পায়ুকাম সারা রাত! তবে আমার কেন জানি না মনে হয়, গল্পগুলোর শেষ না হবার অন্য একটা কারণ আছে! ওদের মিলিয়ে মিশিয়ে গুলিয়ে দেয় ডালিয়ার চোখজোড়া! গল্পগুলো কান দিয়ে ঢুকতে শুরু করলেই ডালিয়ার ওই নিকষ নিকুতি চোখজোড়া ঘিরে ধরে তাদের। ইয়া বড় একটা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। ব্যাস, তাদের আর আম পাড়া হয় না।

রাতভর গুলোনো গল্পের যাতায়াত চলতে থাকে। এরা আমার স্বপ্নেও ঢুকে পড়ে। তার ভেতর দেখি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা লোক তার বাড়ির চাবি ছুঁড়ে দেয় আমার দিকে। আমিও হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত। তালা খুলে ঢুকে পড়ি তার বাড়ি। এঘর ওঘর করতে থাকি। কিন্তু ক্রমশই মনে হয় বাড়িতে আমি ছাড়া অন্য কেউও আছে! অথচ দেখা দেয় না সে! ঘুমের মধ্যে আমার আরো ঘুম পায়। শোবার ঘরের পাট করে সাজানো বিছানা দেখে লোভ সামলাতে না পেরে শুয়ে পড়ি। চট করে ঘুম চলে আসে চোখে। ঘুম ভাঙ্গতে দেখি আমার বিছানার ওপর আমার ঠিক পাশে কেউ একটা আম রেখে গেছে কাঁচের ডিশে করে। তিন ভাগে ভাগ করা আবার! আমি উঠে বসে তার সদব্যবহার করতে শুরু করি। দাঁত বসাতেই মনে হয়: বাহ, বেশ মিষ্টি আম তো! আঁটি চুষতে চুষতে চোখটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসে, কিন্তু সেই ঝাপসা চোখেও মনে হয় অন্ধকার ঘরের কোন বরাবর কে যেন দাঁড়িয়ে আছে: কোমর থেকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে গোটা শরীরটাই দুভাগে ভাগ হয়ে গ্যাছে!

এইসময় স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। 'Sunday suspense' এ তখন শরদিন্দুর 'প্রতিধ্বনি' গল্পের দ্বিতীয় অংশ। ঘুমোবার আগে কি এই গল্পটাই হচ্ছিলো? না না, এতো অল্পক্ষণ নিশ্চই ঘুমোইনি! কি নাম ছিলো ওই গল্পটার? কে যেন প্লানচেট করছিলো সেখানে? প্ল্যানচেটে যার আত্মা এসেছিলো তার নাম কি ছিলো? কানের ভেতর ডালিয়ার মরা চোখজোড়া বিজ্ঞাপনের অল আউটের মতো গপগপ করে গিলে ফেলছে আমার গল্পের মশা-মাছি-পোকাদের! আমার তাই রোজ রোজ রোববার আর রোজকার রহস্য রোমাঞ্চ!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন