কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


শান্তদার সিনেমাটিক টোটকা


জীবনে নানা রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। সবাইকে সেসব শোনাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সত্যি ঘটনা শোনাতে গেলে মুলত দুটো সমস্যা হয়। তাতে addition বা deletion করা যায় না।

তার ফলে একদিকে যেমন এক্স্ট্রা নাটকীয়তা জুড়ে গল্পটাকে আকর্ষণীয় করে তোলা যায় না, তেমন আবার আপত্তিজনক অংশ বাদ দেওয়া যায় না। কেটে ছেঁটে অশ্লীল ব্যাপার স্যাপারও বাদ দেওয়াও যায় না। সে সব করতে গেলে সত্যিটা কাহিনী আর সত্যি থাকে না। মিথ্যে বানানো গল্প হয়ে যায়। আজ আমি ঠিক করেছি মন শক্ত করে আপনাদের একটা সত্যি ঘটনা শোনাবো। তাতে নো এ্যডিশন নো ডিলিশন এবং নো সেন্সর। ঘটনাটা দূর অতীতের।

এতদিন পরে বলছি তাই পাত্র পাত্রীদের বিব্রত করা হবে না। এটা আমার জীবনের চাইবাসা পর্বের ঘটনা। কাজ করতুম একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে। সে সময় আমাদের ব্যাঙ্কে ম্যাসেঞ্জার বা ডেসপ্যাচম্যান বলে একটা পোস্ট হতো। তাদের কাজ ছিলো ব্যাঙ্কের জরুরি চিঠিপত্র ডকুমেন্ট এই সব ঘুরে ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া। আমাদের চাইবাসা শাখায়ও সেরকম‌ একজন ছিলো। পোস্টটা অস্থায়ী। সেই পোস্টে কাজ করতো শ্যামল ঘোষ বলে একজন। লম্বা চওড়া সুন্দর  স্বাস্থ্যবান ছোকড়া। বেশ হাসিখুশি। তবে গরীব পরিবারের ছেলে।

চাইবাসার আসে পাশে অনেক খনি খাদান আছে। তাদের ব্যাঙ্ক একাউন্টে মোটা মোটা এমাউন্টের চেক জমা পড়ে। তারা চায় সে সব চেক চটজলদি ক্লিয়ারেন্স  হোক। তখন আজকের মতো ইলেকট্রনিক ক্লিয়ারেন্স হতো না। সব ম্যানুয়াল।  আমাদের ডিসট্রিক ক্লিয়ারিং হাউস ছিলো জামশেদপুর শহরে। চেক ক্লিয়ারেন্সের জন্য সেখানে পাঠানো হতো। সেখানে দিনে দিনেই চেক ক্লিয়ার হয়ে যায়। আমাদের ম্যাসেন্জার বয় শ্যামল রোজ চাইবাসা জামশেদপুর যাতায়াত করে সেই কাজটা সম্ভব করে তুলতো। চালাক চতুর ছেলে, কিন্তু সমস্যা হলো ওর চাকরিটা পাকা নয়। ইনকাম অবশ্যি খুব একটা খারাপ না। ডেলি ওয়েজ। কিন্তু ট্রাভেলিং বাবদ যে পয়সা দেওয়া হয়, একটু কষ্ট করলে তার থেকে অনেকটাই বাঁচে। পার্টিরাও বখশিস হিসেবে কিছু দেয়। তবু পাকা চাকরি হলো গিয়ে পাকা চাকরি। শ্যামল তাই অধীর আগ্রহে নিজের চাকরি পাকা হবার অপেক্ষা করতো।  তবে ওর একটা সমস্যা ছিলো। লেখাপড়া প্রায় কিছুই জানে না, যাকে বলে ‘ক অক্ষর গোমাংস’, তাই। আমরা আফসোস করতাম, নিদেন পক্ষে একটা  কিছু  পাশের কাগজ যদি থাকতো, সৎ পরিশ্রমী ছেলেটার পাকা চাকরি হয়ে যেত। ওকে আমরা ধমকাতাম।  - পড়াশোনা করিসনি কেন রে হতভাগা? এরকম ধমক শুনতে শুনতে একদিন আমার কানের কাছে মুখ এনে শ্যামল বলেছিলো,  পড়াশোনা হবে কী করে? আমি কি বাবা মায়ের আসল ছেলে নাকি? বাবা বেঁটে,  মা বেঁটে আমি ইয়া ছ’ফুটিয়া গলদা জোয়ান। এটা হয় কী করে? এ্যাঁ? আসলে বাবা আমাকে জঙ্গলে কুড়িয়ে পেয়েছিলো। কুড়িয়ে পাওয়া ছেলের কি কখনো বিদ্যে হয়?

শুনে আমরা তো অবাক।

- বলিস কিরে হারামজাদা?

কাচুমাচু মুখ করে শ্যামল বলতো-

- তয় আর বলছি কী?

ঘুরতে ঘুরতে, এর ওর তার মুখ হয়ে কথাটা শ্যামলের মায়ের কানেও পৌঁছাল। শুনে শ্যামলের মা তো ক্ষেপে আগুন। একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন,

হারামজাদা শ্যামলাটা নিয্যশ মিছে কথা বলছে। তোমরা ওর কথায় কান দিও নি। আমার নিজের পেটের ছোয়াল ও। দেখতে বড় সড়ো হয়েছে - সে ঠাকুরের দয়া। এমন কি কারোর হয় না? কে কোথায় ঠাট্টা করে কি বলে দিয়েছে, বোকাটা সেটাই মনে গেঁথে নিয়েছে।

নিন্দুকেরা অবশ্যি শ্যামলের মায়ের এই কথাটা শুনে খিক খিক করে হেসে উঠেছিলো। বিশ্রি ইঙ্গিত করে চোখ মটকে বলেছিলো, কৃপাটা যে সে ঠাকুরের নয়,  সেটা ঠিকেদার ঠাকুর সাহেবের।

ঠাকুর সাহেব আমাদের ব্যাঙ্কের বহু পুরনো কাস্টমার। লম্বা চওড়া তবে জোয়ান নন। বয়স হয়েছে উনার। ব্যাঙ্কে আসেন কিন্তু শ্যামলের প্রতি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখিনি কোনোদিন। জনশ্রুতি একদা তার সাথে... না থাক। লোকের আজেবাজে কথায় কান দেওয়া অনুচিত।

সেই শ্যামলের একসময় বিয়ে হয়ে গেলো। বহু দূর গঞ্জের মেয়ে। কাছে পিঠে কে  মেয়ে দেবে ওকে? বিয়ে করে শ্যামল খুব খুশি। কিন্তু খুশিটা বেশিদিন থাকলো না। একসময় আমরা লক্ষ করলাম, শ্যামল দিনে দিনে মনমরা হয়ে যাচ্ছে।

টাকা পয়সা নয়। অন্য কিছু একটার অভাব।

সেভাবেই তার দিন কেটে যেতে লাগলো। দুঃখ সয়ে সয়ে যেমন আর পাঁচটা লোকের দিন যায়। আমাদের সবার চেষ্টায় শ্যামল নাম সই করা শিখলো। ইংরেজি আলফাবেট চিনলো। নাম্বার চিনলো। তারপর ছোটো ছোটো শব্দ দিয়ে বাক্য নির্মাণ শিখে গেল। তারপর শেখানো হলো যোগ বিয়োগ অঙ্ক। আমরা শ্যামলের পাকা চাকরির জন্য ব্যাঙ্কের সবাই সক্রিয় হয়ে ছিলাম। শুধু শ্যামলের মায়ের অন্য এক কাঁদুনি।

- বিয়ের বছর হতে চললো। ছ্যেলা পুলার কোনো খপর নাই।

মায়েদের এরকম আফশোস করতে অবশ্যি অনেক শোনা যায়। আমরা পাত্তা দিলাম না।

অবশেষে এলো সেই সুদিন। না না। শ্যামলের ছেলেপুলের হবার খবর নয়। এলো শ্যামলের পাকা চাকরির খবর। ফোনে পাটনা থেকে ইউনিয়নের সেক্রেটারি আমাকে খবরটা দিলেন।  - এক অচ্ছি খবর হ্যায়। শ্যামলুয়াকা নৌকরি পক্কা হো গিয়া।

সেদিনও শ্যামল রোজকার মতন ক্লিয়ারিংএর চেক নিয়ে জামশেদপুর গেছে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আগাম খবর দিতে আমি ব্যাঙ্ক ছুটির পর শ্যামলদের বাড়ি চলে গেলাম। ওর মা সে সময় বাড়ি ছিলো না। ছিলো বউ। শ্যামলের বউকে এই প্রথম দেখলাম। ঘরোয়া পোষাকে। শ্যামলা রং। মিষ্টি চেহারা। শ্যামলের তুলনায় ছোটোখাটো। মাথা ভর্তি চুল।

ঘরে ঢুকে সুখবরটা দিতেই শ্যামলের বউ নীচু হয়ে আমার পা ছুঁয়ে নমস্কার করতে এগিয়ে এলো। প্রবল সঙ্কোচে পা সরিয়ে নিলাম। ওর দু কাঁধে হাত দিয়ে ওকে নিরস্ত করতে চাইলাম। থর থর করে কেঁপে উঠলো সে। ছিটকে উঠে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে পড়লো। দেখলাম ঘরের ভেতরের আবছা আলোয় ভীত শঙ্কিত  একটা মুখ। চোখদুটো চেপে বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলে চলেছে, আমাকে ছেড়ে দিন! আমাকে ছেড়ে দিন! আমি আপনার বোনের মতো। আপনার পায়ে পড়ি আমাকে ছেড়ে দিন!

সর্বনাশ‌! এ মেয়ে বলে কি? ধরিইনি তো ছাড়বো কি?

আলো আঁধারি ঘরে শুধু আমরা দুজন। যে কেউ শুনবে, ঠিক ধরে নেবে আমিই  মন্দ কিছু করেছি। দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে এলাম। পা চালিয়ে সোজা নিজের মেসে ফিরে এলাম।

রাতে বাড়ি ফিরে শ্যামল খবরটা পেয়ে ছুটে এলো আমার মেসে। চাকরির বিস্তারিত খবর জানতে। সে সবই জানালাম। তবে ওর বউয়ের ঐ বিচিত্র ব্যাবহারের কথাটা জানাতে পারলাম না। আমাদের অফিসের সিনিয়র স্টাফ শান্তনু সরকার। আমাদের সবার মুস্কিল আসান শান্তদা। শান্তদা একদিন আমায় বললেন-

- বুঝলি, শ্যামলের ছেলে পুলে হতে মুস্কিল আছে। ওর বউতো ওকে কিছুতেই  কাছে ঘেঁষতে দেয় না। গায়ে হাত দিলেই ভয় টয় পেয়ে শ্বাশুড়ির কাছে পালিয়ে যায়। মাথায় ছিট আছে বউটার।

তারপর একটু চিন্তিত স্বরে বললেন-

- নাকি অন্য কোনো ব্যাপার? কে জানে!

শ্যামলের বউয়ের সেদিনের ব্যবহারের কথাটা মনে আমার মনে পড়ে গেল। শান্তদাকে সেটা জানালাম। শান্তদা বলে উঠলেন-

- বলিস কি? তাই যদি হয় তবে তো ভালো করে খোঁজ নিতে হবে!

গোপন খবরটা প্রকাশ্যে এলো আরো পরে। শান্তদাই গভীর গোপন তদন্ত করে জেনেছিলেন। খুবই দুঃখজনক খবর। শ্যামলের বউটা রেপ ভিক্টিম। সেই ভয়ঙ্কর দূর্ঘটনার পর থেকেই পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাতে তার প্রবল আতঙ্ক। শ্যামলকে একদিন আমাদের ব্যাঙ্ক বিল্ডিংএর ছাতে নিয়ে গিয়ে শান্তদা চেপে ধরলেন। জেরার মুখে শ্যামলও স্বীকার করলো সব কথা। খানিক চিন্তা টিন্তা করে শান্তদা জানালেন-

- ঘাবড়াস না। আমি সব ঠিক করে দেবো। বিষে বিষক্ষয় জানিস তো? সেই পদ্ধতিতেই ঠিক হবে।

হিন্দি সিনেমার পোকা শান্তদা। বাড়ির পাশেই সিনেমা টকিজ। প্রায় রোজই সিনেমা দেখেন শান্তদা। তার সিনেমা দেখাটাও বেশ মজার। একটানা নয়। বারেবারে একটু একটু করে। বিনে পয়সায়। হলের পাশের প্রতিবেশী বলে কথা!

রেগুলার সিনেমা দেখতে দেখতে শান্তদার জীবনদর্শনটাই হয়ে গেছিলো পুরোপুরি সিনেমাটিক। তিনি সেই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে চাইতেন। সব সময় অবশ্যি তাতে সফল হতেন না। তবে শ্যামলের ব্যাপারে শান্তদার সিনেমাটিক টোটকাটা কাজে দিয়েছিলো। কয়েকমাস পরে শুনলাম শ্যামলের বউয়ের ছেলেপুলে হবে। শ্যামল বলল, বউ এখন একদম নর্মাল। আর ভয় পায় না। এনজয় করে।

শ্যামল এর বেশি আর কিছু জানালো না। আমরা তখন শান্তদাকেই চেপে ধরলাম। কী করে এ সব হলো?

উনি হেসে বলেছিলেন-

- আরে বলেছিলাম না, বিষে বিষক্ষয়! সেই পথেই। শ্যামলকে বুদ্ধি দিয়েছিলাম  বউটাকে কায়দা করে সেডাটিভ ওষুধ খাইয়ে তারপর যা করার কর। ঝিমুনির চোটে তখন তার আর বাধা দেবার ক্ষমতাই থাকবে না। বলেছিলাম কদিন ওভাবে করতে পারলেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। নর্মাল হয়ে যাবে। তবে জোরাজুরি একদম করবি না। যা করবি নরমে সরমে। শ্যামলা সেরকমই করেছে। দ্যাখ তার সুফল হয়েছে কি না? নন্দ ডাক্তারকে বলে শ্যামলকে ঠিকঠাক নিরাপদ সেডাটিভ তো আমিই জোগাড় করে দিয়েছি। ডোজ অনুযায়ী পুড়িয়াও আমিই করে দিয়েছি। রাতে শোবার আগে দুধের সাথে গুলে খাইয়ে দিতে হবে শুধু।

এরকম তো হিন্দি সিনেমাতে প্রায়ই দেখায়। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে...

তারপর শান্তদা বলেছিলেন, তোরা শুধু শুধু হিন্দি সিনেমার নিন্দে করিস। এখন  বল, হিন্দি সিনেমা মানে কি শুধুই খারাপ?

শ্যামলার জীবনটা কেমন সুধরে গেলো। এরকম সিনেমাটিক টোটকার কথা  জীবনে শুনিনি। তবে তাতে কাঙ্ক্ষিত সুফল যে ফলেছিলো, সে তো নিজের চোখেই দেখা। তাই শান্তদার কথা না মেনে উপায় নেই!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন