কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি 




 

প্রতি,      

 

থিয়েটার বা মঞ্চ নাটকের উপস্থাপনের দিক থেকে বাংলায় দুই ভাগ করা যায়। এক ভাগে থাকে গণনাট্য সংঘ ও গ্রুপ থিয়েটার। অন্যভাগে থাকে পেশাদারি রঙ্গালয় বা চেনা প্রফেশনাল থিয়েটার। গ্রুপ থিয়েটার শিল্পীদেরও আয়ের শুরু হয়ে থাকে এমনই মঞ্চে অভিনয় করে। শীতের রেশ নরম কুয়াশা কলকাতার বৃহস্পতি, শনি, রবি ও ছুটির দিন দর্শকের ভিড়। দৈনিক খবর কাগজে থাকে বিজ্ঞাপন। একটি বিশেষ পাতা ভরে ওঠে। আর দর্শককুল সেই পাতা থেকেই বেছে নেন। আবার জনৈক দর্শকের মুখে শোনা যে, ওই পথে যেতে যেতে যেই নাম যেই নাটকের পোস্টার টানে, বা যেখানে শিল্পীদের নাম টানে – সেখানেই অভিনয় দেখতে ঢুকে পড়া। নাটকের দর্শকের কৃপা যে, তাঁদের নাটক-প্রীতি ঘরসংসার চালিয়ে দেয় কত না শিল্পী ও কলাকুশলী বন্ধুদের।

অপরিচিত দর্শককে টেনে আনার কুশলতা থাকে। পেশাদার মঞ্চের ক্ষেত্রে শুধু বক্স আর্টিস্ট দিয়ে নাটক চলবে না। সঙ্গে দিতে হবে ভাল গল্প বা প্লট। যেই প্লটের দ্বন্দ্ব  উত্তরণে ঘটবে নাটকীয় উত্তাপ। সেই রসায়ন গড়ে তোলার প্রাথমিক ভার হল নাটক লেখা ও বাছাই করে নেওয়াতেই। যেমন, এখন আর না-থাকা মঞ্চ রঙ্গনা-র একটি বিশেষ প্রযোজনা ‘কি বিভ্রাট’ নাটক। সাল ১৯৯০। ১৯৭৫ সালের ‘নট-নটী’র পর রমরমিয়ে চলছে রঙ্গনা। কত জুলুষে কত নাটক চলছে, চলবেও। রঙ্গনা প্রযোজনার চতুর্থ নাটক ‘কি বিভ্রাট’। নাটককারের নাম গণেশ মুখোপাধ্যায়। উক্ত  নাটকের প্রথম অভিনয় তারিখ ১৯৯০ সালের ১৫ এপ্রিল। প্রথম শো হয় রবিবার তিনটেয়।

কেন রবিবার, কারণ সহজেই অনুমেয়। কারণ, এক, ছুটির দিনে নাটক নামালে দর্শক সংখ্যার প্রাবল্য। দুই, ছুটির দিনে বিজ্ঞাপনের পাতায় চোখ রাখেন বেশি পাঠক। ফলে, বেশি মানুষের কাছে জানানো যায়। তিন, এতে এটুক নির্ধারিত হয়ে যায় যে, নাটকের টিকিট বিক্রি হবে। আর নাটক নামানোর খরচ উঠবেই গ্যারান্টি।

এখানেই ফ্ল্যাশব্যাক। কারণ, নেই থিয়েটার পাড়ার কথা লেখা হচ্ছে। বা আলোচনা হচ্ছে। যেই থিয়েটার পাড়ায় অনেক মানুষের রুজি-রুটি ছিল। ছোট-মাঝারি-বড় দোকানি, টানা রিকশার চালক, হলুদ ট্যাক্সির চালক থেকে হলের কলাকুশলী – সব্বাইয়ের রোজগারের সংস্থান। এবারে ১৯৯০ সালে ফিরে দেখা বা ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাড়ার জমজমাট চিত্র। কলকাতার বাংলা সিনেমার নায়ক নায়িকা কলাকুশলী শিল্পীদের আকছার দেখা যেতে পারত এই পাড়ায়। কারণ, থিয়েটারের শিল্পী তাঁরাই। তাঁদের অভিনয় দেখতেই জমে ভিড়। দূরাগত দর্শক পছন্দ করেন দুপুরের শো অর্থাৎ ম্যাটিনি দেখতে। তাই উক্ত নাটকের জন্যে তিনটের শোয়ে হয় উদ্বোধন। একেই বলে মার্কেটিং স্ট্রাটেজি। বা সাংস্কৃতিক বিপণন কৌশল। যা একটি চলমান প্রক্রিয়া ছিল, যার দ্বারা একটি প্রযোজনা হিট হতে হতে দিব্য পার করত শতাধিক রজনী।

একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে, সাংস্কৃতিক বিপণন কৌশল একুশ শতকের আমদানি করা একটি বিশেষ কিছু। ফ্ল্যাশব্যাকের ইতিহাস অনুসন্ধানে মিলবে যে, এরকমই দর্শনের চালিত ছিল পেশাদারিত্বের রঙ্গালয়গুলো। এই বিষয়ে লেখার সূত্রে দেখা করে নেওয়া যায় ওই পাড়ার পুরনো দোকানিদের সঙ্গে। এবারের লেখার বিষয়ত্বে প্রতিবেদক জনৈক বয়ঃপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী। তাঁর কথায়, দর্শক মানে তো শুধু থিয়েটার দেখতে আসে না। কাচ্চা-বাচ্চা পরিবার সমেত আসে শহর ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে প্রথমে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করা। শহরের রেস্তোরাঁয়। তারপর তিনটের শোয়ের থিয়েটার। হাফটাইমে খাবে ঠাণ্ডা আর বাদাম, ঝালমুড়ি এসব। আর শেষে তৃপ্তি নিয়ে বেরিয়ে খাবেন চপ-মুড়ি, ঘটি গরম, চা, ফুঁকবেন কেউ কেউ। সঙ্গে আলোচনা চলবে, কী দেখলেন। কে ফোটাতে পেরেছেন, কে  পারেননি। অনেকেই অনেক আর্টিস্টদের চিনতেন সিনেমার সুবাদে, তাই অভিনয়ের চুলচেরা বিচার চলত। আবার এও শুনতে হয় যে, নাহ এবারেরটা দাঁড়ায়নি ঠিক। হয়ত প্রথম শো তাই। সিনেমার শিল্পী সব, ঠিকমতন রিহার্সাল দিতেই পারেননি, তাই। পরেরবার আবার দেখবে ইত্যাদি। দর্শক বুঝতে পারতেন সচেতনভাবে। এবং পরেরবার ওই একই নাটক দেখে বলতে পারতেন, অমুকের অমুক দৃশ্যটা দেখেছ, কী করলেন! একেই বলে জাত অভিনেতা বা অভিনেত্রী।

আবার আরেক ধরনের দর্শক ছিলেন। জিজ্ঞেস করতেন খেতে এসে। কেউ জিজ্ঞেস  করতেন চত্বর-সংলগ্ন নেশাকাঠি কেনার দোকানিকেও। এভাবেই চলত।

প্রশ্ন করতেই হয়, সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে হবে, এই চত্বরে তো কতগুলো সিনেমা হল। আর সিনেমার আতিশয্য এবং বাহুল্য ঝকঝকে ব্যাপার।

হ্যাঁ, তা থাকলেও, এ পাড়ার থিয়েটার দেখতে আসিয়েদের পছন্দ আলাদা। ওই যাঁদের পছন্দ যাত্রাশিল্প, তাঁদের পছন্দ প্রথমে থিয়েটার। না গ্রুপ থিয়েটার নয়, এই পাড়ার থিয়েটার, যেখানে সিনেমা শিল্পীরা থাকবেন, কিন্তু দেখার মতন হল অভিনয়। আরে, লোকে অতশত বোঝে না, শুধু দেখে অভিনয়। ভুলে যাবেন না যে এই পাড়ার মাত্র হাঁচি দেওয়া দূরে দূরে মঞ্চ। পাশাপাশি গলি ভর্তি। সঙ্গে একটু দূরেই তো যাত্রাপাড়ার গদি। যেখানে চালু কথা হল, ষষ্ঠী থেকে ষষ্ঠী। মানে সিজন, বুঝলাম।

জনৈক অভিজ্ঞ-দরদি দর্শী জানান যে, শিল্পীদের কদর হয় অভিনয়ের জন্যে। মনে  করুন, একটা সাদামাটা চরিত্র, তার সঙ্গে নিজেকে দেখানো। উঃ, কি তাঁদের কায়দা! কেউ কেউ যদি দুটো শোয়ের দর্শক হন, তাহলে দেখবেন কত্তটা পাল্টে ফেলে অভিনয় করেন শিল্পীরা। না, সব্বাই নন। কিন্তু প্রায় সবাইও। মানে, পয়সা উশুল। হেসে বললেন, দেকেছেন নাকি!

মাথা হেলিয়ে বলা মাত্রই চেপে ধরলেন, দূর, আপনি তখন কত হবেন! এই চার-পাঁচ বছরের ছানা। দেখেছেন বটে সত্য। কিন্তু তা মনে আচে কিনা।

মাথা হেলিয়ে বোঝানো, না তা সত্যি। কম বয়সের অনেকটা ছবি হয়ে থাকে মাথায়। সেটাই নাড়াচাড়া দেয়, হ্যাঁ হ্যাঁ চেনা বলে।

দোকানি বলে যায়, এইখানে দাঁড়িয়ে দেখেছি কতজনকে।

হাতিবাগান পাড়ার এইটা হল জংশন। যেখানে নির্দ্বিধায় সবাই আসেন যান। সেই রাত্তির পর্যন্ত। এমন টিমটিম আলোয় নয়। মুখের মেকআপ নিয়েই কতজন উঠে পড়েন গাড়িতে। সিনেমায় কাজ আচে তো। কি ব্যস্ত ওঁরা। সময় নেই নাওয়া-খাওয়ার। আলাপ করতে আসত তাঁদের সঙ্গে থাকা ড্রাইভার কখনও। তারপর চাকা গড়ায়। আর দুপুরের দর্শকের ভিড় চলে যায় রেলগাড়ি চেপে। ফের আসে হয়ত বা।

আর এই শহরের দর্শক? হ্যাঁ, তাঁরাও আসেন। ওঁদের পছন্দ কিন্তু ইভনিং শো, মানে সন্ধেতে। ফুলবাবুটি সেজে।

মানে সেই বাবুদের কথা বলছেন?

না, না, এঁরা তারা নন। এঁরা ভালমানুষ। মানে চরিত্রে ভাল, ওরকম নেশা করা কেউ নন। আরে পান আর ধূমপান ঠিক নেশা নয়, বুঝলেন। তা এই হল শহরের দর্শক। যাঁদের সঙ্গে উঁচু নাক চলে আসে। ওঁরা প্রায় সবই বোঝেন, সমঝদার লোক। অনেকেই, তবে সব্বাই নন। কেউ খুব কপচান যে, অমুক নামকরা শিল্পী তাঁর অমুক দিকের আত্মীয়। এতে কেউ কেউ তাকান। আর কেউ কেউ মৃদু হাসেন। বুঝলেন, রঙ্গালয়ের বাইরেও আরেকটা অভিনয় চলে। যেখানে মঞ্চ হল এই দোকান রাস্তা। আর দর্শক হল অভিনেতা। উঃ, কি কাণ্ড ভাববেন একবার।

তবে, আপনি কাকে কাকে দেখেছেন?

কাকে কাকে দেখিনি বলুন। সব্বাইকে দেখেছি। আমাদেরও শখ হত হিট করলে দেখতে যাওয়ার, টিকিট লাগত না। কারণ, হলের কলাকুশলীরা চিনত যে। একটা সম্পক্ক হয়ে যায় তো। অমায়িক মানুষজন সবাই। কেমন একটা আত্মীয় হয়ে থাকা আর কী!

তাতে ফ্রি-তে নাটক দেখা যায়। আর…

আরে ফ্রি-তে ভাবলেন, না তা নয় ঠিক। দেখব বলে সব্বাইকে একদিন চা খাইয়ে দিলাম। আবার কোনদিন ওঁরা আমাকে দেখিয়ে দিল, এরকম ব্যাপার।

‘কি বিভ্রাট’ তখন নাম করেছিল।

হ্যাঁ, খুব।

মনে আছে কতদিন চলেছিল?

না, তা নেই। তবে বছর পেরিয়ে।

তখন বলতেই হল, নাটকের নাটককার গণেশ মুখোপাধ্যায় যে তথ্য লিখেছেন, তাতে তিনি লেখেন যে ‘কি বিভ্রাট’ নাটকের অভিনয় চলেছিল প্রায় ৮০০ রজনী। অবিশ্বাস্য!

৮০০ রজনী মানে তো ৩৬৫ দিন ধরলে , তিনটে শো, আর আগের কিস্তিতে উল্লেখিত যে, দর্শক-আসন সংখ্যা প্রথমে এর আসন সংখ্যা ছিল ৮৫০টি। পরে বেড়ে যায় ৯০৫টি। ১৯৭৫ সালের পর থেকে তাহলে ১৯৯০ সাল পরের দিক বলেই ধরা যায়। মানে এত সাফল্য। কী বিস্ময়ের!

জনৈক দোকানি বললেন, তা জাগতেই পারে। আপনারা যেসময়ে চলছেন, সেখানে থিয়েটার বলে গ্রুপ থিয়েটারকে। সিনেমাও চলে না তো এদ্দিন। কত প্রচার করেও কড়কড়ে টাকা ঢেলেও চলে না। কিন্তু আমাদের সময়ের ব্যাপারটাই ছিল আলাদা। ধরুন একই বই, মানে উনি বলতে চেয়েছেন গল্প বা প্লট, একই বই সিনেমা হল, থিয়েটার হল। কী দারুণ ব্যাপার। কী দারুণ সব গল্প তাঁদের। আমাদের সময়ে আসল ছিল গপ্প-টা। সেটা চললেই বাকি নাটক হোক বা বই, মানে সিনেমা হিট হবেই। মন রাখবেন, এপাড়ায় নাটক করতে আসতেন সিনেমার শিল্পীরাই।  একদিকে তাঁদের নিয়ে নামতো নাটক। অন্যদিকে তাঁদের অভিনয়ের কদর ছড়িয়ে পড়ত গঞ্জে শহর ছাড়িয়ে। তাতেই তেঁনারা হতেন বক্স আর্টিস্ট। কিন্তু অংহকারী নন একদম। যা বলছিলাম, গপ্প, গণেশবাবুর আরও গপ্প নেমেছিল তো।

হ্যাঁ, ওঁর রঙ্গনা-পর্বের প্রথম নাটক ‘নট-নটী’, দ্বিতীয় নাটক, মানে নাট্য-রূপান্তর ‘বহ্নি’, তৃতীয় নাটক ‘জয় জয়ন্তী’, চতুর্থ নাটক ‘কি বিভ্রাট’। এই নাটকের পরিচালকও তিনি। নাটকের সংগীত দিয়েছিলেন কল্যাণ সেন বরাট। থামিয়ে দিয়ে দোকানি বললেন, আরে হ্যাঁ, উনি তো রেডিওর রাজা একেবারে।

বলতেই হয় যে, এই নাটকের কলাকুশলীদের তালিকা ঋদ্ধ করেছেন অনুপকুমার, অরিন্দম গাঙ্গুলি, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, নিমু ভৌমিক, গীতা দে, অলকা গাঙ্গুলি এবং রত্না ঘোষাল।

দোকানি শুনে বললেন, এঁদের সব্বাইকে দেকেছি। কেউই তখন বেশি বয়সের নন। সবেমাত্র উঠেছেন বা উঠছেন। কিন্তু অভিনয়ে খাসা। মঞ্চে সিনেমার মতন কাটছাঁট তো চলে না, তাই অভিনয়টাই সব।

বলতেই হয়, আপনি তো প্রায় সবই জানেন।

হেসে ফেলেন দোকানি। বলেন, নিজের চোখে দেখা যে … কত ভিড় কত তাড়াহুড়া, কত রিকশার টুংটুং। কত মানুষের কত রকমের গন্ধ, কথা বলার কলকল, প্রাণ তেজী টগবগে ঘোড়ার মতন।

ফেরার সময় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি করেন, কি করবেন এত জেনে? হলগুলো তো খুলবে না আর। তাহলে লেখার মানে? বললাম, সম্পাদক আছেন একজন কাজল সেন নামে, তিনিই বলেছেন লিখতে। তাই স্মৃতিচারণ আর তাড়না, তাগিদ, যদি কোনদিন …। বিকেলের আলো জ্বলতেই বিশ শতকের ওই গলির সঙ্গে একুশ শতকের দূরত্ব সময় বোঝা গেল। তাই তো …  ফ্ল্যাশব্যাকে রইল আরও কত নাম, নাটকের কথা আগামি কিস্তির জন্যে।

 

_ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী

১০-১১-২০২২

শান্তিনিকেতন

(অঙ্কনশিল্পী : অর্ঘ্য চক্রবর্তী) 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন