কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ১৩

 


পিটার  নরবেকের জন্ম ১৮৭০ সালে তদানীন্তন ডাকোটা টেরিটোরিতে। বাবা জর্জ সুইডেন আর মা ক্যারেন নরওয়ে থেকে এসে এই ডাকোটা টেরিটোরিতে কাঠ-মাটির কুঁড়েঘরে  বসবাস শুরু করেন। এই অভিবাসী পরিবারের ছয় সন্তানের সর্বজ্যেষ্ঠ ছিল পিটার। সে প্রথমে তেল, জল খননের কাজ করতো এবং পরবর্তী কালে চাষবাস। ডাকোটা টেরিটোরির মাটির সঙ্গে ছিল তার নাড়ির টান। পরিণত বয়েসে পিটার নরবেক সাউথ ডাকোটার গভর্নর এবং পরে মার্কিন সেনেটর পদে বহুদিন এই রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনিই ছিলেন সাউথ ডাকোটার মুখ এবং কণ্ঠস্বর। এই পিটার নরবেকই টাকাকড়ির ব্যবস্থা করে শিল্পী গাটসন বোর্গলামকে (Gutzon Borglum) মাউন্ট রাশমোরের সুবিশাল ভাস্কর্য্যের কাজে নিযুক্ত করেন। তাঁর নামেই এই ৬৬ মাইল লম্বা অসম্ভব সুন্দর পিটার নরবেকে সিনিক বাইওয়ে। কাস্টর স্টেট্ পার্কও তার সুকর্মের নিদর্শন। সাউথ ডাকোটার মানুষ তাকে বলে অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এক সাধারণ মানুষ (An Ordinary Man with an Extraordinary Vision). প্রকৃতিপ্রেমী মানুষটি বলতেন এই পথ দিয়ে যারা ঘণ্টাপ্রতি ৬০ মাইল বেগে গাড়ি চালায় তারা জানে না তারা কি হারালো। এই রাজার ঐশ্বর্যের খানিক হদিশ পাওয়া যায় ঘণ্টাপ্রতি ২০ মাইল বেগে গাড়ি চালালে আর পুরোপুরি অনুধাবন করা যায় গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হাঁটলে।

কাস্টরে আমার হোটেলে চেক ইন করে জিনিসপত্র রেখে হাত মুখ ধুয়ে, ইলেক্ট্রিক কেটলিতে পছন্দসই চা বানিয়ে ফ্লাস্কে ভরে নিলাম। এছাড়া ব্যাকপ্যাকে রয়েছে দূরবীন, বিস্কুট আর অল্প স্বল্প শুকনো খাবার। দোতলার ওপরে ছিমছাম ঘর। সামনে  বড় কাঁচের জানালা দিয়ে দূরের পাহাড় দেখা যায়। জানালার বাইরে টানা বারান্দা। সেখানে কাঠের চেয়ার পাতা রয়েছে। আমি বেরিয়ে পড়লাম। তখনও  ঘন্টা ছয়েক বাইরে আলো থাকবে।

বাজ চলেছে রুট ১৬ এ ধরে। পথের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা ছোট নদী যার নাম ফ্রেঞ্চ ক্রিক। আমি পেরিয়ে যাচ্ছি স্টকডেল লেক যেখানে গর্ডন স্টকডেল ১৮৭৪এ সোনার খোঁজে এসে তাবু গেড়েছিল। এইখানে একটা দক্ষিণমুখী বাঁক  নিয়ে দেখে এলাম হট স্প্রিংস, দেখে এলাম ম্যামথ সাইট। এই ম্যামথ সাইট হল একটা অসাধারণ প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা যার ভেতরে এখনো খননের কাজ চলছে। আবিষ্কৃত হচ্ছে জীবাশ্ম সংক্রান্ত নানা নিদর্শন। এইখানে তিনটি উলি ম্যামথের ফসিল রয়েছে। আমার সূর্যসীমিত সময় এই সংগ্রহশালা ভালোভাবে দেখার জন্য যথেষ্ট ছিলো না। আমার মন তখন অতীতে নয় ভবিষ্যতে। কাস্টার ন্যাশনাল পার্কে অপেক্ষমান বাইসনের দল আমাকে ডাকছিলো।

হট স্প্রিংস থেকে এবার উত্তরমুখী যাত্রায় কাস্টার স্টেট পার্ক। গেটের কাছে আমার সামনে আরো দুটো গাড়ি। স্টেট্ পার্কের এক কর্মী গাড়ির কাছে এসে টিকিট বিক্রি করছিলেন। আমার পালা আসতেই আমি তো বীরবিক্রমে আমার লাইসেন্স আর আমেরিকা দা বিউটিফুল কার্ড এগিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখানে চিচিং ফাঁক হলো না!

'Sorry this is a state park. Your card allows entry to national parks only!’

বুঝলাম এখানে একটা মোদী-মমতা বিভেদ রয়েছে। এন্ট্রি ফি বুঝে নিয়ে উনি আমাকে পার্কের  ম্যাপ দিয়ে গাড়ির উইন্ড স্ক্রিনে একটা টিকিট সেঁটে দিলেন। ভিসিটর সেন্টারের অমায়িক ভদ্রমহিলা বলে দিয়েছিলেন

‘When you enter Custer State Park, travel north on Wildlife Loop Road until you hit Iron Mountain Road. Make sure you travel from south to north on this road. You will go through some tunnels that will frame Mount Rushmore like a picture.’

তা আমি তো ওনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে জঙ্গলের পথ ধরে উত্তরমুখো চলেছি। পাশে চলেছে বরষাপুষ্ট ছোট ছোট ঝর্ণা, পথের ধারে ফুটে রয়েছে বনফুল, পাহাড় আঁকড়ে  মাথা তুলেছে উদ্ধত পাইন, কখনো চকিতে দেখা দিচ্ছে সোনার হরিণ। কে বলবে পৃথিবীতে কেউ কারো সঙ্গে বিবাদ করে। ঘড়িতে প্রায় সন্ধ্যে ৬টা  বাজে কিন্তু তখনও সূর্য স্বমহিমায়। হঠাৎ দেখি লুপ রোডে বিকট ট্রাফিক জ্যাম। আমার সামনে লম্বা গাড়ির লাইন। অপর প্রান্তের গাড়িও আটক। পথের মাঝখানে আর দুইপাশে জমি দখল করেছে বিরাট বাইসনের দল। বাইসন ছানারা হালকা বাদামি বাছুরমার্কা চেহারা নিয়ে নেচে কুঁদে বেড়াচ্ছে আর পরিবারের বড়রা গম্ভীর মুখে ঘাস খাচ্ছে আর ল্যাজ দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে। কয়েকটা ক্ষুদে পাখি বাইসনগুলির মাথায়, পিঠে বসে পোকা খুঁটে খাচ্ছে। পথরোধকারীদের কোনোরকম তাড়াহুড়ো নেই রাস্তা দেবার। মনে হচ্ছে স্প্লানেড ইস্টে কোনো রাজনৈতিক দলের মহাসভা চলছে। যাই হোক, বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করবার পর একটু একটু করে এগিয়ে কোনোরকমে সেই ট্রাফিক জ্যাম থেকে মুক্তি পাওয়া গেল। পিটার নরবেকের উৎসাহেই  আয়রন মাউন্টেইন রোড তৈরী হয়। তিনি চেয়েছিলেন  কালো পাথরের পাহাড় ডিনামাইট দিয়ে ফাটিয়ে এমন এক পথ তৈরী করবেন যাতে তিনটি স্তরে  থাকবে তিনটি সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গপথ থেকে বেরোলেই সামনে দেখা যাবে ছবির ফ্রেমের মত বাঁধানো  মাউন্ট রাশমোর। নরবেকের অভিধানে  অসম্ভব বলে কোনো শব্দ ছিলো না। তাই বাঘা বাঘা ইঞ্জিনিয়াররা যখন তাকে নিরাশার বাণী শোনাচ্ছিলেন তখন সেই ডিপ্লোমা বয়েসদের (Diploma boys) কথা অগ্রাহ্য করে তিনি এই কাজের ভার দেন কাস্টার স্টেট পার্কের সুপারিন্টেন্ডেন্ট গিডিয়ন সাহেবকে। গিডিয়ন ১৩ বছর বয়েসে লেখাপড়া ছেড়ে চার দেওয়ালের বাইরে জীবনের কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত। তিনি এই আশ্চর্য্য রাস্তাটির নকশাকার আর রাস্তাটি ১৬ জন মানুষের সাহায্যে এক বছর ধরে তৈরী করেন পরবর্তী সুপারিন্টেন্ডেন্ট ওয়েন ম্যান। ১৯৩৩ সালে এই রাস্তা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

আয়রন মাউন্টেইন রোডের ১৭ মাইল পিটার নরবেকের উপদেশ মতো ঘণ্টাপ্রতি ২০ মাইল বেগে চালাচ্ছিলাম। পাহাড়ি রাস্তার একধারে ঘন পাইনের বন আর অন্যধারে খাদ। দিনশেষে এমনিতেই সূর্যের আলো কমে এসেছে , তার ওপরে ঘন জঙ্গল। রাস্তার পাশে এক হরিণী তার দুটি সন্তানকে নিয়ে খেলছিল। আমাকে দেখে  চমকে তাকালো। মুগ্ধ হলাম সেই চাউনিতে। পথে তিনটে কাঠের পিগটেল ব্রিজ পড়ল, ১৪টা  সুইচব্যাক বা ১৮০ ডিগ্রি কার্ভ, আর তিনটে আশ্চর্য্য সুড়ঙ্গ যার থেকে বেরোলেই তিনটে ভিন্ন ভিন্ন স্তরে ছবির ফ্রেমের মত বাঁধানো মাউন্ট রাশমোর। ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন পিটার নরবেক... অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এক সাধারণ মানুষ (An Ordinary Man with an Extraordinary Vision).  সেই আমার গায়ে কাঁটা  দিচ্ছিলো। সেই ১৯৩৩ সালের রাস্তা এখনো একই রকম জাদুময়। একেবারে  মাউন্ট রাশমোরের পায়ের কাছে পৌঁছে দেখলাম গাটসন বোর্গলামের সুবিশাল সৃষ্টি। আলো কমে আসছে। এবার ফিরতে হবে। আবার সেই জঙ্গলের পথ ধরে সেই তিনটি সুড়ঙ্গ, তিনটি পিগটেল ব্রিজ পেরিয়ে এবার  চলেছি দক্ষিণে... আয়রন মাউন্টেইন রোড পেরিয়ে আবার ওয়াইল্ড লাইফ লুপ রোডে এগোচ্ছে বাজ বাহাদুর।

হেড লাইটের আলোয় ঝলসে উঠছে বাইসনের চোখ, আমার অন্তর জুড়ে রয়েছে পাইনের জঙ্গল, বনফুলের সুবাস আর অসমসাহসী অসাধ্যসাধক সাধারণ মানুষেরা।

 

'আলো –অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে

স্বপ্ন নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে!

স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,

হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!

আমি তারে পারি না এড়াতে,

সে আমার হাত রাখে হাতে;

সব কাজ তুচ্ছ হয়, -পণ্ড মনে হয়,

সব চিন্তা – প্রার্থনায় সকল সময়

শূন্য মনে হয়,

শূন্য মনে হয়!

 

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!

কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে

সহজ লোকের মতো !তাদের মতন ভাষা কথা

কে বলিতে পারে আর! - কোনো নিশ্চয়তা

কে জানিতে পারে আর? – শরীরের স্বাদ

কে বুঝিতে চায় আর? - প্রাণের আহ্লাদ

সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!

সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর

স্বাদ কই!- ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,

শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,

শরীরে জলের গন্ধ মেখে,

উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে

চাষার মতন প্রাণ পেয়ে

কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর’ পরে?

স্বপ্ন নয়, - শান্তি নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে

মাথার ভিতরে!'

কাস্টার শহরে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত  পৌনে ৯টা বাজল। ছোট্ট শহর। সন্ধ্যের পরেই কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব। এদিকে দুদিন ধরে  হানি মাস্টার্ড দেওয়া টুনা স্যান্ডউইচ খেয়ে মনটা ভাত ভাত করে আকুল হচ্ছে। রেস্তোরাগুলো ঝাঁপ বন্ধ করবার মুখে। টিপটিপে বৃষ্টিতে দেখলাম একটা দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে মারিয়া'স মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট। ভেতরে কয়েকজন খদ্দের খাওয়া দাওয়া করছে। মেক্সিকান মানেই তো মশলাপাতি দেওয়া রান্না, বিন্স আর ভাত… আর ভাত... আর ভাত। মনের ভেতর কমল হাসান 'ও মারিয়া ও মারিয়া' গেয়ে নাচতে লেগেছে। ডিম্পলের পরনে হলদে লেসের জামা আর মাথায় ঘন মেঘের মত  ঢেউখেলানো চুল।

‘Table for one please.’

এক কিশোর আমাকে টেবিল দেখিয়ে দিলো। বোধ হয় মারিয়ার ছেলে।

'Our kitchen  will close soon. Are you ready to order now?’

ঝটপট মেনুতে চোখ বুলিয়ে ভাতের ছবি দেওয়া একটা রান্না বেছে নিলাম।

‘I will have a chicken fajita. It comes with a side of rice right?’

‘Yes it does. Would you like something to drink? ’

‘Just a glass of water with one cube of ice please.’

‘Sure.’

ছেলেটি মুচকি হেসে চলে গেল।

আমি চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখছি। দেওয়ালের রং উজ্জ্বল কলাপাতা সবুজ। একটা মেক্সিকান বাজারের ছবি রয়েছে। দু তিনটি ছাপোষা পরিবার রাতের খাওয়া সারছে। এরা কেউই আমার মতো টুরিস্ট নয়। স্থানীয় মানুষ। তারাও মাঝে মাঝে আমাকে দেখছিল আর চোখাচোখি হলে মৃদু সৌজন্যমূলক হাসি বিনিময়।

মারিয়া যে চমৎকার রাঁধুনী তার পরিচয় পেলাম কয়েক মিনিট পরে। প্রাণভরে চেটেপুটে সব খেয়ে যখন প্লেট ফেরত দিলাম তখন তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো না যে আর ধুতে লাগবে!

ঘুম ভাঙলো ভোরবেলা। তখন সবে আলো ফুটবে ফুটবে করছে। আমি হাত মুখ ধুয়ে, গরম চা আর দুটো বিস্কুট নিয়ে বাইরে টানা বারান্দার কাঠের চেয়ারে এসে বসলাম। চারিদিকে কেউ কোত্থাও নেই। পাখির ডাক ছাড়া কোনো শব্দ নেই।  সামনের পাহাড়গুলি তখনও কুয়াশার পর্দানশীন। প্রথম আলোর রাঙা আদরে তাদের ধীরে ধীরে লাজ ভাঙছে।

'ছিলো মন তোমারি প্রতিক্ষা করি

যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,

ছিলো মর্ম বেদনাঘন অন্ধকারে

জন্ম-জনম  গেল বিরহ শোকে

বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে।'

চা খেতে খেতে  দিনের প্ল্যানটা গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। আজকে অনেকটা পথ যেতে হবে। কাস্টার  থেকে  কোডি ৩৫০ মাইল  পথ। পৌঁছতে প্রায় ৬ ঘন্টা সময় লাগবে। কোডি হলো ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের পুবদিকের গেটের ঠিক বাইরে, ছোট একটা শহর। সেখানে শোসন নদীর ধারে, একটা লগ ক্যাবিনে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করেছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম এই যে টানা কয়েকদিন ধরে সূর্যোদয় থেকে  সূর্যাস্ত পর্যন্ত একনাগাড়ে গাড়ি চালাচ্ছি, বাক্স প্যাটরা বয়ে এক হোটেল থেকে অন্য হোটেলে যাচ্ছি, সমস্ত বোধশক্তি দিয়ে শুষে নিচ্ছি পৃথিবীর রস... আমার শরীরে মনে কোনো ক্লান্তি নেই কেন? আমি তো আর তরুণ-তুর্কী  বসন্ত-মুরগী  নই! এই অমানুষিক শক্তি আসছে কোথা থেকে? পথের কোন  অমোঘ টান আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূর দূরান্তরে?

'বুঝি না ঠিক কিসের জন্যে এতটা পথ

এমন করে ছুটে এলাম।

বুঝি না ঠিক কার বিরুদ্ধে এত যুঝি,

এই ধুলো-জঞ্জালের মধ্যে কাকে খুঁজি,

উড়িয়ে দিয়ে সকল পুঁজি কাকে পেলাম।

প্রশ্ন জাগে, কিসের জন্যে এতটা পথ

এমন করে ছুটে এলাম।'

স্নান সেরে জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে হোটেলের ডাইনিং রুম। এইটিই এই সফরে প্রথম হোটেল যেখানে হট ব্রেকফাস্ট দেওয়া হচ্ছে। টেবিলে সাজানো স্ক্র্যাম্বল্ড এগ, বেকন, সসেজ, নানা রকম রুটি, ফল, দই, সিরিয়াল, জুস্, চা, কফি। ডাইনিং রুমে অনেকেই ব্রেকফাস্ট খেতে এসেছে। একজন গিন্নিবান্নি মহিলা হাসিমুখে শেষ হয়ে আসা খাবার পাত্রগুলি আবার ভরে ভরে দিচ্ছেন। আমি ভালো করে পেট ভরে খেয়ে দেয়ে, বাজের ভরপেট খাবার ব্যবস্থা করে ইন্টারস্টেট ৯০ ধরে পশ্চিমপানে এগোলাম।

পথের পাশের শহরগুলি পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। পেরিয়ে যাচ্ছি নিউক্যাসেল, ওসেজ, ক্লে স্পার, পেরিয়ে যাচ্ছি থান্ডার বেসিন ন্যাশনাল গ্রাসল্যান্ড। এবার নতুন রাজ্য ওয়ায়োমিং। পিছনে রয়ে গেল সাউথ ডাকোটা। পাহাড়, পাইনের জঙ্গল সব পিছনে রয়ে গেল... সব পিছনে রয়ে গেল... এখন কেবল ঘাসজমি আর ধু ধু প্রান্তর।

'পিছে রয়ে গেলো ঘরবাড়ি লণ্ঠন

স্বর্ণচাঁপার গাছ

উদাসিনী, বলো পথে অনন্যমন

আছে কি তীরন্দাজ?'

পুবদিকের বিশাল সমভুমি আর পশ্চিমদিকের বিস্তীর্ণ বৃক্ষবর্জিত, সেজব্রাশে  ঢাকা  প্রান্তরের (sagebrush steppe) মধ্যবর্তী অঞ্চল এই থান্ডার বেসিন ন্যাশনাল গ্রাসল্যান্ড। একে লালন করে পাউডার নদী। এই অঞ্চলের বাসিন্দারা বেশির ভাগ পশুপালনে জীবিকানির্বাহ করেন। পথ চলতে চলতে মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে থামি, দু দণ্ড চোখ ভরে প্রাণ ভরে দেখি, মাটি কাঁপিয়ে রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া বিশাল মালবাহী ট্রাকের গতি অনুভব করি, তারপর আবার চালকের আসনে। এর মধ্যে আমি ক্রুইজ কন্ট্রোলে বাজকে চালানো গুগলে ভিডিও দেখে শিখে নিয়েছি। প্রথমদিন অতক্ষণ ব্রেক একসিলেরাটর চাপাচাপি করে ডান পা টনটন করছিল।  আমি এতদিন গাড়ি চালিয়েছি কিন্তু কোনোদিন ক্রুইজ কন্ট্রোল ব্যাপারটা ব্যবহার করিনি। হয়তো আমার চলনের গতিসিদ্ধান্ত গাড়ির ওপরে ছেড়ে দিতে মন সায়  দেয়নি। হয়তো ঠিক দু হাজার মাইল গাড়ি চালাবো ভেবে কোনোদিন পথে নামিনি। যাই হোক, এখন শিখলাম... বাজকে দায়িত্ত্ব সঁপে, ডানপাটিকে খানিক বিশ্রাম দিলাম।

বাজ চলেছে  তীরবেগে। এখন চারিদিকে ধু ধু প্রান্তর। সূর্যের তাপ প্রখর। বিগহর্ন  পাহাড়ের গা ঘেঁষে পেলাম একটা ছোট্ট শহর। তার নাম টেন স্লীপ (Ten sleep)  অর্থাৎ দশ ঘুমের শহর। নাম শুনেই তো আমি প্রেমে! শোনা যায় ফোর্ট লারামি  (Fort Laramie) থেকে এই জায়গাতে আসতে তখনকার দিনে দশ দিন লাগত। তাই দশ ঘুমের পরে যেখানে পৌঁছনো যায় তার নাম তো টেন স্লীপই হবে। এতে আর আশ্চর্য্য কি?

এরপর আরেকটু ঘরোয়া রাস্তা ধরতে হলো WY-31 W থেকে স্টেট্ হাইওয়ে  789 N। আবার পাল্টে গ্যাছে দৃশ্যাবলী। সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তর পেরিয়ে এখন দুদিকেই লালচেপানা খাড়া পাহার। পেরিয়ে যাচ্ছি বিগ হর্ন নদী। নদীর নীলে সূর্যের আলো খাঁজকাটা কমলহীরের মত চমকাচ্ছিল। এতো সুন্দর চারিদিক যে হতবাক লাগছিল। এই সুন্দর হয়তো এমনভাবে আর কোনোদিন দেখতে পাবো না ভেবে বিষণ্ণ লাগছিলো।

কোথাও কোনো সুন্দর জিনিস দেখলেই মায়ের কথা মনে পড়ে। আমার মা বড় দীর্ঘ অসুস্থতা সহ্য করে চলে গেছেন। এতটা কষ্ট তার প্রাপ্য ছিলো না। আমার ভাই প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল তাকে সুস্থ করে তোলার... তাকে যথাসম্ভব ভাল রাখার। কিন্তু মায়ের অসুখ সেই সব চেষ্টার নাগাল ছাড়িয়ে ছুটছিল। আমি ছয় মাস পরপর কলকাতা গিয়ে দেখতাম তার নিভে যাওয়া।

ভাই ভাবতো তবু তো মা আছে...

আমি ভাবতাম মায়ের এভাবে থাকাটা মাকে মানায় না।

মা যখন চলে যায় তখন আমরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম। মানুষটা খুব ভোরবেলা একেবারে চুপচাপ রাইলস টিউব, ক্যাথিটার, নার্স, আয়ার পরিবেষ্টন সরিয়ে চলে যায়।

গাড়ি চালাতে চালাতে চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে... এখন এই পথে, এই নদীতে, এই পাহাড়ে, এই প্রান্তরে আমার মায়ের ছায়া... এখন আমার মায়ের শরীরে রোগের  চিহ্নমাত্র নেই। মায়ের খোঁপায়  জুঁই ফুলের মালা, গায়ে ঠান্ডা জলের গন্ধ, মুখে আমার চেনা হাসি।... এখন মা তার জীর্ণ শরীর ছেড়ে আমার প্রতিটি কোষে প্রতিটি অনুভবে, প্রতিটি রক্তবিন্দুতে মিশে রয়েছে। যিনি আমাকে একদিন ধারণ  করেছিলেন আজ আমি তাকে ধারণ করে আছি। তিনিই আমার শক্তির আকর, আমার আলোর উৎস। আমি অমৃতস্য পুত্রী।

 

(ক্রমশ)

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন