ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(৩২)
দিন
চলে যাচ্ছে, একটা সপ্তাহ শেষ ফুরিয়ে এল, বাবুলের সঙ্গে খোলাখুলি কথা হচ্ছে না। তার
ব্যস্ততার বহর লিপিকাকে কষ্ট দেয়। প্রথমদিন বাবুল তার ফ্ল্যাটের চাবি মা-র হাতে দিয়ে
প্রায় পালিয়ে গিয়েছিল। ঘরের অবস্থা দেখে লিপিকার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা তলানিতে! কোনও জিনিস
জায়গায় নেই, জামা-কাপড়-জুতো থেকে তোয়ালে-অন্তর্বাস-মোজা এমনকী দু-চারটে বাসন যা আছে
সমস্ত ছত্রাকার। অতি দৃষ্টিকটুভাবে যত্রতত্র বিক্ষিপ্ত জলের বোতল। হুইস্কি, বীয়ারের
বোতলও সংখ্যায় কম নয়! প্রকৃত অর্থেই বিকট ‘মেস্’। খানিক দম নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে লিপিকা কাজে নেমেছিল। ঘন্টাতিনেক একনাগাড়ে
পরিশ্রম করে ব্যাগভর্তি না-কাচা নোংরা জামাকাপড় সঙ্গে নিয়ে নেমেছিল, গেস্ট-হাউসে ওয়াশিং
মেশিন চালু আছে। বাবুল রাতে খেতে এলে তার হাতে গুছিয়ে দিয়েছিল,
“কাছাকাছি
লণ্ড্রি-সার্ভিস নেইরে? কত নোংরা জামাকাপড় জমিয়েছিস, উইক- এণ্ডে দিয়ে আসতে পারিস তো!”
হর্ষ
বিরক্ত গলায় বলেছিল,
“আঃ
ছাড়ো তো মা। এজন্যই তো তোমাদের এখানে, ডিনারে আজ কী অর্ডার দিয়েছ?”
লিপিকা
সরাসরি ছেলের চোখে তাকিয়েছিল। আসার পর থেকে লক্ষ করছে যেন স্বাভাবিক নয়, অস্থির, চঞ্চল,
সরাসরি তাকাতে পারছে না। মন খুলে জিজ্ঞেস করতে পারেনি।
গত
তিনদিন ধরে গেস্ট-হাউস থেকে সে শুধু ব্রেকফাস্ট নিচ্ছে, নিজে বাকি রান্না করছে। ব্রেকফাস্টে
দুধ-কর্ণফ্লেক্স বা দই-ওটস, সঙ্গে চাপাতি বা পরাঠা মিলিয়ে-মিশিয়ে। গ্যাস নেই, অনুরোধ
করাতে রাইস-কুকার আর ইন্ডাকশন হিটার দিয়ে গেছে মিসেস ভাসিন। কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়েই
বাজার—প্রয়োজনীয় সব পাওয়া যায়। তাছাড়াও অনলাইন
সার্ভিস। মিসেস ভাসিন খোঁজ নেয় রোজ একবার করে। হাসতে হাসতে বলছিল,
“ইয়োর
সন্ মেরে-পর জিম্মেদারি থোপ দিয়া। লেকিন খানা কিঁউ নহীঁ লে রহী হো?”
“হাসব্যাণ্ডকা
থোড়াবহুৎ রেস্ট্রিকশন্স হ্যায়।”
জানিয়েছে
লিপিকা, ভাসিন এরপর বিনাপ্রশ্নে সহযোগিতা করেছে।
কদিনের অনাহূত পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে লিপিকার, মাথা ধরে থাকছে। এসেছিল ফ্রেশ হতে, আর ভালো লাগছে না, ভেতরে চাপা এক অশান্তি। নিজেরই অবাক লাগছে, খুশী থাকার দিন এখন, মা-বাবা-ছেলে কাছাকাছি।
কেন
যে মাছগুলোর কথা মনে পড়ছে, তারাও হয়ত অন্য বাসাতে চেনাগন্ধের গণ্ডী খুঁজে মরছে!
দুপুরে
খাওয়ার পরে লিভিংরুমে বসে ম্যাগাজিন ওল্টাচ্ছিল - পুরনো ক-খানা স্টারডাস্ট, ফেমিনা,
ইণ্ডিয়া টু-ডে রাখা আছে। আসার পরদিন রবিবার বেরিয়েছিল তিনজনে। বেলা দশটায় ঘুম থেকে
উঠেছিল বাবুল, ফোন করার পরে রেডি হয়ে এসেছিল গেস্ট হাউসে। বেরোতে বেরোতে সাড়ে এগারোটা।
কোনও না কোনও কারণে দিল্লী আসেনি সাধারণত এমন লোকের সংখ্যা নগণ্য। শোভনকে অফিসের কাজে
আসতে হয়েছে কয়েকবার, ঘুরে দেখার তত সময় হয়নি। লিপিকা ও হর্ষকে নিয়ে দিল্লী বেড়াতে এসেছে,
তখন হর্ষ নিতান্ত বালক। শোভন চেয়েছিল পুরনো দিল্লীর দিকে যেতে - লাল-কেল্লা, কুতুব-মিনার,
চাঁদনি-চৌক চিরকালীন নস্টালজিয়া। হর্ষ নিয়ে গেল বাহাই টেম্পল দেখাতে, শোভন-লিপিকার
দেখা ছিল না। ভালোই লাগছিল লিপিকার শীতল রোদে ঘোরাঘুরি কিন্তু শোভন একটু পরপর ক্লান্ত
হয়ে পড়ছিল। বাবুল এন-সি-আর-এর উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছিল। নয়ডার শেষ পর্যন্ত গিয়ে ওরা ফিরে
এসেছিল - বিদেশের মতো চওড়া রাস্তা, অত্যাধুনিক বিশালাকার সব রেসিডেন্সিয়াল টাওয়ার।
যাওয়া-আসা মিলে ঈষৎ দীর্ঘ হয়েছিল সফর। ফেরার পথে কোনওরকমে গাড়ি থামিয়ে বমি করল শোভন,
খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল লিপিকার। অল্পবয়সী ড্রাইভারটি অবশ্য সহানুভূতিশীল ছিল, সযত্নে পৌঁছে
দিয়ে গিয়েছিল। রাতের দিকে জ্বর এল শোভনের। বমির শব্দে লিপিকার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, বেসিনে
বমি করছিল শোভন। অসহায় লাগছিল লিপিকার, ভয়-ভয়। কলকাতায় থাকতে এমন হয় না, যথাসম্ভব সাবধানে
রাখে সে। হর্ষকে ফোন করে ডাকেনি, বিব্রত করতে ইচ্ছে করেনি। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টে
এল ছেলে, তাড়ায় ছিল। লিপিকার বদলে শোভন নিজেই বলল,
“আমার
শরীরটা ঠিক নেইরে বাবুল, রাত্তিরে আবার বমি, জ্বর।”
বাবুল
চমকে উঠে অসহায়চোখে লিপিকার দিকে তাকিয়েছিল,
“মা!
কিন্তু আজ তো আমি—মানে যেতে হবে মা আজ—,”
লিপিকা
মাথা নেড়ে আশ্বাস দিয়েছিল,
“ইনডাইজেশন
হয়েছে মনে হচ্ছে, তাছাড়া এতটা ট্রাভেল করেছে না! অভ্যেস নেই কত বছর। ওষুধপত্র নিয়ে এসেছি। একটু পরে কলকাতায়
ডাক্তারবাবুকে ফোন করব। তুই যা।”
ঘুম
এসেও আসছে না, কত কী ভাবনা কিলবিল করে মাথায় ঢুকছে, বেরোচ্ছে। শোভন সেরে উঠছে, যদিও
সারাদিন শুয়ে বা ঘুমিয়ে থাকে। আসার পর থেকে বাবুল কাছে আসছে, কথা বলছে না বিশেষ, খেয়ে
তাড়াতাড়ি নিজের ফ্ল্যাটে চলে যাচ্ছে। দূরত্ব রাখছে, কী যেন চেপে যাচ্ছে, লুকিয়ে রাখছে।
ছেলের সঙ্গে কথা বলতে তারা উন্মুখ হয়ে আছে। বিয়ের ব্যাপার উত্থাপন করার সুযোগ পাওয়া
যায়নি। কোথাও ছেলের ওপর অভিমান জমে ওঠে লিপিকার - ভাবে একটা বয়সের পর একান্ত নিজস্ব
কোণটি ছাড়া সংসারে কোমফোর্ট জোন কোথাও থাকে না।
বাবুল ক-দিন ভালো ঘুমোতে পারছে না। ভাঙা-ছেঁড়া ঘুম আসে যায়, সকালে চোখ অসম্ভব জ্বালা করে। মা-বাবা তার কাছে এসেছে, সেই আনন্দ, উচ্ছ্বাস, আবেগ চাপা পড়ে গেছে হঠাৎ-আসা প্রবল ধুলোর ঝড়ের নীচে। মা আঁচ করছে কিছু, চাহনি থেকে বুঝতে পারছে হর্ষ। সেই রাতে এয়ারপোর্ট থেকে এসে ডিনারের পর নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে সারারাত কীভাবে কাটিয়েছে তার সাক্ষী দেওয়ালের কোণের গোটাদুই টিকটিকি। সারারাত দেওয়ালে পর্দায় অদিতির মুখ, শরীর, হাসি—হ্যালুসিনেট করেছে।
ডিনার
করতে যায় না বাবুল, কিচেনের শেলফ হাতড়ে হুইস্কির বোতল বের করে, সামান্য খেলেই নেশা
হয় তার। বোতল যা ছিল টান মেরে ফেলে দিতেই পারত মা, উলটে গুছিয়ে রেখেছে। যত কষ্টই হোক
এর মধ্যে বাবুল স্পর্শ করেনি। এখন আধ-খাওয়া বোতল থেকে নীট্ গলায় ঢেলে খানিকক্ষণের
মধ্যে আচ্ছন্নের মতো বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে। কখন খেয়াল নেই, বালিশের পাশ থেকে মোবাইলের
রিংটোন আবছা ভেসে কানে আসে। ফোন ধরে সে।
লিপিকা
বিষণ্ণ শীতল অসন্তুষ্টভাবে বলে,
“ছ-সাতবার
ফোন করেছি বাবুল। রাত এগারোটা বেজে গেছে।”
বাবুলের
জড়ানো আড়ষ্ট স্বর বলে,
“স্যরি
মা!”
“ডিনার
করবে না? সেই থেকে ওয়েট করছি।”
“বাবা?”
“ঘুমিয়ে
পড়েছে অনেকক্ষণ। আজ চিকেন-কষা করেছিলাম তোমার জন্য।”
“স্যরি
মা!”
“বাবুল
তুমি কি—?”
“হ্যাঁ
মা, ইয়েস। বটলগুলো ফেলে দাওনি — থ্যাঙ্কস্।”
লিপিকা
শরীরের মধ্যে কেমন করতে থাকে, কেন এরকম করছে ছেলেটা? সে নীরব থাকে, প্রশ্ন-উত্তর কোনওটাই
করে না। বাবুল ডাকে,
“মা,
আমার ফ্ল্যাটে আসবে একবার?”
“এখন!
এত রাত্তিরে! তোমার বাবা ঘুমোচ্ছে—,”
“এসো
না মা! কাল-পরশু ছুটি।”
কী
আর্ত বাবুলের স্বর, এমন করুণ শোনায় লিপিকার বুকটা মুচড়ে ওঠে। শুধু বলতে পারে,
“আসছি,
দাঁড়াও।”
বাবুলের বিছানায় উঠে বসে লিপিকা, গা-ঘেঁষে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে বত্রিশবছরের বাবুল। মাথায় ক্রু-কাট্ চুল, বাঁ-কাঁধে ছোট্ট একটা ট্যাটু। লিপিকা সংযতভাবে গুছিয়ে বলে,
“বাবুল
আমার মনে হয় এবারে আমাদের ফিরে যাওয়া ভালো। তোমার বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়ল, বাড়িতে অনেক সাবধানে রাখতে হয়। ভেবেছিলাম
মণীষার মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হবে কাল বা পরশু। তা, তোমারও দেখছি সময়ের কনস্ট্রেইন্ট।
কী হয়েছে বলতেও চাইছ না—ওসব থাক তবে
এখন।”
অনেক সময়ে গলার ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে খোঁচা দিলে হুড়হুড় করে অপাচ্য সমস্ত বেরিয়ে আসে, এমনকী অন্নপ্রাশনের অন্ন পর্যন্ত! বাবুলও উগড়ে দেয় জমে-থাকা সমস্ত—ড্রিম-হোমস-এ অদিতির সঙ্গে প্রথম দেখা থেকে গত শনিবারের এয়ারপোর্টের দৃষ্টিবিনিময়, বলেই চলে একনাগাড়ে। তারপর নাক-চোখের জল এবং হুইস্কির গন্ধভরা মুখখানা লিপিকার কোলে তুলে দিয়ে অচেতনের মতো ঘুমিয়ে পড়ে। লিপিকা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে, আলতো আঙুলে পুত্রের মাথায় হাত বোলায়। অন্ধকারে তার চোখের জল ঝরে পড়ে, বাবুল টের পায় না।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন