কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


সোনালি চুলের মেয়েটি


এই বন্দর শহরে ছেলেটির কোনো ডাকনাম নেই। এমনকি এই শহরে ছেলেটির কোনো ভালো নামও নেই। নামবিহীন ছেলেটা নাম বিহীন অবস্থাতেই আছে। খায় দায়। বাহ্যি ত্যাগ করে।আবার ঘুম পেলে ঘুমিয়ে যায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে যে, ছেলেটি বন্দরে বহুদিন ধরে পড়ে থাকা একটা পণ্যবাহী জাহাজে কীভাবে যেন ঢুকে পড়েছে।  

এতদিনে ছেলেটির একটি নাম হলো। কেননা যারা জাহাজ, পোত বা বন্দর শব্দের সাথে পরিচিত, তারা অনেকেই ছেলেটার চেহারা সম্বন্ধে একবাক্যে বলবে যে, তার চেহারাটা হবে নির্লিপ্তিতে ভরা। পৃথিবীর কোনো কিছুতেই তার কিছুই যায় অথবা আসে না।

তো, এমন একটা ছেলের খিদে বা তৃষ্ণা থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে ঘুমটা তার গভীর। ঘুমের ঘোরে জলজ্যান্ত বোধের জগৎ খুলে যায় তার। তখন সে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই নানা কথা বলে, একথা সে, যে জাহাজে চেপে বসেছে, তারই অন্যান্য যাত্রীরা, মানে, তারই মতো ভ্যাগাবন্ড যারা, তারাই বলে।

ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর নানা দেশে এই পণ্যবাহী জাহাজটা পাড়ি জমায়। আর ইতিমধ্যেই নামহীন বা অজ্ঞাতনামা যুবকের নাম হয়ে গেছে 'পোত'। অবশ্য তারই মতো এক ভবঘুরের কথায়, ছেলেটি না কি একই পোতাশ্রয়ে বারবার গেলেও অন্য ছেলেদেরকে জিজ্ঞেস করে- এই পোত-এর নাম কী? তো, এমনই বারবার একই কথা ছেলেটির মুখে শুনতে শুনতে অন্যান্যরা তার নাম দিয়ে ফেলেছে 'পোত'।

অতএব 'পোত' মানে জাহাজ আর আশ্রয়। জাহাজ মানে এক বিরাটাকার জলযান। জল মানে জীবন। তাহলে দাঁড়ায় এটাই যে, পোত-এ 'পোত'-এর মতো একটা জলজীবী কেমন করে যেন ঢুকে পড়েছে।

জলযানে আস্ত একটা পোত ঢুকে বসে আছে, এ কেমন করে সম্ভব, এ নিয়ে জাহাজটির নানা সময়ের নানা নাবিক সহ অন্যান্য কর্মীদের মনে হাস্যকর প্রশ্ন জাগে!

আজ জাহাজটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লং বীচে অবস্থান করছে। ও দেশে কিছু  ওষুধপত্র নামিয়ে জাহাজটি ফিরে আসবে পেট বোঝাই করে গম নিয়ে।

'পোত'-এর চোখে ভাসে গ্রীষ্মের দুপুরে তাদের গ্রাম, তারপরের গ্রামের মাঠে মাঠে  সোনালী রং-এর পাকা গম-এর গন্ধে ভরা দেশীয় শস্য-দানা কাটাই-ঝাড়াই হয়ে চলে যায় যেন কোথায়! আরও প্রশ্ন জাগে তার মনে, এই গম শস্য তো তাদের গৃহস্থ ফসল। তবে আবার কেন তাকেই এই জাহাজ বহন করে নিয়ে যাবে দেশে! এ-সবই 'পোত'-এর মন কী বাত।

মনে মনে যা ভাবে সে, ঘুমের ভেতরে সেগুলোই কথা হয়ে জাহাজময় ঘুরঘুর করে। ওর মতো অন্যান্যরা সেইসব কথার খেই ধরতে না পেরে হাসে। খুব হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে তারা পরস্পরের গায়ে। তৈরি হয় অদ্ভুত অনুরণন এবং তার থেকে বেরিয়ে আসে প্রবল যুক্তি তর্কে জড়িয়ে পড়া ঢেউ। সেই ঢেউ-এর ফেনা মিশে যায় বাইরের সমুদ্রের নোনা জলে। হারিয়ে যায় অগুনতি সেইসব প্রশ্নমালা অতলান্তে। এসব আবার 'পোত'-এর ভাবনার বিষয় নয়। সে কেবলই তার অফুরন্ত সময়ে খবরের কাগজের পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় সহযাত্রীদের করা প্রশ্নের উত্তরমালা।

গত এক সপ্তাহ যাবৎ জাহাজটি লং বীচে অপেক্ষা করছে। সমস্ত পোর্টেই এমনটা হয়। দানাদার শস্য বা ফল হলে লোডিং ও আনলোডিং-এর সময় কিছু অস্থায়ী  কর্মীর প্রয়োজন হয়। আজ এই জাহাজটির ক্ষেত্রেও সেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।  আর, এই সময়ে সেইসব ভবঘুরেরা, যারা জাহাজের বাথরুম, ল্যাট্রিনে যাওয়ার প্যাসেজে বসে, শুয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি জমায়, তারা লোডিং ও আনলোডিং-এর স্থলে পেতে রাখা বৃহৎ বৃহৎ ত্রিপল-এর ওপরে ছড়ানো ছেটানো শস্যদানা বা  বোঁটা থেকে খসে পড়া ফল, এসব ঝাড়ু দিয়ে, কুড়িয়ে ও সেগুলো বিক্রি করে কিছু বাড়তি রোজগার করে নেয়। এমন সুযোগের অপেক্ষায় থাকে বন্দরে অপেক্ষমাণ আরও কিছু মুখ, যারা সমগ্র বিশ্বেরও শ্রেণি বিভাগের চরম পরিণতি!

মনোরম স্থানে পাওয়ার অনেক কিছুই আছে। এই যেমন, 'পোত'-এর ক্ষেত্রে,  সুনীল জলরাশি এসে পা ধুইয়ে দিচ্ছে জাহাজের। জলকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে ঢেউ-এর উত্থান-পতন। এইসবের মধ্যে বিশ্ব মানচিত্রের দিনাতিপাত যেন,  চলমান জীবন-দৃশ্যের সাক্ষ্য রেখে যাচ্ছে, এ-সব এড়িয়ে চলতে গিয়ে থমকে যায় পোত-এর গায়ে শৃঙ্খলায় বাঁধা পড়ে থাকা রক্তমাংসের 'পোত' মানুষ।

'পোত' মানে তো জাহাজের আশ্রয় বা বন্দর!বন্দর মানে বিরামহীন কর্মব্যস্ততার  নীরবতা! এই নীরবতারও ভাষা থাকে, যার পাঠোদ্ধার করতে পারে কেউ কেউ।

তবে এই মুহূর্তে 'পোত'এর মনের ঘরের ভেতরে ভেতরে স্থিতিশীল এক  ভারতীয় জাহাজ, যা কি না যুক্তরাষ্ট্রের লং বীচে সমুদ্রের জলে দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজ ছুঁয়ে বিশাল বিশাল ত্রিপলের ওপরে ভারতে আসার জন্য গমের বস্তাবন্দি দেহ তুলে দেওয়া হচ্ছে।

মনের ঘরদোর ঝাঁট দিচ্ছে একাধিক ভবঘুরের ভবিষ্যৎ। সেইসব আগামীর মধ্যে নীল রং-এর ফ্রক পড়া সোনালী চুলের মেয়েটি 'পোত'-এর লৌহশকটের  মনটাকে আলতোভাবে নাড়িয়ে দিতেই, 'পোত' নামের বহুরূপী একদা একজন মানুষ, তার শরীরের সর্বাংশে ঘরবাড়ি দেখতে পেলো। সেই সব ঘরবাড়ি ভারতীয় ধাঁচের। গাছপালায় ঘেরা বাড়ি। বাতাসের মৃদুমন্দ স্পর্শে পাতার আন্দোলন। ডালে ডালে পাখির কুজন! বাড়িতে শোয়ার ঘর, লাগোয়া টয়লেট। বারান্দায় বসার আসবাব আর কী দেখলো 'পোত'? সে দেখতে পাচ্ছে তার মানসচক্ষু দিয়ে,  একজন নারীর নূপুরের ঝুমঝুম শব্দ সারা বাড়িময়, মানে 'পোত'-এর শরীরের সর্বাংশে।  

'পোত', মানে জাহাজের আশ্রয় এখনও দেখেই যাচ্ছে, নীল রং এর ফ্রক পড়া, নীলচে চোখের ও ঘিয়ে চুলের সেই মেয়েটি 'পোত'এর লৌহ খুঁটির সাথে ভালোবাসার শিকলে লং বীচে বাঁধা পড়ে গিয়ে একঠাঁই হ'য়ে আছে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন