কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন

 


পর্ব ১

 

(গোড়ার কথা)  

 

ধরাম করে বোমাটা ফাটল ঠিক ট্যাক্সির পেছনে। পেছনে বসা ভদ্রলোক চেপে ধরলেন স্ত্রীকে। ভদ্রমহিলা অন্তঃসত্ত্বা। নয় মাস চলছে। স্বামীর মুখ শুকনো। একটা ঢিল উড়ে এসে এবার ভেঙে দিল কাঁচ। মহিলা দৃঢ় প্রত্যয়ে বসে। আদেশ করলেন গাড়ি না থামাতে। একসময় এগিয়ে এলো পুলিশ। মহিলা ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দিলেন তাদের। অবিরাম গুলি ও বোমা বৃষ্টির মধ্যে দম্পতি পৌঁছে গেলেন গন্তব্যে। রাত দশটা। স্হান মধ্য কলকাতা। নকশাল আন্দোলন পুরোদমে। মহিলা নিঃশব্দে সমর্থন করছেন এইসব তরতাজা যুবকদের সম্ভবত। রাত বাড়লে ব্যথা বাড়ে। বনেদি বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারের বউ। বড়-জা আমল দেন না। অমন হয়। আরো বাড়ে ব্যথা। -‘দেরি আছে’।

অবশেষে গর্ভজাত সন্তানের মাথা বেরিয়ে আসার উপক্রম। ভাঙা কাঁচের টুকরো ভরা পথ আর বোমার আওয়াজের ভেতর কাছের নার্সিংহোমে ডাক্তার বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে জন্ম হল এক কন্যা সন্তানের। রাত বারোটা। শনিবার। মেয়েটির ললাট লিখন বোধহয় সেদিনই স্থির হয়ে গেল। সংঘাত আর বিরুদ্ধতা।

এই বাড়িতে কোনো কন্যাসন্তান নেই, তাই জন্মের পরে বাড়িতে চাঁদের হাট বসেছিল। তিন ঠাকুমা তিন দাদু, দুজন করে কাকা জ্যাঠা জেঠিমা কাকিমাদের কোল থেকে কোলে বড়ো হতে লাগল শিশুটি।

তিনতলা বাড়ি লাল রক, ঢুকতেই সামনে চক বাঁধানো চাতাল। একটি বিশাল সারমেয়, দুটি বিদেশি, নানা রকম পাখি - চন্দনা, বদরি, পায়রা। বিরাট কাঁচের বাক্সে মাছ, যার যা পছন্দ, সঙ্গে আছে পায়ে পায়ে বেড়ালও দুটি। সব মিলিয়ে যেন আনন্দবাজার এই বাড়ি।

বজবজের জমিদারি ছেড়ে বাড়ির অমতে কলকাতা এসে রিজার্ভ ব্যাংকে প্রথম চাকুরি এই বাড়ির প্রতিষ্ঠাতার। তিনি গত হয়েছেন। ছেলে ও জ্ঞাতিরা ক্রমে কলকাতায় স্থিতু। এদেশিয় অর্থাৎ ঘটি এনারা সকলেই।

মেয়েটির নাম নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। সকলেই একটি করে নাম রাখেন, চান তাঁর দেওয়া নামটি গৃহীত হোক। সুদেষ্ণা, মিতুল, চন্দ্রমণি, অবশেষে টিঁকে গেল জয়িতা। ঘরোয়া নাম জুন। মহিলা অবশ্য কায়মনোবাক্যে পুত্র সন্তান কামনা করেছিলেন। তবু এই প্রথম একটি কন্যা সন্তানের সেই বাড়িতে এত ধুমধাম করে অন্নপ্রাশন হলো।

এই সবকিছুর মধ্যে সদ্যজাতা মা’টির পড়াশোনায় ইতি পড়ে গেলো নিঃশব্দে।  ক্রিশ্চিয়ান কলেজ, ভূগোল অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় বসা হলো না।

সন্ধ্যা হলে বাড়ির মহিলারা গা ধুয়ে পাটভাঙা শাড়ি পরে চুল বেঁধে পান খেয়ে ঠোঁট রাঙাতেন। একসঙ্গে গল্পগাছা। ঠাকুর এসে রান্না বসাত। বাবুরা চাকরি করে বাড়ি ফিরবেন কেউ, তারও পরে আড্ডা দিয়ে একটু বিলম্বে। এই বাড়ির সকল পুরুষ সদস্যই নিজের নিজের স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে পেরেছিলেন। ছিলেন একজন শুধু ব্যতিক্রম।

নকশাল আন্দোলনের প্রধান নেতারা এইসময় হয় খুন হয়ে গেলেন, নয় তো লা-পাতা। পুলিশের নির্মম অত্যাচারে কেউ কেউ ভীত হয়ে বিদেশে পালালেন, কেউ শান্ত শিষ্ট নাগরিকের মুখোশ পরে নিলেন চোখের সামনে একের পর এক রাষ্ট্রীয় হত্যা দেখে।

নকশালবাড়ি আন্দোলন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। স্মৃতির পাতায় রয়ে গেল রক্তাক্ত দিনগুলি।

 

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন