কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

সুজিত পাল

 

অচীনতলার ‘অচিনগাছ’




 

‘অচিন’ মানে অচেনা। অর্থাৎ যাকে চেনা যায় না। এমনই একটি গাছের কথা  বলবো। প্রচুর তার ডালপালা, বংশ বৃদ্ধির লক্ষণ চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। গাছের  ডালে ডালে ছাগল, ছোট ছোট মুরগী খেলা করে বেড়ায়। বহুদিন থেকেই ভাবছি এই গাছ নিয়ে লেখা দরকার।

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল মহকুমার অন্তর্গত অচীনতলা। সেখানকার সকলেই চেনেন জায়গাটা। বাসস্টপও আছে। রাস্তার পাশেই বিশাল জায়গা জুড়ে বেশ কয়েকটি গাছ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বটগাছ। প্রচুর গাছের ঝুড়ি নেমেছে। সকলে দেখলেই প্রথমে ভাববে, এটি বটগাছ। আমিও তাই  ভেবেছিলাম। কাছে এলেই স্পষ্ট হবে এটি অন্য ধরনের গাছ। ঝুড়ি আছে বটে, তবে এর বৃদ্ধি মূলত গাছের ডাল থেকে। গাছের ডাল মাটিতে ঠেকলে সেই ডাল থেকে আবার নতুন গাছের জন্ম ঘটে।

২৬ আগস্ট ২০২২, অচীনতলায় গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গী হিসেবে ছিল আমার এক পিএইচ.ডি স্কলার সুনীল দলবেরা। সুনীলের গাছের প্রতি আগ্রহ ভীষণ। সে নিজেই অচিন গাছ, গাছের পাতা, গাছের ফুল, পুরনো গাছের গুঁড়ি, সমস্ত ছবি সংগ্রহ করেছে। আমি স্থানীয় এক ব্যক্তির সাথে কথা বলে গাছের ইতিহাস ও লোকশ্রুতি সম্পর্কে জেনে নিচ্ছিলাম।

স্থানীয় ব্যক্তির মতে গাছটির বয়স কেউই জানেন না। তবে আনুমানিক এক হাজার বছর হতে পারে। প্রায় এক বিঘা জমির উপর একটিই গাছ। চারিদিকে ডাল থেকে নতুন নতুন গাছের জন্ম হয়েছে। স্থানীয়দের মতে তারা জন্ম থেকে যে গাছটি দেখেছে, সেটি এখন নেই। বহু আগেই বয়সের কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। আমি নিজে ২০০১ সালে একবার সেই গাছটি দেখেছিলাম। তার ডালপালা চারিদিকে ছড়িয়ে। দেখেছি গাছের ডালে ছাগল ঘুরে বেড়াতে। এখন যে গাছগুলি আছে সেখানে ডালে ডালে বহু মানুষ বসে গল্প করে। গাছের নীচের ছায়ায় হাট বসে। প্রচুর মানুষের সমাগমও হয়।

স্থানীয়দের মধ্যে কথিত আছে এই অচিন গাছ এশিয়ায় নেই। অনেকেই এসে দেখে গেছেন। গাছের ফল ঠিক ডুমুরের মতো। পাতাও দেখতে তেমনই। অক্টোবর, নভেম্বর মাসে ফল ফলতে শুরু করে। ডিসেম্বর, জানুয়ারী মাসে ফল পেকে যায়। প্রচুর পরিযায়ী পাখি এই ফল খেতে আসে। গাছ জুড়ে পাখিদের মেলা বসে যায়। স্থানীয় মানুষেরা পাখি দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ফলগুলি লাল রঙের। সন্ধ্যায় কিচিরমিচির ধ্বনিতে সারা এলাকা মাতিয়ে তোলে। যাইহোক আমরা আবার আসবো কথা দিয়েছি। কারণ আমার নিজেরই তিনবার গাছটি দেখা হল। ২০১৫ সালেও একবার এসেছিলাম। কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু লেখা হয়ে ওঠেনি। এবার কিছুটা চেষ্টা করলাম। এই ছবিতে অচিন গাছের ফল দেখা যাচ্ছে। এই সময় ফল খুব কম। তাই ভালো ছবির মতো ফল পাওয়া যায়নি।

গাছের পাতার ছবিও দেওয়া হল। কচি কচি পাতা ছাড়াও পুরনো কিছু পাতারও ছবি তোলা হয়েছে। পাতা ছাগলে খায়। শীতের পরে ঝরে যায়। ধীরে ধীরে নতুন পাতায় অপূর্ব দৃশ্যে ভরিয়ে তোলে মানুষের মন।

গাছের ছবি ও ভিডিও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের এক অধ্যাপকের কাছে দেব, আলোচনাও করেছি। এই গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আপাতত গাছটির ছবিসহ পরিচয় দিলাম।

স্থানীয়দের মধ্যে গাছটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ভীতি ও বিশ্বাস কাজ করে। অনেকেই বলেছেন গাছের ডাল কেউ কাটে না। অন্যের জমিতে গাছের ডাল ঢুকে গেলেও কাটে না। কারণ তার পরিবারের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।

অনেকেই বললেন বহু আগে এই গাছের গুঁড়িতে সাধুবাবা বসবাস করতেন। তখন এলাকাটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। এখন তো গাছের চারিদিক প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। সেই সাধুবাবা এই গাছের নীচে সাধনা করতেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বহু লোকশ্রুতি প্রচলিত। এখন অবশ্য অনেকেই সেই লোকশ্রুতি বিশ্বাস করেন না। তাই অনেকেই নিজের জায়গা ঠিক রাখার জন্য প্রাচীর দিয়েছে। সেই প্রাচীরেরে উপর দিয়েই গাছের ডাল অন্যের সীমানায় ঢুকে পড়েছে। তবু ডাল কাটে না।

বিরাট গাছের এলাকা মোবাইল ক্যামেরায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবু চেষ্টা করা হয়েছে। গাছগুলি একে অপরকে আঁকড়ে রয়েছে। এলাকার মানুষের আবেগও এই গাছের প্রতি অপরিসীম। গাছটিকে বাঁচিয়ে রাখাই তাদের ব্রত। প্রত্যেকেরই একই কথা। তাদের বিশ্বাস এই গাছটির অক্সিজেন নিয়েই তাদের প্রাণ টিকে আছে। আমারও ইচ্ছে পরবর্তীতে এই গাছটির আরও তথ্য তুলে ধরবো। নীচে আরও কিছু ছবি দিলাম। সাক্ষাৎকারী ব্যক্তি ছাড়াও আমি রয়েছি।


1 কমেন্টস্: